চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা আলী রজা ওরফে কানুফকিরের প্রতিবাদী ভূমিকা

শামসুল আরেফীন

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৮:২৩ অপরাহ্ণ

এক সময় বলা হতো, বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করলে রৌরব নামক ভয়ানক নরক-বাস করতে হবে। তারপরও এ-ভাষায় সাহিত্যচর্চা চলেছে। হিন্দুসমাজের লোকজন এ-ক্ষেত্রে কবি ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলমানরা বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে অনেক-অনেককাল পর। আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে শাহ মুহম্মদ সগীর নামক এক কবি ইউসুফ-জোলেখা নামক কাব্য রচনা করেন, এমন তথ্য রয়েছে১। কাব্যটি পাওয়াও গেছে। “খ্রীস্ট্রীয় পঞ্চদশ শতাব্দী হইতে অর্থাৎ হোসেন শাহের রাজত্বকাল হইতে বাঙ্গালার স্বাধীন মুসলমান সুলতানগণ দেশীয় ভাষায় অনুরাগী হইয়া পড়িয়াছিলেন। বিদ্যাপতির কবিতায়, বৈষ্ণবদের সাহিত্যে, প্রাচীন মনসামঙ্গল গ্রন্থে, প্রাচীন মহাভারত ও রামায়ণ পুস্তকে এই যুগের মুসলমান নরপতীগণের বঙ্গসাহিত্য প্রীতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ আছে। তাহা …রায়বাহাদুর ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয়ের বঙ্গভাষা ও সহিত্য নামক গ্রন্থে বিশেষভাবে দেখিতে পাইবেন। গৌড়ের সুলতানগণের দেশীয় ভাষানুরাগ ও বঙ্গসাহিত্য প্রীতি এই যুগের বাঙ্গালার মুসলমানের মধ্যেও যে সংক্রমিত হইয়াছিল, তাহা অনুমান করা যাইতে পারে। মুসলমানগণ ধীরে ধীরে এইরূপে পরোক্ষভাবে বঙ্গভাষা সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হইতেছিলেন। খ্রীস্ট্রীয় ষোড়শ শতাব্দী হইতে বাঙ্গালার মুসলমানগণ প্রত্যক্ষভাবে দেশীয় ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করিলেন। … ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধও, বাঙ্গালা সাহিত্য-ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিতান্তই হাতে খড়ির যুগ ছিল না। কেননা ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগের বহরাম দৌলত উজির নামক কবির লায়লী-মজনু নামক গ্রন্থে যেরূপ পাকা বাঙ্গালা রচনার নমুনা পাওয়া যায়, কিছুকাল পূর্ব হইতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের হাত না পাকিলে সাহিত্যে এইরূপ বাঙ্গালার আমদানি করা ও তাহার প্রচলন হওয়া অসম্ভব”২।
মুসলমানরা প্রত্যক্ষভাবে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসার সময়ে ও পূর্বে মুসলমান সমাজে এ-ভাষা হিন্দুয়ানী ভাষা হিসেবে চিহ্নিত ও পরিচিত ছিলো। ষোড়শ শতকে অর্থাৎ মুসলমানরা প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসার সময়ে সাহিত্যাঙ্গনের স্বরূপ ছিল এরকম :
“রামায়ণ, মহাভারত ও ভগবতের অনুবাদ শাখায় শক্তিধর কবিদের আবির্ভাব হচ্ছিল। মঙ্গল-কাব্য ধারায় মনসামঙ্গল, চ-ীমঙ্গল, কালিকামঙ্গল প্রভৃতি রচিত হয়ে পাঁচালিরূপে গাওয়া হচ্ছিল। বৈষ্ণব গীতি-কবিতার ধারাটি কীর্তন মহিমায় অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। শ্রীচৈতন্যের জীবনী ও ধর্মকেন্দ্রিক পঠন-পাঠন চরিত শাখাও কাব্য শ্রেণীতে ভাগ হয়ে বেশ পল্লবিত হচ্ছিল। রামায়ণ মহাভারত কথা ও মঙ্গল গান পাঁচালি পর্যায়ের সাহিত্য…। …বৈষ্ণব গীতি-কবিতা ও চরিত শাখার সন্দর্ভ রচনাগুলো ছাড়া… [সে-সময়কার] সমগ্র এইরূপ পাঁচালি-পর্যায়ের ঢঙে…। আবার বৌদ্ধধর্মীয় মতবাদের মহাযানী শাখাটিও তান্ত্রিকতাকে সহায় করে চর্যাপদের সিদ্ধাচার্যগণের সময় যেভাবে রূপ নিয়েছিল, তার রেশ ধর্ম মঙ্গল ও নাথ সাহিত্যের ক্ষয়িষ্ণু প্রবাহে, আউল-বাউল ও নেড়া সমাবেশে, অনুরূপ পাঁচালি পয়ার পরিবেশনের ধারাতেই অব্যাহত ছিল। আর এই সময় সাহিত্যচর্চায় ও পাঁচালি গানে উচ্চকিত পৌত্তলিক মহিমার ডংকানিনাদ সাধারণ মুসলমানের চিত্তকে প্রভাবিত করেছিল সংক্রামক ব্যাধির মত”৩।
প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্যচর্চায় যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্য থেকে সৈয়দ সুলতানের কথা ধরা যাক। ষোড়শ শতকে তিনি বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক অবদান রাখেন। মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্যচর্চায় তাঁর এগিয়ে আসার হেতু খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর ‘নবীবংশ’ কাব্যে।
কতদেশে কতভাষে কোরানের কথা
দ্বীন মোহাম্মদী বুঝি দেয়স্থ ব্যবস্থা।
কর্মদোষে বঙ্গেত বাঙ্গালী উৎপন্ন
না বুঝে বাঙ্গালী সবে আরবী বচন।
আপন দ্বীনের বোল এক না বুঝিল
পশুর চরিত্র হই সে সব রহিল।
সদায় পড়য় রামকৃষ্ণের কথা
শুনিয়া আমার মনে লাগে অতি ব্যথা।
ফারসী ভাষায় কোরানের বাখান শুনিল
যত খোরাশানী সবে ঈমান আনিল।
হাওয়া (জাভা) সব জাওয়া ভাষে আরবী বচন
কিতাবের কথা যত কৈল উদ্ধারণ।
রুমী সবে রুম ভাষে কোরানের কথা
লোক সবে লিখি লই করেন্ত ব্যবস্থা।
তুর্কীস্থানে তুর্কীভাষে লোক আপনার
কোরানের কথা সব লিক্ষি লইলা সার।
সামী সবে সামীভাষে কোরানের মর্ম
শুনিয়া করিতে আছে মুসলমানী কর্ম।
পাঠান সকলে পোস্ত ভাষে আপনার
কোরানের কথা শুনি বুঝিল আচার।
এত ভাবি নবীবংশ পাচালি রচিলু
বোঝে হেন মত করি যা কিছু কহিলু।
ষোড়শ শতকে প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্যচর্চায় মুসলমানদের এগিয়ে আসার এক ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি হলেও, রক্ষণশীল মুসলমানরা তা ভাল চোখে দেখেনি। তারা কঠোর নিন্দা ও সমালোচনায় লিপ্ত হয়। সৈয়দ সুলতানদের সহ্য করতে হয়। সৈয়দ সুলতান লিখেছেন :
যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পাঁচালী রচিলাম করি আছএ দুষিতে।
মুনাফিকে বলে আহ্মি কিতাবেতু কাড়ি
কিতাবের কথা দিলুঁ হিন্দুয়ানী করি।
… … …
আলিমে কিতাব পড়ি বাখানে যে কালে
হিন্দুয়ানী করি যদি না বাখানি বোলে।
বঙ্গদেশী সকলেরে কিরূপে বুঝাইব?
বাখানি আরব ভাষা এ বুঝাইতে নারিব।
যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন।
সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।
আল্লাএ বুলিছে, ‘মুঞি যে দেশে যে ভাষ
সে দেশে সে ভাষে কৈলুঁ রসুল প্রকাশ’।
সৈয়দ সুলতান৪ প্রমুখের পরবর্তীতে আরো অনেক মুসলমান সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসেন। তাঁদেরকেও সইতে হয় নিন্দা ও সমালোচনা। এসময় সন্দ্বিপ-নিবাসী কবি আবদুল হাকিম ক্ষুব্ধ হয়ে ‘নূর-নামা’ কাব্যে লিখেন :
যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥
মাতা পিতামহক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না যুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে না যায় ॥
আঠারো শতকের মধ্যকালের পরেও বাংলা ভাষায় মুসলমানদের সাহিত্যচর্চায় বা সাধনায় এগিয়ে আসার ব্যাপারে রক্ষণশীল মুসলমানদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়নি। সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত মুসলমানদের কেন্দ্র করে চলতে থাকে তাদের ঠাট্টা, বিদ্রƒপ, নিন্দা ও সমালোচনা। এ-সময় ষোড়শ শতকের সৈয়দ সুলতান ও সপ্তদশ শতকের আবদুল হাকিমের মতো আলী রজা ওরফে কানুফকির এ-অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উচ্চারণ করেন :
বাংলাদেশের মাজে বাংলার বচন।
হিন্দুয়ানী শাস্ত্রের কথা জানে সর্বজন ॥
নানা দেশের নানা ভাষা আল্লার সৃজন।
সর্ব ভাষা শুদ্দ বুজে এক নিরঞ্জন ॥
নানা দেশে নানা ভাষা নানা শাস্ত্রে কহয়।
দেশি ভাসে প্রভূ সেবা ইশ্বর সদয় ॥
যে প-িতে না বুজিছে সর্ব্ব শাস্ত্র ভাষ।
সে সকলে অন্য শাস্ত্র করে উপহাস ॥৫
বাংলায় সাহিত্যচর্চায় মুসলমানদের অবদান, আগ্রহ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং বিরুদ্ধবাদীদের স্থায়ীভাবে দমনের সংকল্পেÑ আরবি ও ফারসি ভাষা উত্তমভাবে জানা থাকা সত্ত্বেও আলী রজা নিজের সাহিত্যচর্চাও দেদারসে চালিয়ে যান মাতৃভাষা বাংলায়। জীবনের শেষ নিশ্বাস অব্দি রচনা করেন একের পর এক কাব্য বা পুথি। উল্লেখযোগ্য দুটো পুথিÑ ‘আগম’ ও ‘জ্ঞানসাগর’। বস্তুত দুটো পুথিই ‘আগম’ নামক পুথির দুই ভাগ। ‘আগম’-এর অংশবিশেষ :
শরীয়ৎ মারফৎ এ চারি প্রকার
চারিদিকে চারি ডাল বৃক্ষ এক সার।
চারি মত শাস্ত্র এক ঈশ্বর চিনিতে
শহরেত চারি পন্থ নৃপতি চলিতে।
শরীয়ৎ সার মাত্র আগম তুলনা
শরীয়ৎ ব্যক্ত যুক্ত, আগম গোপনা।
মারফৎ যে হএ আগম বলি তারে
আগমে নিগমে লুকি আছি করতারে।
শরীয়তে চলিয়া চলিয়া আগমে দিকে লুক
নির্গম স্থানেত বসি করেন্ত কৌতুক।
আগমেত কহে বাণী নির্গমেত ঠাঁই
যোগী সবে চিনে আল্লা নির্গমেত যাই।
আগমে প্রভুর লীলা নিগমেত থাকে
ফকির সকলে প্রভু তথা গিয়ে দেখে।
আগমেত প্রভুর গোপত বৃন্দাবন
সে আগম ভাষা কহি শুন বুধগণ।৬
আঠারো শতকের মধ্যভাগের পরে ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আলী রজার প্রতিবাদী ভূমিকা, লক্ষ্য ও সংকল্প তাঁকে অনেকের শ্রদ্ধার পাত্রে ও প্রিয় কবিতে পরিণত করেছে।

টীকা
১. ড. আনোয়ারুল করিম : বাংলাদেশের বাউল : সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত, পৃষ্ঠা ২০৩
২. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ : নির্বাচিত রচনা, সম্পাদনা ভূঁইয়া ইকবাল, বাংলা একাডেমি, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ১৬৮
৩. মুহম্মদ আসাদ্দর আলী : মহাকবি সৈয়দ সুলতান, অক্টোবর ১৯৯০, পৃষ্ঠা ২৭-২৮
৪. ‘ফারসিতে উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রণয়নের রেওয়াজ ছিল [সৈয়দ সুলতানের] পরিবার ও সমাজে, কিন্তু মাতৃভাষায় নবী-কাহিনী রচনা করে… দুঃসাহস করেছিলেন কবি’। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭
৫. শামসুল আরেফীন : আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকির (প্রবন্ধ), চরাচর (সম্পাদক দিলীপ দাশ), এপ্রিল ২০০৮
৬. আহমদ শরীফ : বাঙলার সূফী সাহিত্য, সময় প্রকাশন, জুলাই ২০০৩, পৃষ্ঠা ২০৭

লেখক হ লোকগবেষক ও কবি, জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট