চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

শিশু নির্যাতক আমাদের ঘরেরই লোক

নিগার আহমেদ

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

আমরা যে স্কুলে লেখাপড়া করেছি সে স্কুলে ছেলে-মেয়ে উভয়ে পড়েছি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। সেখানে ছেলে শিক্ষক ছিল, কম বয়সী দাড়োয়ান ছিল। কিন্তু আমার মনে পড়ে না আমার মা-বাবা কখনও স্কুলে আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। সে সময় আমাদের পৃথিবীটা ছিল নির্মল আনন্দে পরিপূর্ণ। বেশির ভাগ সময়ে আমাদের গল্পের বিষয় ছিল বিটিভির নাটক, নতুন কুঁড়ি কিংবা ইংরেজি ছবি চার্লেস এঞ্জেলস অথবা ম্যাকগাইভার। মাঝে মাঝে কথা হতো কে কতক্ষণ বৌ-চি খেলায় দম রাখতে পারে বা দড়ি লাফ খেলায় কত বেশি লাফ দিতে পারে এই নিয়ে। কিন্তু এখন আমাদের শিশুদের আলোচনার বিষয়বস্তু অনেক ক্ষেত্রেই অন্য রকম।

এখন আমাদের সন্তানেরা আলোচনা করে তারা কতটা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বাড়িতে। না, না বেত-টেত নয়, এই নির্যাতনের ধারা আলাদা। এটা যে নির্যাতন তা আমাদের শিশুদের বলে দিতে হচ্ছে না। এরা সবাই কিভাবে যেন বুঝে নিচ্ছে সব। বুঝতে পারছে তারপরও কেউ নালিশ করছে না, এমনকি মায়ের কাছেও বলে না। খুবই বিপন্ন আজকের শিশু আর নারীরা। তাদেও জন্য না আত্মীয়-স্বজন নিরাপদ, না স্কুল নিরাপদ, না খেলার আঙিনা নিরাপদ।
বিপদ আসে পরিবার থেকেই

আমাদের শিশুদের পৃথিবী জগতের অলক্ষ্যে বদলে গেছে অনেক আর ওরা বুঝে যায় বিপদ আসে নিজের পরিবারের আশপাশ থেকেই। ছাদের ঘরে বা চিলেকোঠায় শুয়ে যে মামা কানে হেডফোন লাগিয়ে রক গান শুনছে তার কাছ থেকে। যে চাচা ভাইঝিদের কাপড় বদলাবার সময় ইচ্ছে করে সে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। যে দূরস¤পর্কের খালতো কিংবা মামতো ভাই বিয়েবাড়ির ঢালাও বিছানায় অদূরে ঘুমিয়েছে তার কাছ থেকে। অল্প আলো-জ্বলা ঘরে কোলে বসিয়ে যে দাদু অশেষ আদরে চন্দ্রপুলি খেতে দিয়েছে তার কাছ থেকে। যে দুলাভাই দেখি দেখি ‘কেমন সূচের কাজ করেছিস জামার বুকে’ বলে ওড়না সরিয়ে দেয় তার কাছ থেকে। যে আরবি হুজুর শুক্রবার সকালে আমপারা পড়াবার পরে দেখাচ্ছে মেয়েরা নামাজে কেমন করে হাত দিয়ে বুক বাঁধে তার কাছ থেকে।

এইতো সেদিন চট্টগ্রামের খ্যাতনামা একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির একটি মেয়েকে দেখা গেল টিফিন ছুটিতে স্কুল পালানোর চেষ্টা করতে। শিক্ষকদের কাছে যখন ধরা পড়ল তখন সে অঝোরে কাঁদছে। তার ব্যাগ চেক করে ৩০০০ টাকা পাওয়া গেল। পাওয়া গেল টপ স্কার্ট। অনেক পরে সে জানাল সে তার সেই দূর সম্পর্কের চাচার সাথে বের হতে চাচ্ছিল যে তাকে নিয়মিত স্কুলে আনা নেয়া করে। রিকশায় তার শরীরে হাত দেয়। বাসায় পড়ানোর ছলে জড়িয়ে ধরে। একদিন মা যখন তাকে তার কাছে রেখে শপিং এ গেল, তখন তার চাচা তাকে ঘুম পাড়িয়ে অনেক খারাপ সব ছবি তুলে রাখে। আর ভয় দেখায় তার কথা না শুনলে তার বাবা-মাকে ছবিগুলো দেখাবে। তার বাবা-মা তার কোনো কথা বিশ^াস করে না, তাই সে তাদের কিচ্ছু বলে না।

অথচ আমাদের সময়ে আমরা জানতাম এই সব মামা-চাচা-ফুপা-খালু-দুলাভাই-নানু-দাদুরা আমাদের কাছে অনেককিছু, এরা এইসব মেয়ে শিশুদের (মানে আমাদের) একান্ত স্বজন। এরা আমাদের সাফল্যে উজ্জ্বল হাসে, এরা আমাদের বিয়ের সময় সমবেদনায় লীন হয়, এদের অভিভাবকত্বেই মেয়ে শিশুরা লালিত- পালিত- অভ্যর্থিত- আপ্যায়িত হয়। কিন্তু আজ এদের রূপ ভয়াবহ, বিভৎস্য। যা ভাবতেও আমাদের শিশুরা আতংকিত হয়।

আর আজ তাই আজ শিশুরা বুঝতে পাওে যে তার জন্য বাজার ঘুরে মনোহারী সামগ্রী কিনে আনে তার কাছে ওর শরীর নিরাপদ নয়। যে তাকে ছোটবেলায় বাতাসে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিত, তার কাছে ওর শরীর নিরাপদ নয়।
আচ্ছা, পার্বতীপুরের শিশু পূজাকে তার কথিত ‘বড় আব্বা’ ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে যোনিপথ বড় করে ধর্ষণ করেছিল, সেই শিশুটিকে আমরা এই দেড় বছরে ভুলে গেছি, তাই না? গে-ারিয়ার দীননাথ সেন রোডের যে দুই বছরের শিশুকে খিচুড়ি খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে এনে ধর্ষণ করে তিনতলা থেকে ছুঁড়ে হত্যা করেছে নাহিদ, তাকেও তো ভুলে যাব, তাই না? আরো যোগ হয়েছে ওয়ারীর শিশু সায়মার নাম, ঘন্টাখানেক নজরদারিতে ছিল না যে শিশু, তাকেও ভুলতে আমাদের তেমন সময় লাগবে না, তাই না?

পরিসংখ্যানের কথা বলার সাহস আমার নেই। ভাবলেই আমার বুকে কাঁপন ধরে। এখন একজন দুজন নয় হাজার হাজার শিশু ধর্ষিত হচ্ছে, ধর্ষণের পর খুন হচ্ছে আমাদের, কাছের মানুষরাই নিয়ে যাচ্ছে তাদের ডেকে। আত্মীয়স্বজন নিরাপদ নয়, স্কুল নিরাপদ নয়, খেলার আঙিনা নিরাপদ নয়, মাদ্রাসায় ধর্ষণের খবর আসছে প্রায় প্রতিদিন।
পিডোফিলদের হাত থেকে শিশুদের বাঁচাবার জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনি। শিশু যখন ফ্যালফ্যাল করে বসে থাকে, কেবল কাঁদে কিন্তু কিছু বলে না, কেবল দুঃস্বপ্ন দ্যাখে, কেবল কাউকে দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়, কেবল ড্রয়িং খাতায় বীভৎস ছবি আঁকে তখন আমরা তাকে বিশ্বাস করে তার কথা শুনতে চাই কি? সে যে আমাদের পছন্দসই প্রিয়জনদের পছন্দ করতে, কাছে যেতে, চুমু খেতে, জড়িয়ে ধরতে বাধ্য নয়, তা মনে রাখি কি? যখন শিশু বিশ্বাস করে চেষ্টা করে তার নির্যাতনের ইতিহাস ব্যক্ত করে (বিশ্বাস করুন, শরীরের অঙ্গগুলির নাম নেয়াটাও তার জন্য দুরূহ, সে স্বভাব-লাজুক), আমরা তার নির্যাতকের শাস্তির ব্যবস্থা দূরে থাক, তাকে চিহ্নিতও করি কি?

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা প্রতিরক্ষা বা পরীক্ষা করে আমরা শিশুদের কাছে একজন পরিণতবয়স্ক মানুষকে পাঠাই কি? শিশু-সংস্রব থাকে যেসব পেশায় সেই পেশায় শিশু নির্যাতক যেন কিছুতেই অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাই তো আমরা করতে পারিনি। একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনের এর চেয়ে বড় পরাজয় আর কিছুতেই হতে পারে না। শেষ করবো একটি কথা বলে। যে শিশুটি ধর্ষিত হচ্ছে, সে পথশিশুই হোক, কি ঘরের, কি আবাসিক মাদ্রাসার, সেই শিশুটি বেঁচে থাকলে একটি অলিখিত নোটবুক হাতেই চুপচাপ বড় হয়ে উঠবে তা ভাববেন না যেন। শৈশবে যে এমন নির্যাতনের শিকার হয়, অনেকক্ষেত্রেই সে বড় হয়ে নির্যাতক হয়, খুনি হয়, সিরিয়াল কিলার হয়। নির্যাতক হয়ে সে নিজের প্রতি নির্যাতনের জ্বালা ভুলতে চায়। অর্থাৎ আমরা আজ যা দেখছি চারপাশে, তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন না যেন, তাহলে আরো অনেক ভয়াবহ দিন আসবে সামনে। আওয়াজ উঠাই চলুন। বারবার। অক্লান্ত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট