চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চেতনায় একুশ

ফারজানা আহমেদ জয়া

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

নান্দনিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি শুধু বাংলা সাহিত্য এবং কাব্য রচনাই করেননি বরং ভাষার প্রতি দায়িত্ববোধ হতে নির্ণয় করার চেষ্টা করেন কিভাবে ভাষার ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ আঁচড় কেটে চলেছে। একারণেই আবেদনময় কারুকার্যমণ্ডিত বাংলা ভাষা সম্পর্কে কবি চমৎকার করে বলেছেন : ‘বাংলা ভাষার এই এক মাধুর্য, আসছি বলে স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যাওয়া যায়।’ এই মাধূর্য-ভরা ভাষা মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার গল্পটা নিছক কোন গল্প ছিল না। বহু আত্মত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে আদায় করা হয়েছিল মাতৃভাষা হিসেবে ‘বাংলা’র স্বীকৃতি। আর তাই, একুশ নিয়ে আমরা গর্ব করি।

ফাল্গুন আমাদের উজ্জীবিত করে। ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য শোকের মাস। ভাষাশহীদদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত শহীদ মিনার আমাদের অহংকারের প্রতীক। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা দিবস। একই সাথে, ২০১০ খ্রিস্টাব্দ হতে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসবে পালন করা হয়ে আসছে।
বংলাভাষাভাষী জনগণ প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই ভাষার জন্য জীবনদানকারী শহীদদের প্রতি। কিন্ত আজ কেন জানি মনে হয়, সময়ের পরিক্রমায় এই ফুল দেয়া আমাদের জন্য এক ধরনের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

গত ২০২০ এর ২৫ শে ডিসেম্বর আমার দুই বন্ধুসহ ফেলে আসা শিক্ষা জীবনের স্মৃতির সন্ধানে ঢাকা ঘুরতে গেলে, তার অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও যাই। সেদিন দূর থেকে শহীদ মিনার পানে দৃষ্টি পড়ে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। রাস্তার পাশ ঘেঁষে শহীদ মিনারের সামনের অংশে বসেছে বেশ কিছু অস্থায়ী খাবারের দোকান । চারপাশে এলোমেলো বসে বা ঘুমিয়ে আছে মানুষেরা। এছাড়া যেখানে সেখানে রয়েছে শহীদ মিনারে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ। এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে কাগজ, চিপস্‌ এর প্যাকেট। কর্তৃপক্ষ কতৃর্ক একটি সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘মূল বেদীতে জুতা পায়ে ওঠা ও বসা নিষেধ’। মূল বেদীতে জুতা পরে ওঠা নিষিদ্ধ থাকলেও এমন একজনও খুঁজে পাওয়া গেল না যে জুতা খুলে বেদীতে উঠেছে। নিয়ম ভাঙ্গা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে। করোনা এবং জুতা খুলে উপর উঠতে হবে, এই দুই ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমরা বন্ধুদ্বয় শহীদ মিনারের বেদীর নীচে অবস্থান করে। সেন্ডেল খুলে রেখে আমি আমি একাই চলে গেলাম মূল বেদীর একদম কাছে। মূলত শহীদ মিনার খুব কাছ হতে দেখার আগ্রহের পাশাপাশি শহীদ মিনার বেষ্টিত লোকজনের কার্যকলাপ
আরো ভাল করে দেখার জন্যেই এটা করা। সারিবদ্ধভাবে জুতা পড়ে শহীদ মিনারের সামনে দীড়িয়ে বা গোল হয়ে বসে চলছে সেলফি তোলা। পাশাপাশি আইসক্রিম বা বাদাম খাওয়া আর সেই সাথে গল্প তো চলছে। অনেকের কাছেই ঢাকা শহরের অবকাশ যাপনের কেন্দ্র হিসেবে শহীদ মিনার এখন বেশ জনপ্রিয় বোঝা যাচ্ছে।

অবাক বিস্ময়ে দেখলাম একটি কুকুরও শহীদ মিনারের মূল স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটি ততোধিক বিস্ময়ে হয়তো মানুষের কর্মকাণ্ড অবলোকন করছে। জুতা পরে, পা তুলে, বাদামের খোসা ফেলে কিংবা অন্য কোন নোংরা জিনিষ ফেলে গিয়ে যারা শহীদদের আত্মত্যাগকে অসম্মান করছেন, তাদেরই আবার দেখা যায় ভাষার মাসে বর্ণ অক্ষর যুক্ত পাঞ্জাবি বা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ‘এই শহীদ মিনারের বেদীতে’ই এসেছেন ফুল দিতে।

রাউজানে আমার শ্বশুরবাড়ি সংলগ্ন শহীদ মিনারে সিঁড়িতে কাউকে কখনো জুতো নিয়ে উঠতে দেখিনি । আমরা শহর থেকে গেলে সেখানে সেই মুহুর্তে যেই-ই থাকুক তিনি বলে ওঠেন, ‘জুতা খুলে ওঠেন’। মূল স্তম্ভের সামনে রয়েছে আলগা করে এক লোহার শিকল । চাইলেই সে শিকল খুলে ফেলা যায়। যায় সেই শিকলের উপর দিয়ে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু কখনো কাউকে দেখি না এই কাজটি করছে।

শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ বিষয়ক বিষয়গুলি শিক্ষিত শহুরে মানুষেরই সৃষ্টি (যদিও শহীদরা এই আকাঙ্ক্ষা হতে শহীদ হন নাই)। অথচ আমরাই সেই সৃষ্টির প্রাপ্য সম্মান দিতে ভুলে যাই। ভাল লাগে, যে সম্মান আমরা শহুরে মানুষ অনেকক্ষেত্রে দিতে অবহেলা করি; তা দিতে গ্রামের সাধারণ মানুষ কিন্তু ভুল করে না। তাই কোন বিষয়, বস্তু বা ব্যাক্তিকে সম্মান করা শিখতে হবে হবে
গোড়া হতে। তা নাহলে হয়তো একদিন আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে আমরাই আমাদের সন্মান হারানোর জন্য দায়ী হয়ে রইবো।

বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি মাস বা শহীদ দিবস এলেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ধোয়ামোছা শুরু হয়। অন্য সময় খোঁজখবর থাকে না। তাই শহীদদের স্মৃতিকে ‘আসছি’ বলে এক বছরের জন্য চলে যাওয়া ঠিক নয়। শহীদ মিনারের প্রতি টিকে থাকুক ভালবাসা। শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন বা শুধু মাত্র ফেব্রুয়ারি মাসটুকুতে নয়, সারা বছর জুড়ে। শহীদ মিনার এবং ভাষা সৈনিকদের প্রতি যদি যথাযথ সন্মান ও ভালবাসা দেখাতে না পারি, তবে কবি সুভাষ মুখাপাধ্যায়ের মতে আমাদের শুধু ‘চলে’ই যাওয়াই হবে। চলে যেয়ে ফিরে আর ‘আসা’ হবে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট