চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

উপকূলে প্যারাবন ধ্বংস করে মাছের ঘের

ইমরান বিন সবুর

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ২:৩৪ অপরাহ্ণ

ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষায় চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছিল ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবন। আনোয়ারায় শঙ্খ নদের মোহনার সেই প্যারাবনের নির্বিচারে গাছ কাটা ও মাছের ঘেরের কারণে এখন সবুজ বেষ্টনী ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

 

‘এখন যেদিকে চোখ যায় শুধু মাছের ঘের’ গত এক বছরে আগেও ছিল খালি মাঠ। কোথাও কোথাও ছিল গাছ। এমনই চিত্র ছিল এই প্যারাবনের। এখন অবৈধভাবে জায়গা দখল করে মাছের ঘের নির্মাণ করছে একটি ভূমিদস্যু চক্র। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশ বিধ্বংসী এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এক সংঘবদ্ধ একটি চক্র। শুধু তাই নয়, এ চক্র ওই এলাকা থেকে মাটি কেটে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করছে বলে জানান স্থানীয়রা।

 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে গত  কয়েক বছর ধরে এই প্যারাবন এলাকাটি পর্যটকদের কাছে পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। উপজেলার দক্ষিণে শঙ্খনদী, পশ্চিম সীমান্তে বঙ্গোপসাগর সীমারেখা ও শঙ্খ নদীর মোহনা ঘিরে আছে গহিরা প্যারাবন ও সৈকত চর। এ এলাকাটির অপরূপ সৌন্দর্যে উপভোগ করতে এখানে ছুটে আসে পর্যটকরা। কিন্তু মাছের ঘের নির্মাণ কারণে আগে চলাচলের সড়কও আর নেই।

 

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় প্যারাবনের জায়গার আশপাশে কয়েকটি মাছের ঘের তৈরি করা হয়েছে। এই জায়গাটি সম্পূর্ণ সরকারি জমি বলে জানা গেছে।

 

এলাকাবাসী জানায়, ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০২০ সালে আম্পান, ২০২১ সালে ইয়াস এবং সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের গতি, প্রাণহানি ও সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি কমিয়ে দিয়েছিল এ প্যারাবন। এ প্যারাবন না থাকলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাদের ঘরবাড়ির অস্তিত্বই থাকত না। বনের গাছপালা ও জীবজন্তুর ক্ষতি হলেও বেঁচে যায় মানুষের জীবন ও জীবিকা। সম্প্রতি এ প্যারাবনের আশেপাশের বেশিরভাগ জায়গা দখলে নিয়ে গড়ে ওঠেছে মাছের ঘের, যার কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে।

 

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, প্রকাশ্যে এসব প্যারাবনের জায়গায় মাছের ঘের করলেও দেখার কেউ নেই। তবে এখনো পর্যন্ত বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে প্রতিনিয়ত রাতের অন্ধকারে প্যারাবনের গাছ কাটা ও মাছের ঘেরের জায়গা দখলের করছে।

 

স্থানীয় বাসিন্দারা আরো জানান, দক্ষিণ গহিরা ও ধলঘাট এলাকার এই প্যারাবনে ১০ থেকে  ১২ হাজারেরও বেশি গাছ ছিল। কিন্তু প্রতিনিয়ত গাছ চুরি হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে বনটি ন্যাড়া হয়ে পড়েছে। রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে গাছ চোরেরা গাছ কেটে নিয়ে যায়। বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও এর সঙ্গে জড়িত। তবে এখন ওই বনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে চরে দখল করে মাছ চাষ করছে কিছু ব্যক্তি।

 

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ গহিরা ও ধলঘাট এলাকার আড়াইশ একর এলাকায় শঙ্খ নদের মোহনায় এই প্যারাবন সৃজন করা হয়েছিল। বনটি উপকূলীয় বন বিভাগের আওতাভুক্ত প্রেমাশিয়া বিটের অধীনে রয়েছে। এই প্যারাবনে বাইন, কেওড়া ও ঝাউগাছ লাগানো হয়েছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর।

 

ইউটিউবার নীল জামশেদ বলেন, বর্তমান সরকার উপকূলীয় রায়পুর জুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করায় চলাচলের সুব্যবস্থা হয়েছে। এ প্যারাবন ও সমুদ্র সৈকতকে সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ ছুটে আসছে এ এলাকায়। বন বিভাগ ও পর্যটক মন্ত্রণালয় যদি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে তা হলে সরকার লাভবান হবে।

 

তিনি আর বলেন, বিনোদনপ্রেমী পর্যটকরা আনন্দ ভ্রমণের জন্য খুঁজে পাবেন নতুন ঠিকানা। পাল্টে যাবে এ এলাকার সমাজ জীবন, স্থানীয়দের ব্যবসা-বাণিজ্যও আয়-রোজগার বাড়বে। প্যারাবন ও সমুদ্রসৈকতকে সৌন্দর্য্য লক্ষ্য করা আমাদের দায়িত্ব। ওই বনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে চর দখল করে মাছ চাষ করছে কিছু ব্যক্তি। কিন্তু মাছের ঘের নির্মাণ কারণে আগে চলাচলের সড়ক আর নেই।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের পাল্লা দিয়ে উপকূলীয় এলাকার দুর্যোগ ঝুঁকি এমনিতেই বাড়ছে। অব্যাহতভাবে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উজাড় তা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়াও নানা কারণে দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলের প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ প্যারাবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ওইসব এলাকায় নতুন করে বনায়ন না হলে ভবিষ্যতে সুনামি, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে।’

 

মাছের ঘেরের ব্যাপারে জানতে চাইলে রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আমিন শরীফ বলেন, ‘মাটি কেটে মাছের ঘের করা এসব জায়গা ব্যক্তি মালিকাধীন। এখানে বন বিভাগ বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন জায়গা নেই।’

 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি আনোয়ারা রায়পুর ইউনিয়নের প্যারাবন পরিদর্শনে যাইনি। প্যারাবনে ব্যক্তি মালিকাধীন জায়গা কীভাবে থাকবে? প্যারাবনের জায়গায় মাছের ঘের করার কোন সুযোগ নেই। এমন প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট