চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

ভাষা আন্দোলন ও আরেক ফাল্গুন

চৌধুরী শাহজাহান

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৭:৩৫ অপরাহ্ণ

বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের একটি প্রধান ঘটনা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর এই ধরনের আন্দোলন আমাদের দেশে আরো কিছু হয়েছে। চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্ন সালে সামরিক শাসন, বাষট্টি সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মূলত বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তারই পরিণতি আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে। মাতৃভাষা বাংলার জন্যে বিক্ষোভ-আন্দোলন ও প্রাণদান পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে ঘটনা ঘটেছিল তা প্রতিটি বাঙালি হৃদয়কেই রক্তাক্ত করে। দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিক্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে পাকিস্থান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে।
পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম অবজ্ঞা পোষণ করে সেদিন বাঙালির হাতে যে নতুন শিকল পরানো হয় তার পরিণাম হয় মারাত্মক। পাকিস্থানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালিপ্সু, উদ্ধত শাসকরা শুরু থেকে এদেশের মানুষের উপর অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালাতে থাকে। প্রথমেই তারা ফন্দিআঁটে কিভাবে এদেশের সাধারণ গণ-মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেওয়া যায়। পূর্ব বাংলার মানুষকে তাঁবেদার করে বশে রাখার জন্য তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালিদের ঘাড়ে পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার নীল নকশা রচনা করে। পাকিস্থানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক সমাবেশে ঘোষণা করেনÑ ’টৎফঁ ধহফ টৎফঁ ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ.’ কিন্তু এদেশের দামাল ছাত্র-যুবকরা সে সমাবেশেই ‘ ঘড়,ঘড়. ওঃ পধহ’ঃ নব.’ধ্বনি তুলে তার সে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণার সমুচিত জবাব দেয়। প্রতিবাদের ভাষা ও এর ব্যাপকতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি সরকার সকল প্রতিবাদকে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের চেষ্টা চালায়। তাদের একপেশে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামে লিপ্ত হয় এদেশের আপামর মানুষ। এদেশের দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করে। পূর্ব বাংলায় সর্বত্র উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের। আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায় এদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ। একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রতিবাদ সভা এবং মিছিল হবে তা আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্যে সরকার একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা আইন জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা গোপন বৈঠক করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যেমন করে হোক তারা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করবেই। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আহূত হয় ছাত্রদের প্রতিবাদ সমাবেশ। সমাবেশ শেষে তারা মিছিল বের করে। সেদিন ছাত্র সমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠে ধ্বনিত হয় স্বাধিকারের দাবি। প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসেছিলো সে সময়। ভাষার দাবিতে সোচ্চার মিছিলটি এগিয়ে যায় প্রাদেশিক ভবনের দিকে। মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের ফলে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিউর প্রমুখ দামাল ছেলেরা। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে লিখে যায় এক অনন্য ইতিহাস। তাঁদের নিঃসৃত রক্তে সেদিন লেখা হয়ে যায় পূর্ব বাংলার অমোঘ ভাগ্যলিপি। তাঁদের এ মহান আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। বাঙালির সংস্কৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকে সেই দিন, সেইদিনের রাজপথ, সেই ফুলার রোড।
এই পথ, পীচ ঢালা এ কাল পথ
লিখে দিল এক ইতিহাস
বুকের রক্ত দিয়ে জীবনের শেষ ক্ষণে
গেয়ে গেল তারা এ গান
আমার মুখের ভাষা,আমার সে প্রাণ।
১৯৫৩ সাল থেকে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি একটি মহান জাতীয় দিবস হিসেবে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান) এবং দেশের বাইরে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অন্যত্র যেখানে যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালি রয়েছে সেখানে উদযাপিত হয়ে আসছে।
১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর আরেকটি বিজয়ের দিন। ঐদিন প্যারিস বৈঠকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক শাখা ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘের ১৮৮ দেশের সদস্য দেশসহ অনাগত দেশ প্রতিবছর এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত করে। এ সিদ্ধান্ত প্রতিটি বাঙালির মুখকে উজ্জ্বল করে তোলে।
একুশকে নিয়ে আমাদের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভাবনার অন্ত নেই। তাই একুশকে নিয়ে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র ধারার সাহিত্যÑএকুশের সাহিত্য। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, নকশা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদির মাধ্যমে একুশের চেতনা বিকশিত হয় সুচারুভাবে। তাই বলা যায়, একুশ আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি আঙ্গিনাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে। একুশকে নিয়ে প্রথম উপন্যাস লেখেন জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭১)। তাঁর উপন্যাসের নাম ‘আরেক ফাল্গুন’ (১৯৬৮)। এরপর একুশের এই গৌরবময় অধ্যায়কে নিয়ে আরো কিছু উল্ল্খেযোগ্য উপন্যাস রচিত হয়। তাঁদের মধ্যে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের (জন্ম ১৯৪৭) ‘যাপিত জীবন’ (১৯৮১), ’ নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ (১৯৮৫), শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) ‘আর্তনাদ’ (১৯৮৫), মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালের (জন্ম ১৯৩২) ‘আলো আমার আলো’ (১৯৯০), আহমেদ মাওলার (১৯৭১) ‘আগুন ঝড়া ফাগুন দিনে’ (২০১৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে একটি সুপরিচিত নাম। বাংলােেদশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও তাঁর খ্যাতি কম নয়। বলা হয়ে থাকে, এদেশের চলচ্চিত্রের তিনিই প্রথম সফল নির্মাতা। তিনি ১৯৩৩ সালে ফেনী জেলার মধুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের সহযোগিতায় জহির রায়হান ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৩-১৯৫৪ সালের দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা মনি সিংহের দেওয়া রাজনৈতিক নাম ‘রায়হান’ গ্রহণ করেন ।
পারিবারিক নাম মোঃ জহির উল্লাহ’র সংগে রাজনৈতিক নামটি যুক্ত হয়ে সকলের কাছে পরিচিত হলেন জহির রায়হান হিসেবে। ১৯৫৬ সালে কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত ‘প্রবাহ’ পত্রিকার জহির রায়হান ছিলেন সহকারি সম্পাদক। এছাড়াও কবি আহসান হাবীবের সংগে ছিলো তাঁর একান্ত অন্তরঙ্গতা। কলকাতায় চলচ্চিত্র বিষয়ক পড়াশুনার সূত্রে তিনি ফটোগ্রাফিক স্কুলের শিক্ষক প্রমথেশ বড়–য়ার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পান। এরপর ১৯৫৬ সালে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক এ, জে কাদারের সংগে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। এভাবে রাজনীতি, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের সৃজনী চৈতন্য হয়ে উঠেছিলো পরস্পর সম্পূরক ও পরিপূরক। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটের ভেতর দিয়ে জহির রায়হানের কৈশোরকাল অতিবাহিত হয়।
অন্যদিকে অগ্রজ ছাত্রনেতা শহীদুল্লাহ কায়সারের নিবিড় সাহচর্যে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নির্দ্বিধায়। ফলে, জীবনের শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছে রাজনৈতিক সচেতনতা। এই সচেতনাই তাকে বিভিন্ন আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছে। ১৯৪৫ সালে ‘ভিয়েতনাম দিবস’ এর মিছিলে যোগ দিয়ে জহির রায়হান পুলিশী নির্যাতনে হয়েছেন আহত। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মিছিলেও তাঁর কন্ঠ ছিলো শ্লোগাানমুখর। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় বাঙালিরা অবাঞ্জিত, অবহেলিত ও নিগৃহীত হয়। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালিরা হলেন বঞ্চিত। ১৯৪৮ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার পর বাঙালি যুব সমাজ ও আপামর জণ সাধারণ হয়ে উঠলেন প্রতিবাতী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে রক্ত দানের মাধ্যমে শোষিত অবহেলিত বাঙালিরা ঐক্যবোধে হলো সুসংগঠিত। রক্ত¯œাত ভাষা আন্দোলনে জহির রায়হান যোগ দেন একজন সক্রিয় ও সাহসী কর্মী হিসেবে। তখন তিনি ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। তিনি ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় জহির রায়হান কারাবরণ করেন। একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ প্রভৃতি নিষিদ্ধ করে তৎকালীন পাকিস্থানি সরকার ১৪৪ ধারা চালু করেছিলো। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে ২০ জন করে যে খন্ড মিছিল বিশ্ববিদ্যালয থেকে বের হতে থাকে, জহির রায়হান ছিলেন তার প্রথম দশজনের একজন। ১৯৫৫ সালে একুশে উদ্যাপনের সময় তাঁকে আবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫৫ সালে শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি, সরকারি বাধা ইত্যাদি অবরুদ্ধতাকে কেন্দ্র করে ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের পটভুমি রচিত।
জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের কাহিনী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কাহিনীর স্থিতিকাল মাত্র তিন দিন দুই রাত। প্রথম দিনের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কাহিনীর সূচনা। প্রথম দিন, রাত এবং দ্বিতীয় দিন ও রাত ধরে চলেছে একুশ পালনের বিরামহীন প্রস্তুতি। তৃতীয় দিন কাহিনীর চূড়ান্তকাল। মিছিল এবং পুলিশের সংঘর্ষের মাধ্যমে অতিক্রান্ত হয়েছে এ চূড়ান্ত কালটি। অতঃপর দিনের শেষে কারা তোরণ প্রাঙ্গণে কাহিনীর পরিসমাপ্তি। সেই জন্য কাহিনীর ব্যাপ্তিকাল সীমিত। কিছু ঘটনা ও উদঘটনায় বিস্তৃত উপন্যাসের কলেবর।
সিপাহী বিদ্রোহের নির্মম স্মৃতি বিজড়িত ভিক্টোরিয়া পার্কের বর্ণনা দিয়ে ঔপন্যাসিক উপন্যাসের কাহিনীর সূচনা করেন। “সকালে কুয়াশায় ঢাকা পড়েছিলো পুরো আকাশটা। আকাশের অনেক নিচু দিয়ে মন্থর গতিতে ভেসে চলেছিলো এক টুকরো মেঘ। উত্তর থেকে দক্ষিণ-রঙ তার অনেকটা জমাট কুয়াশার মতো দেখতে। ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে ঠিক সেই মেঘের মতো একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেল নবাবপুরের দিকে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পরনে তার সদ্য ধোয়ান সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, পা-জোড়া খালি। জুতো নেই।”
এই ছেলেটিই ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের নায়ক মুনিম। মুনিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা। সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিময়তা এই উপন্যাসের সূচনাকে করেছে তাৎপর্যময় এবং বর্ণনায় প্রকৃতির পরিচর্যা কাহিনীকে করেছে সংকেতময়। মেঘের গতি উত্তর থেকে দক্ষিণে আর মুনিমের গতি দক্ষিণ থেকে উত্তরে। বর্ণনার এই সংকেতময় ইংগিতটি শৈল্পিক। উপন্যাসের শেষাংশে বর্ণনায় এই ইংগিত আরো সম্ভাবনাময় ও সুদূরপ্রসারী বলে মনে হয়েছে। যেমনÑ
“নাম ডেকে ডেকে তখন একজন একজন করে ছেলেমেয়েদের ঢোকানো হচ্ছিলো জেলখানার ভেতরে। নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। এক সময় বিরক্তির সাথে বললেন, উহ অত ছেলেকে জায়গা দেবো কোথায়? জেলখানাতো এমনি ভর্তি হয়ে আছে।ওর কথা শুনে কবি রসুল চিৎকার করে উঠলো, জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না। আর একজন বললো, এতেই ঘাবড়ে গেলে নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।”
সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের শহীদ দিবস পালন করতে দিবে না। রাস্তায় শ্লোগান দেওয়া নিষিদ্ধ। মিছিল, শোভাযাত্রা বেআইনী ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু ছাত্ররা বদ্ধপরিকর, তারা যে কোনো মূল্যে শহীদ দিবস পালন করবে। সেজন্য তারা পূর্ব থেকে বিভিন্ন কর্মসূিচ ঘোষণা করেছে। তাদের কর্মসূচির মধ্যে তিনদিন নগ্ন পায়ে চলা, সবাই রোজা রাখা, কালো ব্যাজ ধারণ করে ২১ ফেব্রুয়ারিতে কালো পতাকা উত্তোলন করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ছাত্রদের এই সমস্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নে মুনিম-আসাদ দিন-রাত কাজ করে যায়। পোস্টার ও লিফলেট ছাপানো, কালো ব্যাজ বিতরণ, কালো পতাকা উত্তোলন, শ্লোগান ও অন্যান্য সাংগঠনিক কর্মকান্ডে মুনিমের সক্রিয়তা বিরামহীন। আন্দোলনের সময় মুনিমকে নগ্ন পায়ে আসতে হয় দয়িতা ডলির জন্মদিনের উৎসবে। ব্যস্ততার কারণে ডলিকে সময় দিতে পারে না মুনিম। আন্দোলনের তেতৃত্ব দিতে গিয়ে মুনিমকে যোগ দিতে হয় বিভিন্ন ছাত্রসভায়। তাই ডলিকে একান্ন সান্নিধ্য দিতে পারে না সিনেমাতে। অভিমানী ডলি তাই রাগে ক্ষোভে তাকে প্রেরণ করে প্রত্যাখানপত্র। মুনিম আহত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে সে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হয় না। এটা তার রাজনৈতিক আদর্শনিষ্ঠা ও কর্তব্য। কিন্তু ডলির প্রতি অবজ্ঞা কিংবা আন্তরিকতাহীন তা কিন্তু নয়। মুনিম ডলিকে বিস্মৃত হয়নি। রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততার আসরে ডলি তার কাছে হয়ে উঠেছে স্মৃতিলোকের মহারাণী।
আন্দোলনে মুনিম একা নয়। সংগ্রামী উদ্দীপনায় এগিয়ে এসেছে সালমা, নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, আসাদ, কবি রসুল, সাহানা প্রমুখ শত শত ছাত্র-ছাত্রী। রাজপথে তাদের আন্দোলন নিষিদ্ধ জেনেও তারা অবলম্বন করে ভিন্ন পথ। অবশেষে ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শহীদ দিবসের উন্মাদনা ও আত্মদানের মহান ব্রত দেখা যায়। সারারাত কেউ ঘুমায় না।
মেডিকেল হোস্টেল, মুসলিম হল, চামেলি হাউজ, ইডেন হোস্টেল, ফজলুল হক হল ইত্যাদি হলের ছাত্র-ছাত্রীরা অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সারারাত জেগে রইলো। কেউ কেউ জটলা বেঁধে কোরাস গান ধরলো ‘ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি’। ফজলুল হক হলের সামনের মাঠে কাগজ দিয়ে ছাত্ররা স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুললো। ১৯৫২ সালেও মেডিকেল হোস্টেলের ব্যারাকের সামনে তারা রাতারাতি শহীদ মিনার তৈরী করে রেখেছিলো। কয়েকদিন পর পুলিশ এসে সে মিনার ভেঙ্গে দিলো। তারপর ছাত্ররা কঞ্চি দিয়ে সেই নির্দিষ্ট স্থানটি ঘেরাও করে রেখেছিলো। এখানেও মেডিকেলের ছাত্ররা কাপড় দিযে ঢেকে দিয়েছে। অবশেষে কালো পতাকা উত্তোলিত হলো। ছাত্রদের শ্লোগান ও ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশ লাঠিচার্জ করলো; এরপর মেডিকেল ব্যারাক ঘেরাও করে ছাত্রদের বেধড়ক মারধর করলো। পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর সকাল ১০ টার দিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জমায়েত হতে লাগলো এবং সেখানে কালো পতাকা উত্তোলন হলো। এখানেও পুলিশ গুলি চালায়, অনেক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয় আবার অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। প্রিজন ভ্যানে উঠে ছাত্র-ছাত্রীরা শ্লোগান দিতে থাকেÑ‘শহীদের খুন ভুলবো না, বরকতের খুন ভুলবো না’; ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। এভাবে প্রায় আড়াইশ’র মতো ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
উপন্যাসের তৃতীয় দিনে চূড়ান্ত ঘটনাংশে পূর্বের তুলনায় মুনিমকে ততোটা সক্রিয় মনে হয়ন্।ি এ অংশে মুনিম অপেক্ষা আসাদ অধিক সক্রিয়। মিছিলে পুলিশের সংঘর্ষে মুনিম আহত হয়। গ্রেফতার হয়ে অপেক্ষা করে কারাগারের প্রাঙ্গণে। অতঃপর ডলি আর সাহানার আকস্মিক আবির্ভাবে বেদনাবিহ্বল মুনিম হয়ে ওঠে আনন্দে উদ্বেল। ডলি এক মুঠো ফুল নিবেদন করে মুনিমকে। ডলির বিচ্ছেদ বেদনার পরিবর্তে কারাবাসী মুনিম বরং আনন্দবোধ করে। “মুনিম মৃদু গলায় বললো,হয়তো দীর্ঘদিন তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না ডলি। ডলি চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে। স্বল্প অন্ধকারেও মুনিম দেখলো, ডলির চোখজোড়া পানিতে ছল ছল করছে। আনন্দে মনটা নেচেছিলো বারবার। আর সে শুধু চেয়ে দেখছিলো ডলিকে। ডলির এমন রুপ আর কোনদিন চোখে পড়েনি মুনিমের।”
উপন্যাসের কাহিনী বিস্তারে আপোসহীন ছাত্রনেতা হিসেবে মুনিম ও আসাদের চরিত্র উজ্জ্বল। মুনিম পিতৃহীন, দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান। মায়ের ¯েœহ-ভালোবাসা ও আপত্তি, সংসারের টানাপড়নে কিংবা প্রবল আন্দোলনের সময়ে প্রেমাস্পদ ডলি’র প্রত্যাখান কোনো কিছুই আন্দোলনের গতিধারা থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তাই মুনিম চরিত্রে রাজনৈতিক আদর্শনিষ্ঠা ও প্রণয়নিষ্ঠা উভয়ই সমান্তরাল গতিতে প্রবহমান। অন্যদিকে আসাদও একজন একনিষ্ঠ বিপ্লবী ছাত্র-কর্মী। পিতার গালিগালাজ ও আর্থিক অসহযোগিতা তাকে আন্দোলনের মাঠ থেকে স্থানচ্যুত করতে পারেনি। রাজনৈতিক ক্রিয়া-কর্মে সে নিজেকে সারাক্ষণ সক্রিয় রেখেছে। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ থেকে শুরু করে কালো ব্যাজ ও কালো পতাকা বিতরণ ইত্যাদি কাজেও সে ছিলো কøান্তিহীন। উপন্যাসের শেষের দিকে আসাদকে বেশ সক্রিয় মনে হয়। পুলিশের প্রবল বাধার মুখে ছেলেরা যখন ছত্রভঙ্গ তখন চিৎকার দিয়ে প্রতিরোধের জোর আহ্বান জানিয়েছে আসাদ ছাত্রদেরকে। বায়ান্ন সালের মতোই সর্বাগ্রে যেন পুলিশের নির্যাতন সহ্য করে বন্দী হয়েছে। মামলার কোমল স্পর্শে আসাদের হৃদয় হয়েছে উদ্বেলিত। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সালমার বাসায় আশ্রয় নেয় আসাদ। শীতের গভীর রাতে জ্বলন্ত স্টোভের পাশে বসে আসাদ ও সালমা।
“আসাদ বললো, সত্যি ভীষণ শীত পড়ছে। হাতজোড়া বরফের মতো ঠা-া হয়ে গেছে’ দেখুন বলে, হাত দুটো ওর দিকে এগিয়ে দিলো আসাদ। অন্ধকারে মৃদু হাসলো সালমা। হাত বাড়িয়ে ওর হাতের তাপ অনুভব করতে গেলে হাতজোড়া আলতো ধরে রাখলো আসাদ।”
ডলি বিত্তশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। ছাত্রনেতা মুনিমের প্রেমিকা। ডলি যতটা ব্যক্তি মুনিমের ভক্ত, তার আদর্শের প্রতি ততোটা বিরক্ত। ডলির জন্মদিনের উৎসবে শহীদ স্মৃতির সম্মানে নগ্নপদ যাত্রী মুনিমের উপস্থিতিতে ডলি বিব্রতবোধ করে। এই বিব্রতবোধের কারণ মুনিম নিজে না, তার নগ্নপদযুগল। ডলি’র উচ্চারণ, “এমন করে আমাকে অপমান করতে চাও কেন শুনি।” এরপর ডলি মুনিমকে তার বাবার স্যান্ডেল পরতে পরামর্শ দেয়। মুনিম কারো সামনে বিব্রত হোক, উপহাসের পাত্র হোক ডলি তা চায় না। প্রবল ব্যস্ততার কারণে ডলিকে সময় দিতে পারে না মুনিম। তাই ডলি হয়ে ওঠে বিক্ষুব্ধ। এই অভিমানী ডলি মুনিমের উপহার সামগ্রী ফেরত দিয়ে প্রেরণ করে রিফিউজ লেটার। এত অল্প সময়ের মধ্যে বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিফিউজ করা সত্যিই ভাবিয়ে তুলে পাঠককে। এরপর ডলি গ্রহণ করে বজলকে। বজলের সংগে সর্বত্র তার অবাধ বিচরণ। মুনিম থেকে বজলকে ডলি বেশী ভালোবাসে তা কিন্তু নয়; এটা ডলির অভিমানী হৃদয়ের বিশেষ খেয়াল। এক সময় বজলের কপটতা ও মিথ্যাচারীতা ডলি বুঝতে পারে। অবশেষে ডলি ফিরে আসে মুনিমের কাছে। কারাযাত্রী মুনিমকে একগুচ্ছ পুস্পার্ঘ দিয়ে বরণ করে ডলি। সালমা মেডিকেলের ছাত্রী, কারারুদ্ধ বিপ্লবী, রওশনের স্ত্রী। সে আন্দোলনে কঠোর, হৃদয়বীর্য কোমল। রওশন সালমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। সালমা তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলো। ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলনে স্বামী হয়েছে কারারুদ্ধ। কারারুদ্ধ হয়েছে তার ছোট বোন ও ভাই। রাজশাহী জেলে গুলি করলে স্বামী রওশন হারায় দু’টি হাত। প্রণয়দগ্ধ, বেদনাদগ্ধ সালমা তাই হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের একজন নির্ভীক আন্দোলন কর্মী। স্বামী রওশনের খ-িত হাত কখনো শ্লোগানে উত্তেজিত হবে না, নিবিড় আলিঙ্গনে সালমাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করবে নাÑএকথা ভাবতে গেলেই সালমার হৃদয় মুচড়ে ওঠে। স্বামীর কারামুক্তির সম্ভাবনাও অনিশ্চিত। অভিভাবক হিসেবে সালমার চাচা বিবাহ বিচ্ছেদের পরামর্শ দিলে সালমা তাতে রাজী হয় না।
অন্যদিকে, রওশনের চিঠিতেও অনুকূল সাড়া আসে না। এই দো-টানা পরিস্থিতিতে সালমা নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং হয়ে ওঠে স্বামী আদর্শচারী। তার চরিত্রের এই দৃঢ চেতনাই তার ভালোবাসার খাটিত্ব প্রমাণিত হয়। আসাদকে সালমার ভালো লাগার একটা কারণ হচ্ছে কথা বলতে গেলে হঠাৎ রওশনের মতো মনে হয়, বিশেষ করে ঠোঁট আর চিবুকের অংশটুকু। তবে সালমার এ ভালোলাগার মধ্যে কোনো অনুরাগ নেই, রয়েছে সালমার বিরহদগ্ধ সংবেদনশীল হৃদয়ের সাময়িক বিভ্রম মাত্র।
বজলের প্রিয় বন্ধু মাহমুদ। গোয়েন্দা কর্মী মাহমুদ কবিতা লেখে। মানসিক দিক দিয়ে উভয় বন্ধুর আদর্শ অভিন্ন। তারা দু’জনই সাহিত্যিক ও নারীলিপ্সু। তবে রমণী রমণে মাহমুদের পারদর্শিতা সমধিক। সে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঢালী ক্লার্কের মেয়ে সালেহাকে আবার বিয়ে করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে সাহানাকে। এই প্রতিশ্রুতি আর অঙ্গীকার করে দু’টি মেয়েকেই করেছে সে কলংকিত ও কলুষিত। যার ফলশ্রুতিতে সালেহা করেছে আত্মহনন আর সাহানা হয়েছে প্রত্যাখ্যাত। ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামী চেতনার পাশাপাশি সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতাদের মতো মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকাপুষ্ট ছাত্র-ছাত্রী স্বার্থান্ধ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কথা জহির রায়হান অকপটে বর্ণনা করেছেন সুনিপুণভাবে। প্রসঙ্গক্রমে বজলের একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়।
“আমরা হলাম সাহিত্যিক। সমাজের আর দশটা লোক, মিছিল আর শোভাযাত্রা বের করে পুলিশের লাঠি খেয়ে প্রাণ দিলে কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমাদের মৃত্যু মানে দেশের এক একটি প্রতিভার মৃত্যু।” বজলের এই স্বার্থপর উক্তি থেকেই বুঝা যায়, সমাজ বা রাষ্ট্রে তার অবস্থান কোথায় ? জহির রায়হানের জীবন দৃষ্টি রোমান্টিক। ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে এই রোমান্টিক দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তিনি সফলভাবে। রাজনৈতিক পটভূমিতে এটি রচিত হলেও প্রণয় উপেক্ষিত নয়। ডলি মুনিমের প্রেমানুভূতি আর সালমা ও রওশনের অকৃত্রিম হৃদয়ানুভূতিই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উপন্যাসের মূল কাহিনীর সংগে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য উপ-কাহিনী। প্লট সংগঠনে লেখকের নৈপুণ্য সর্বত্র রক্ষিত হয়নি। চরিত্র অনুসারে ভাষা ব্যবহারে লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সর্বোপরি, বর্ণনার আবেগের সংগে ঘটনার প্রবহমানতা একাত্ম করে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের তথা একুশের প্রথম উপন্যাস রচনা করে স্বরণীয় হয়ে আছেন।

লেখক হ কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট