চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

আজ স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উড়ে

নিজাম উদ্দিন লাভলু, রামগড়

৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ

৭১’র আজ (৮ ডিসেম্বর)) এ দিনে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দীর্ঘ ৭ মাস ৬ দিন পর রামগড়ের মাটিতে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। শত্রুমুক্ত হয় বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ ঘাঁটি। মহান মুক্তিযুদ্ধে রামগড়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেসময় খাগড়াছড়ি ছিল রামগড় মহকুমার মহালছড়ি থানাধীন একটি ইউনিয়ন মাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার পর ১৬ মার্চ আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে মহকুমা শহর রামগড়ে ব্যাপকভাবে শুরু অসহযোগ আন্দোলন। ২৫ মার্চের পর চট্টগ্রামের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, অভিনেত্রীসহ সামাজিক নেতৃবৃন্দ রামগড় আসতে শুরু করেন। আসেন মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরবর্তীতে মেজর ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন সামরিক অফিসার। মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে রামগড় হাইস্কুল মাঠে খোলা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুক্তিফৌজের সর্বপ্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এ রামগড়েই খোলা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান আহমেদের (মরহুম) নেতৃত্বে শতশত মুক্তিকামী তরুণ, যুবক সকলেই দেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। একদিকে পাক সরকার বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন চলে, অন্যদিকে রামগড়কে শত্রুমুক্ত রাখতে বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি বসিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। রাঙামাটি পতনের পর ১৩ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সদর সেখান থেকে স্থানান্তরিত করে নিয়ে আসা হয় রামগড়ে। রামগড়ে এসে তৎকালীন জেলা প্রশাসক (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা) এইচ টি ইমাম স্বাধীন বাংলা সরকারের অধীনে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেন। এরমধ্যে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী প্রভৃতি এলাকা থেকে হাজার হাজার বাস্তুহারা মানুষ ভারতে পাড়ি জমাতে রামগড়ে আসতে শুরু করেন। জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম এসব বাস্তুহারা মানুষের খাবার-দাবারের জন্য লঙ্গর খানা খুলেন। ফেনী নদীর ওপর কাঠের সেতু নির্মাণ করে ভারতে আনা হয় অস্ত্র গোলাবারুদসহ বিভিন্ন সমরাস্ত্র। এসব অস্ত্রশস্ত্র রামগড় থেকে চাঁদের গাড়ি করে পাঠানো হয় চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে। ২৭ এপ্রিল মহালছড়িতে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর মিজো ও চাকমা মুজাহিদদের সাথে এক প্রচ- যুদ্ধে শহীদ হন অকুতোভয় তরুণ সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের বীর উত্তম। রামগড়ের মাটিতে সমাহিত করা হয় এ বীর শহীদকে। ২ মে ভোরবেলায় ভারী কামান ও শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চারিদিক থেকে রামগড় ঘাঁটির ওপর হামলা চালায় পাকবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কিন্তু শত্রুপক্ষের বিপুল সৈন্যসংখ্যা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধারা। বিকেল ৫টার দিকে পাকবাহিনী পুরো রামগড় দখল করে নেয়। পতন হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা খ-ের মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে শক্তঘাঁটির। রামগড় পতনের পর সেক্টর-১ এর হেডকোয়ার্টার পুনঃস্থাপন করা হয় সীমান্তের ওপারের ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমার হরিনায়। এর আওতায় সাব্রুমের অম্পি নগর, বগাফা, পালাটনা, হরিনা প্রভৃতি স্থানে স্থাপিত ট্রেনিং সেন্টারে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। সেক্টর-১ এর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) তত্ত্বাবধান করেন এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের। শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে রামগড়ের মাটিতে আবার স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানোর দৃপ্ত শপথ নিয়ে সাব্রুমের ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নেয় ১২ বছরের বালক থেকে ৫০ বছরের প্রৌঢ় সবাই। প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারীদের নিয়ে গঠন করা হয় পৃথক পৃথক যোদ্ধা গ্রুপ। রামগড়ের এসব অগ্নিতরুণ যুবকযোদ্ধারা প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে শুরু করেন মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ। রামগড়ের শত্রুঘাঁটির ওপর তারা প্রায়ই গেরিলা হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে পাক বাহিনীর। ৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ে দখলদার বাহিনীর অবস্থানগুলোর ওপর প্রবল বোমা বর্ষণ করে। প্রায় সাত মিনিট বোমা হামলা শেষে বিমান তিনটি ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে কঠোর আক্রমণ চালায় পাকহানাদারদের ওপর। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শত্রুরা। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত পাকবাহিনীর সৈন্যরা ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে পিছু হটতে শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে আরো দুটি ভারতীয় বিমান পাকঘাঁটির ওপর পাঁচ মিনিট বোমা বর্ষণ করে। বিমান থেকে বোমা হামলা আর স্থলে অকুতোভয় বীরযোদ্ধাদের মরণপণ গেরিলা আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে পাক সেনারা। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা নিজের প্রাণ বাঁচাতে সদলবলে রামগড় থেকে পালাতে শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর বিকেলের আগেই পাক সৈন্যরা সবাই রামগড়ের মাটি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। বিকেল ৪টার দিকে ভারতের সাব্রুমের আশ্রয় শিবির থেকে বিজয় উল্লাসে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশের মাটিতে ছুটে আসে রামগড়ের মানুষ। রামগড় বাজারে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘বিজয়’ ও ইতিহাসগাঁথা ‘ম্যুরাল’

গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা অংশের যুদ্ধ এখান থেকে পরিচালিত হয়। রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্থাপিত ট্রেনিং সেন্টার হতে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের মোকাবেলা করতে ছুটে যান বিভিন্ন অঞ্চলে। দেশের বিভিন্ন এলাকার লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা মানুষ রামগড়-সাব্রুম সীমান্ত হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সমর্থন, সহযোগিতার জন্য সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের সাথে যোগাযোগ সমন্বয় সবকিছুই হয় রামগড় সীমান্ত হয়ে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, সাংবাদিক, অভিনেতা, সামরিক, বেসামরিক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ভারতে যান এ পথ দিয়েই। এ সীমান্ত পথেই মিত্রবাহিনীর গমনাগমন, অস্ত্র, গোলাবারুদ ইত্যাদি যুদ্ধ সরঞ্জাম আনা নেয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর ভারতের ত্রিপুরা থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বাংলাদেশি উদ্বাস্তু রামগড় হয়েই স্বদেশে ফেরেন। সবমিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে রামগড়ের অবদান চির অমর, অক্ষয় ও অবিস্মরণীয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামে রামগড়ের এ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম অক্ষুণœ রাখতে পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র রামগড় লেকপার্কে স্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয়’, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আর ইতিহাসগাঁথা দীর্ঘ প্রাচীর বা দেয়াল। বিশাল লেক, দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত ব্রিজ আর কাঠ বাদাম, পাম ট্রি, বকুল, খেজুর দেবদারু ঘেরা মনোরম প্রকৃতির মাঝে যেন একখন্ড ইতিহাস চত্বর। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ছিয়াশি ফুট দৈর্ঘ্য আর দশ ফুট প্রস্থের বিশাল দেয়ালের গায়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ধারাবাহিক খ- চিত্রের ম্যুরাল। চমৎকার শৈল্পিক কারুকাজে সুনিপুণভাবে তৈরি করা হয়েছে ইতিহাসের প্রতিচ্ছবির ম্যুরালটি। নয়টি ফলকচিত্রে সাজানো হয়েছে ইতিহাসগাঁথা প্রাচীর বা দেয়ালটি। ১৯৫২ সালে বাংলাভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারাভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক বিক্ষোভ মিছিল, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার বীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ঢাকার রাজপথে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিরীহ বাঙালির গণহত্যার নির্মম ছবি, পাকবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা, জ্বালাও পোড়াও, অত্যাচারের মুখে ভারতে আশ্রয় নিতে পলায়নরত অসহায় বাঙালি শরণার্থী, শত্রুবাহিনীর ওপর অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলা, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পর্যদুস্ত পাকসেনাদের আত্মসর্মপণ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভারতীয় জেনারেল আরোরার উপস্থিতিতে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরের ঐতিহাসিক চিত্র এবং বীর বাঙালির বিজয় মিছিলের ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে নান্দনিকভাবে। দেয়ালের একপ্রান্ত থেকে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত সাদা টাইলসে তৈরি বেদীমূলের সিঁড়ি পুরো ম্যুরালের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। পোড়ামাটির আদলে সিমেন্ট সুরকি দিয়ে চমৎকার শিল্পশৈলীতে তৈরি করা হয় এ ম্যুরাল। রঙের কারুকাজও অসাধারণ। ২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে এ ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়।

ম্যুরালের একপ্রান্তের সম্মুখে বিশাল আ¤্রবৃক্ষের ছায়াতলে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয়।’ এক নারী চিকিৎসক অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাসহ চারজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি স্থাপন করে তৈরি করা হয়েছে ‘বিজয়’ ভাস্কর্যটি। সাদা মূর্তিগুলোর পিছনে রয়েছে দীর্ঘ মশাল। প্রখ্যাত স্থাপত্য শিল্পী মৃণাল হক এটি নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যের সম্মুুখে রয়েছে সাদা টাইলসের বৃহদাকারের বেদী। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত ভাস্কর্যটি ২০১২ সালে ২০ মে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এবং ১৯৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এইচ টি ইমাম। রামগড়ের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোপাল চন্দ্র দাস এ ভাস্কর্য নির্মাণে অনন্য ভূমিকা রাখেন। তার উদ্যোগেই ম্যুরালের দক্ষিণ প্রান্তে জাতীয় শহীদ মিনারের ডিজাইনে নির্মাণ করা হয় উপজেলার কেন্দ্রিয় শহীদ।

রামগড়ের বাসিন্দা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকরা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য বিজয়, ইতিহাসগাঁথা দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল ও শহীদ মিনার ঘুরে দেখেন। ইতিহাসের প্রতিচ্ছবির সাথে আপন স্মৃতি জড়িয়ে রাখতে এখানে ছবি তুলতে ভুলেন না কেউ। চত্বরটি সকলের কাছেই এখন অত্যন্ত প্রিয় ও আকষর্ণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট