চট্টগ্রাম শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪

যে কথা না বললেই নয়

ছন্দা দাশ

২০ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

জীবনের চলার পথে কত মানুষের সাথে পরিচিত হই, কতো বিচিত্র মানসিকতার মানুষ দেখি, তাদের মধ্যে থেকে অনেক কিছু যেমন গ্রহণ করি তেমনি নিজেকে তার জায়গায় বসিয়ে বুঝতে পারি কোথায় আমার অযোগ্যতা। অভিজ্ঞতার ঝুলি বাড়তে থাকে, বাড়াতেও চাই। ছোটোবেলায় মা বলতেন, যদি কোন অসৎ মানুষের মুখোমুখি হও তবে তখুনি তাকে এড়িয়ে চলবে। কিছু বলার দরকার নেই। অনেককাল পর্যন্ত তাই করে এসেছি। কিন্তু এতদিন পরে এসে বুঝলাম মা আমাকে যা শিখিয়েছিল তা পুরোপুরি ঠিক না। কারণ এ থেকে সাময়িকভাবে হয়তো আমি নিজেকে মুক্ত করেছি ঠিকই কিন্তু তাকে প্রশ্রয় দিয়ে অসৎ প্রবৃত্তিকে বাড়ার অপ্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করছি। এমন একটা সময় আসবে যেদিন তার আঁচ আমার গায়েও এসে লাগবে। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি রক্ষা পায়? মানুষ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের উচিত যেখানেই অন্যায় দেখবে সেখানেই প্রতিবাদ করা। এ কথাটা নারীদের ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রযোজ্য। এখনও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার থেকে এই শিক্ষা দেওয়া হয় বিনা প্রতিবাদে সহ্য করতে শেখার। যদিও বর্তমানে তার কিছু পরিবর্তন দেখি তা এখনও যথেষ্ট নয়। এর ফলে কিছু দুশ্চরিত্র মানুষ নারীদের নিয়ে যথেচ্ছ বিকৃত রুচির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে দেখেছি মানুষও তাদের সাথে গলা মেলাতে। আরও দুঃখ পাই যখন দেখি এদের সহযোগী অনেক নারীরাও। আমার চেনা একজন নারী যে কিনা একজন গানের শিল্পী ও আবার চাকুরিরতা। দূর্ভাগ্যবশত মহিলা সন্তানহীনা। তাই তিনি খুব বেশি পশু প্রেমিক। এই প্রশংসনীয় চরিত্রই হলো উনার কাল।

মহিলা রাস্তার পশুদের নিজের টাকায় খাবার কিনে খাওয়ান। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান, টিকা দিয়ে আসেন। আমাদের দেশে এমন চরিত্রের মানুষ বিরল। তাও আবার মহিলা একজন। মহিলার মধ্যে প্রতিবাদ করবার একটা ছাপ ¯পষ্ট। যা আমার ভালো লাগায় আলাপ করে বুঝলাম তাঁর মধ্যে ঢাক ঢাক, গুড়গুড় ভাবও অবর্তমান।

অবশ্য তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আমি আগ্রহী নয়। মহিলা রোজ বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই কুকুরদের জন্য খাবার নিয়ে আসেন হাঁটতে। আর উনাকে দেখলেই কুকুরের দল আনন্দে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। খাবারে আগে কিন্তু মুখ দেয় না। এ যেন মানুষের চাইতেও বেশি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের অভ্যস্ত চোখ হঠাৎ বিপরীত কিছু দেখলেই তাকিয়ে দেখে এবং তার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। এই মহিলাও তার থেকে রক্ষা পাবেন কি করে? রোজ আমরা এই মহিলাকে নিয়ে নানা ধরনের মানুষের মন্তব্য শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে কিছু বলার ইচ্ছে হলেও নিজেকে সংযত করি। কারণ এই সমালোচনাকারীদের মধ্যে অনেক তথাকথিত বিজ্ঞ মানুষ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অধ্যাপক, পুলিশ, মৌলভী। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না তাদের সমালোচনা নারী সমাজের যথেচ্ছ স্বাধীনতার কুফল, পর্দা না করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। পশু প্রেমের সাথে নারী স্বাধীনতার কি অন্তরায় তা নিয়ে অনেকবার আমার ইচ্ছে হয়েছে প্রশ্ন করবার। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নীরব দর্শক হয়েই ছিলাম। হঠাৎ একদিন সে মহিলা আমাদের সাথে গল্প করতে গিয়ে বললো ঐ যে ভদ্রলোক গতকাল আমাকে এক প্রস্তাব দিলেন যা শুনে আমি হতবাক। আমি মনে মনে ভাবছি এই হচ্ছে মুখোশধারী পুরুষদের রূপ? যারাই মহিলার বিরুদ্ধে সমালোচনা করছেন পর্দা না করার জন্য তারাই আবার তাকে দিচ্ছে বিকৃত প্রস্তাব! কিন্তু যাদের কোন বক্তব্য নেই তারা এই আচরণের বিরুদ্ধে তারা কিন্তু প্রকৃতই ভদ্রলোক। এই আমাদের সমাজের চিত্র।

একদিন এসব লোকদের আলোচনা যখন চরম আকার ধারণ করলো অকথ্য ভাষায় একজন মহিলার বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। নিজেকে আর সংযত রাখা সম্ভব হলো না। দেখি কয়েকজন মহিলাও জুটেছে ওদের সাথে। দেখি মহিলা আসছে কুকুরের খাবার নিয়ে। মহিলাকে বলতেই অবাক হয়ে দেখি কি ভীষণ রুদ্রমূর্তি নিয়ে একাই দাঁড়ালেন একদল ভ- পুরুষের বিরুদ্ধে। নিজেকেই খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল কারণ আমরা কয়েকজন যদিও মহিলার পক্ষে ছিলাম কিন্তু তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে যাইনি কিংবা তার সাথে থেকে প্রতিবাদও করিনি। সেই যে একটা প্রবাদ চরিত্রহীন লোক আসলে দূর্বল থাকে তার যথার্থতা দেখলাম। ঐ মহিলার তীব্র প্রতিবাদের বিরুদ্ধে ওরা চুপসে গেল। এবং ওরা তারপর থেকে এই পথে হাঁটতে আসে না। আমি ভাবছি সাহস করে মহিলা রূখে দাঁড়িয়েছিল, তাতেই যদি পরিবর্তন আসে তবে কেন প্রতিবাদ করে না নারী? দিনের পর দিন দেখেছি ওই ধরনের মানুষগুলো অনেক মহিলাকে নিয়ে কটুক্তি করতে। কেউ কিছু বলে না ভয়ে। আবার ভাবে আমাকে তো বলছে না, কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলা করে? কিন্তু একথা অবধারিত যে এইভাবেই দূর্জনের সাহস বাড়ে আর নষ্ট সমাজ গড়ে তোলে। একজন মহিলাকে অপমান করার অর্থ কিন্তু সমস্ত নারী জাতিকে অপমান করা। আজ যে নারীরা বৈষম্যের শিকার, পথে, ঘাটে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে তা কিন্তু একদিনে হয়নি বা হঠাৎ হচ্ছে না। এও কিন্তু প্রতিবাদ না করার কূফল। যে কোন পরিস্থিতিতে, যে কোন অবস্থাতেই যেখানেই নারী বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে প্রতিবাদ করার সাহস রাখলেই নিশ্চিত নারী নির্যাতনের হার কমে যাবে। আমার দেখা এই নারী সেদিন আমার চোখ খুলে দিয়েছে। মহিলারা প্রতিবাদ করে না বলেই নিজেদের অস্তিত্ব নাজুক করছে। তাই বলবো এখন আর সেদিন নেই পড়ে পড়ে মার খাওয়ার। প্রতিবাদ করতে শিখুন নিজেকে রক্ষা করুন, এবং মাথা উঁচু করে বাঁচুন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট