চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হোক উদযাপনের

রিমি রুম্মান

১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ | ৩:৪৩ অপরাহ্ণ

গিয়েছিলাম পেন্সিলভেনিয়ার হ্যাটফিল্ডের ডেরস্টাইন রোডে। ‘ডেরস্টাইন রান’ নামের একটি লিভিং কমিউনিটিজ-এ। যেখানে বৃদ্ধরা বসবাস করে। এক সময় যাদের সুন্দর ঝলমলে পরিবার ছিল। রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলা জীবন ছিল। সম্মানজনক চাকুরি ছিল। এখন অখণ্ড অবসর। সন্তানরা বড় হয়েছে। নিজেদের মতো করে সংসার পেতেছে। বিশেষ দিনগুলোতে উপহার নিয়ে এসে বাবা-মা’র সাথে দেখা করে। সময় কাটায়।

বাড়িগুলোর ভেতরেই লাইব্রেরি, ব্যায়ামাগার, পার্লার, মুভি থিয়েটারসহ যাবতীয় সকল উপকরণ রয়েছে। পেনশন ও সোস্যাল সিকিউরিটি বেনিফিটসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকায় লিভিং কমিউনিটিজে তারা সকলেই একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন করে। আমার বন্ধু সেখানে চাকরি করে বিধায় বসবাসরতদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় ভিডিও কলে। নিউইয়র্ক টু পেন্সিলভেনিয়া। ভেলেরিয়া তাদের একজন। ভেলেরিয়া আফ্রিকান আমেরিকান নারী। সম্ভবত ওই বাড়িগুলোয় বসবাসকারীদের মধ্যে সে-ই সর্ব কনিষ্ঠ। ভেলেরিয়ার বয়স সাতষট্টি। যৌবনে ছোট ভাইবোনদের দেখভালের জন্যে সে বিয়ে-শাদী করে নি। চাকরি করে সংসারের ঘানি টেনেছে। সকলেই আজ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ততদিনে সময় গড়িয়েছে ঢের। ভেলেরিয়ার বয়স বেড়েছে। সংসার, সন্তান হয় নি। ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। তারপর রিহাবে। এখন এই লিভিং কমিউনিটিজ-এ। ভাইবোনেরা শুরুর দিকে খোঁজ নিলেও এখন আর নেয় না। এ নিয়ে তার বড় অভিমান। সে-ও আর যেচে যোগাযোগ করে না।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। কনকনে শীতের রৌদ্রজ্জ্বল সকাল। বাইরে সূর্যের নিরুত্তাপ ঝকমকে আলো। আমি যখন ভেলেরিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাই, সে লিভিং রুমের জানালার পাশে হুইল চেয়ারে বসে ছিল। মাথায় বারগেন্ডি রঙের নকল চুল। মুখে কড়া মেকআপ। চোখে আই-লেস। ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক। সকালের তির্যক কোমল রোদে তার চুল ঝিকিমিকি করছিল। দুই রুমের ছোট্ট এপার্টমেন্ট। একটি লিভিংরুম, অন্যটি বেডরুম। গোলাপি রঙ তার প্রিয়। বিধায় পুরো ঘর গোলাপি আসবাবে সাজানো। কিচেনে রাখা মাইক্রোওয়েভ, টোস্টার, এমন কী হাঁড়িপাতিলও। টিপটপ পরিচ্ছন্ন। ব্রাউন ও গ্রেগ নামের দুই বন্ধু নিয়মিত তাকে দেখতে আসে। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে যায়। গল্প করে। সময় কাটায়। অস্বাভাবিক মেদবহুল শরীর ভেলেরিয়ার। দিনের অধিকাংশ সময় কাটে হুইল চেয়ারে। রাতে বিছানায়। তাকে দেখভালের জন্যে, সময় মতো খাবার, ওষুধ দেয়ার জন্যে প্রায় সার্বক্ষণিক কেয়ারগিভার আছে। যিনি হুইলচেয়ার ঠেলে ক্যাফেটেরিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে অন্যদের সঙ্গে গল্প করে, টিভি দেখে কিংবা কার্ড খেলে আনন্দে মেতে ওঠে ভেলেরিয়া। গল্পচ্ছলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে একযোগে হেসে ওঠে সকলে। তাদের প্রত্যেকের বয়স আশির ওপরে বা শতাধিক। তারা নিয়মিত পার্লারে যায়। ফেসিয়াল, ম্যানিকিওর প্যাডিকিওর করে। শারীরিক নানান জটিলতার মধ্য দিয়ে যাওয়া, জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো এত প্রাণশক্তি কোথায় পায়? কী তার উৎস? তাদের গল্পে হাহাকার, দুঃখবোধ বা হতাশা নেই। কেবলই অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন উদযাপনের।

বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসি যখন, তখন জীবনের ভিন্ন এক মানে সামনে এসে দাঁড়ায়। সংসার-সন্তান নিয়ে এই যে রুদ্ধশ্বাস ব্যস্ততা, জীবন যুদ্ধ, এরও তো এক সময় ইতি টানতে হবে। একদিন পুত্রদ্বয়ের নিজস্ব সংসার হবে। তাদের সংসার দেখার স্বপ্ন দেখি। একদম আলাদা একটি সংসার। যেখানে তারা থাকবে তাদের মতো করে। মন চাইলে রাঁধবে, না চাইলে নয়। চাইলেই রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়াবে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবে। অলস সময় কাটাবে কিংবা অবেলায় ঘুমিয়ে থাকবে। স্বামী-স্ত্রী মান-অভিমান করবে, ঝগড়া করবে। পরক্ষণেই একে অন্যের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেবে। এই স্বাধীনতাটুকু থাকুক। প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচুক। পুত্রবধূ হিসেবে যে মেয়েটি আসবে, তাকে তো আমি রাতের ঘুম হারাম করে লালন-পালন করি নি, বিধায় তার সেবাযত্ন পাওয়ার প্রত্যাশা তো করতে পারি না। ঘরের বউ চাকরি করবে ক্যান, বাইরে যাইতেছে ক্যান, বাচ্চা এম্নে পালতেছে ক্যান, এম্নে খাওয়াইতেছে ক্যান, এইসব বলে বলে পুত্রের কান ভারি করে তাদের জীবন বিষিয়ে তোলার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তাদের সংসারে থেকে, তাদের ঝগড়ার মাঝে ঢুকে, ছেলের পক্ষ নিয়ে বউকে হেনেস্তা করার অধিকার কি আমার আছে? জীবন তো একবারই। পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার সময় খুবই সংক্ষিপ্ত। এই স্বল্প সময়ে আমার ছেলেরা তাদের তারুণ্যের, সংসারের সুন্দর সময়গুলো উপভোগ করুক। উদযাপন করুক নিজের মতো করে। প্রতিটি মানুষেরই নিজের মতো করে ভালো থাকার অধিকার আছে। আমার শুধু লাইব্রেরি আর ব্যায়ামাগার থাকলেই চলবে।
সকলের জীবন আনন্দময় হোক।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট