চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

নেপাল ভ্রমণ: পর্ব- ১৫ (সমাপ্ত)

হাফিজা আক্তার

২১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ১০:০৩ পূর্বাহ্ণ

কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। কিছুক্ষণ পর আমরা চারজন বাংলাদেশি হয়ে গেলাম। যা এবার রাজা-উজির মারি বসে বসে। কাজ দিল। সময় তরতর করে বয়ে গেল। আর অবিশ্বাস্য হচ্ছে বাংলাদেশ বিমান সঠিক সময়ে উড়ার সিদ্ধান্ত নিল। আমারাও বোর্ডিং এর জন্য এগিয়ে গেলাম সন্তুষ্টি চিত্তে। নেপালে এসেও সময় স্বল্পতা আর কর্মব্যস্ততার জন্য এভারেষ্ট শৃঙ্গ দেখতে না পেরে আমরা আক্ষেপ করছিলাম দেখে চেকইনের সময় করিম সাহেব আমাদের বুদ্ধি দিয়ে ছিলেন বিমানের বাঁ পাশে সিট নিতে। কাউন্টারে চেয়েছিলাম বিনিতভাবে। মঞ্জুর হয়েছিল কি না বুঝতে পারিনি। বিমানে উঠে দেখি সত্যি সিট বরাদ্দ পেয়েছি বাঁদিকে জানালার ধার ঘেঁষে। যাক বাবা বিমানে উপর দিয়ে এভারেষ্ট ওরফে হিমালয় দেখে ফিরবো। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাবে। সব ঠিকঠাক। বিমান রানওয়েতে দৌঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত। ঘড়িতে ২:২০ নাকি ২:৩০ বাজে। সিটে সিট বেল্ট বাধাঁর আর ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস টার্ন অফ করার শেষ অনুরোধটুকু বিনিতভাবে ভেসে আসছে। আর তারপরই ভেসে আসলো একটি ভরাট পুরুষ কন্ঠের ঘোষণা, “ক্যাপ্টেন সাজিদ এবং তার ক্রুদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের Airship BG072-এ স্বাগতম জানাচ্ছি।

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আকাশে উড্ডয়ণ করতে যাচ্ছি। আশা করছি ভ্রমণটি আপনাদের জন্য নিরাপদ আর আরামায়ক হবে….ব্লা….ব্লা”। আমরাও ভাবছি যাত্রাটি শুভ হবে। ভাবার আরেকটি কারণ অমূলক বা অন্তরের গভীরে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কার। যেহেতু এবারের কাপ্টেন একজন পুরুষ সেহেতু ভ্রমণটি অনেক নিরাপদ। তথাস্তু বিমানটি স্মুথলি আকাশে উঠে গেল। শেষবারের জন্য দেখে নিলাম কাঠমান্ডু শহর। ধীরেধীরে শহরটি দূর থেকে দূরে ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারও পরে মেঘেরা এসে পুরোপুরি ঢেকে দিল। ক্রমেই মেঘের আনাগোনা বাড়তে লাগল আর সেই সাথে গতি। বিমান কখনো কাঁপছে আবার কখনো উপর নীচ করছে। যাত্রা আরামদায়ক তো নয়ই এখন নিরাপদ হবে কি না সেটাই ভাবছি। কিছুক্ষণ পর মনিটরে দেখলাম হিমালয় এবং বিমানের অবস্থান। জানালায় চোখ রাখলাম কিন্তু লাভ হলো না। এভারেস্ট ঘন মেঘে প্রায় অস্ফুষ্টো এক পর্বত শৃঙ্গ। বারবার সিট বেল্ট বেঁধে রাখার অনুরোধ আসছে। এ রকমই চললো বাংলাদেশের সৈয়দপুর পর্যন্ত। তারপর রোদেলা ঝকঝকে আকাশ। নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে, “কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ঈশ্বরদি অতিক্রম করতে যাচ্ছি”। ঈশ্বরদি শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম আর মনিটরে চোখ রাখলাম কখন ঈশ্বরদি ক্রস করে। বিমান থেকে ঈশ্বরদি দেখবো বলে। বলে রাখি আমার স্কুল লাইফে যে কয়টা ভিলেন ছিল তার মধ্যে ঈশ্বরদি একটা। তখন পড়াশুনায় মন একেবারেই ছিল না। মন ছিলো শুধু খেলাধুলায়। পরীক্ষার আগের রাত ছাড়া পড়া তেমন হতই না। কিন্তু এক রাত পড়ে পরীক্ষায় বসা কঠিন ব্যাপার ছিল বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভূগোল বিষয়ে। দেখা যেত যত কল কারখানা আর বিখ্যাত যাকিছু আছে হয় ঈশ্বরদি নয় দর্শণা বা খুলনা/ফেঞ্চুগঞ্জ/জয়দেবপুর/পাহাড়তলী…ব্লা…ব্লা। এর মধ্যে ঈশ্বরদিতেই বেশি। বুদ্ধি আটলাম। যেহেতু ঈশ্বরদিতে সব কিছুই বেশী বেশী তাই আনকমন কিছু আসলেই লিখে দিবো ঈশ্বরদি। চমৎকার কাজ করলো। অন্ধকারে ঢিল মেরে ভালোই সুবিধা পাচ্ছি। একদিন বাধঁলো বিপত্তি। ক্লাসে এসেই আপা একে একে সবাইকে পড়া ধরছেন। আপদ কারে বলে। আমার কাছে এসে বললেন “ বল, পতেঙ্গা সি-বিচ কোথায়”। উত্তর সোজা। কোন ব্যাপার না। আমি ঝটপট বলে দিলাম, “ঈশ্বরদি”। আপা চোখ উল্টে রাগত স্বরে বললেন, “ঈশ্বরদি কোথায় আর পতেঙ্গা কোথায় তোর ধারণা আছে”। দৃঢ় কন্ঠে বললাম, “ঈশ্বরদি পতেঙ্গার কাছে।” এবার উনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন, “পড়াশুনা কিছু করিস নাকি সারাদিন শুধু খেলাধুলা। দাঁড়া তোর বাবাকে বলতে হবে।” বাবার কথা শুনে বুক ধরাস করে উঠল। মুখ পাংশু হয়ে গেল। বাবাকে বলা আর যমকে বলা একই কথা। যে রাশভারি ছিলেন আমার বাবা! এক চোখ মটকানি দিলেই আমরা ভাইবোনেরা ভয়ে শেষ। আর যদি আপা নালিশ দেন তবে আর আস্ত রাখবে না। মনে মনে ধুনু ভাঙ্গা পণ করলাম পড়াশুনা করাবোই করবো। দুই তিন মাস স্পিডে পড়াশুনা করে গিয়ে পরীক্ষায় বসলাম। একেবারে সরাসরি দ্বিতীয়। এই রেজাল্টে শিক্ষক-বন্ধু-ক্লাসমেট-পড়শি-আত্মীয়সহ সবাই বেকুব হয়ে গেল। সাথে আমিও। সবার ভিমরিভাব কেটে গেলে কেউ প্রকাশ্যে আর কেউ কেউ ফিসফিস করে আড়ালে বলতে লাগলো, “কেমনে কেমনে জানি হয়া গেছে। ওই একবারি। ধরে রাখতে পারবে না”। ফাঁপরে পড়ে গেলাম। এহেন মন্তব্যের পর পজিশন ধরে না রাখাটা অসম্মানজনক। এমনভাবে পড়লাম যাতে পজিশন দ্বিতীয়তেই থাকে, উপরেও না নিচেও না। কারণ এহেন তীর্যক মন্তব্যের পর নিচে নামা সম্ভব না আর যে ফার্স্ট গার্ল সে অনেকটাই আনবিটেবল। যদি নিতে যাই তবে পড়াশুনার চাপে খেলা মাথায় উঠবে। দ্বিতীয় পজিশন সবদিক থকে নিরাপদ মনে হলো। এই পজিশনটা স্কুলের শেষ অবধি ছিল। যাক্ এবার ঈশ্বরদি দর্শনে ফিরে আসি। ঘোষণা আসছে, “ আমরা এখন ঈশ্বরদি অতিক্রম করছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা পৌঁছে যাচ্ছি”। মনিটরেও দেখা যচ্ছে বিমান এখন ঈশ্বরদির আকাশে। জানালায় চোখ রাখলাম ভিলেনের উপর। ভিলেন হলে কি হবে বেশ সুন্দর, হিন্দী-বাংলা সিনেমার ভিলেনের মত নয়।শহরের রাস্তা-জমি-বাড়ি-ঘর সব সুবিনাস্ত আর পরিপাটি। খুব ঘিঞ্জি বা কংক্রিটে ঢাকা বলে মনে হয়নি। যথেষ্ট সবুজ আর ফাঁকা মনে হলো। মাত্র কয়েক মিনিটেই অতিক্রম করে গেল বিমান। পদ্মাকে দেখা গেল শুধু একটা শীর্ণ খালের মতন। আর তারপর ঢাকা। বিমান অবতরণের পূর্বে বারবার নয় একবার কি দু’বার ঘোষণা দিল। আর তারপরই টেইকঅন। তবে ভ্রমণ শেষে ক্যাপ্টেন তানিয়া এবং তাঁর ক্রুদেরই বেশী মার্কস দিয়ে দিলাম ক্যাপ্টেন সাজিদ আর তাঁর ক্রুদের চাইতে। তারপরও বলাকা ভ্রমণ অনেক সুন্দর আর আরামদায়ক ছিল। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম সৃষ্টিকর্তাকে আর স্যালুট দিলাম ক্যাপ্টেন সাজিদ আর তাঁর ক্রুদের। বিমানের বাসে করে এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে ঢুকে নেপাল যাত্রা শেষ করে বাংলাদেশের দিকে পা রাখলাম। আর সাথে নিয়ে এলাম কিছু অভিজ্ঞতা। মানুষ, সমাজ বা রাষ্ট্র গরিব বা নিম্ন আয়ের হতে পারে তাতে দোষের কিছু নয় কিন্তু এর মধ্যেও একটি সিস্টেম, মানবিকতা, সম্প্রীতি বা নৈতিকতা থাকবে বা থাকে। নেপাল থেকে অনেক কিছুতেই আমরা তর তর করে উপরের দিকে উঠছি আবার অনেক কিছুতে নিচেও নামছি আরো দ্রুত লয়ে। কারণ নিচে নামার রাস্তাটা খুব পিচ্ছিল। একবার নামা শুরু করলে নামতেই থাকে এর কোন শেষ নেই। এর কোন তলও নেই।

পূর্বকোণ/টিএফ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট