চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

অনন্তযাত্রায় কবি আসাদ চৌধুরী : ঘরে ফেরা সোজা নয়

৬ অক্টোবর, ২০২৩ | ১:০০ অপরাহ্ণ

গেলো কয়েকটি সপ্তাহে প্রতিদিন কথা হতো নাদিম ইকবালের সঙ্গে। আসাদ চৌধুরীর একমাত্র কন্যা শাঁওলীর বর এই নাদিম। নাদিমের কাছে জানা হতো আসাদ চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ আপডেট। আমাদের কারোই জানতে বাকি ছিলো না যে মৃত্যুর সঙ্গে তুমুল লড়ছিলেন তিনি।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকে বারবার। হাসপাতালে চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে চরম খবরটি শোনার প্রতীক্ষায় থাকার কথা বললেও পর পর তিনবার তিনি মৃত্যুদূতকে পরাস্ত করে ফিরে এসেছেন বাড়ি। এরকম লড়াকু আসাদ চৌধুরী। কবি আসাদ চৌধুরী অবশেষে পরাজিত হলেন জীবনের অমোঘ সত্যের কাছে। মৃত্যু সেই অলঙ্ঘনীয় অনিবার্য সত্যের নাম।

৫ অক্টোবর রাত তিনটায় তিনি জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকু নিতে পেরেছিলেন। তারপর পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তের পথে।

বার্ধক্যজনিত নানান জটিলতা বাসা বেঁধেছিলো শরীরে। ফুসফুসে পানি জমছিলো বারবার। ভয়ংকর শ্বাসকষ্টের কারণে নিঃশ্বাস নিতেন তিনি হাঁ করে, মুখ দিয়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে। সেই দৃশ্য সহ্য করা কঠিন ছিলো আমার কাছেও। তারপর জানা গেলো ব্লাড ক্যান্সারের কথা।

গেলো মাসে অটোয়ার পাশের শহর অশোয়ায় পুত্র আসিফ চৌধুরীর বাড়িতে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের মতো একটা বেডে, যেটাকে ফোল্ড করা যায় প্রয়োজনে, তিনি শুয়েছিলেন জবুথবু। এমনিতে আমাকে দেখলে খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো তাঁর চোখ-মুখ। সেদিন সেই খুশির মাত্রাটা ছিলো সামান্যই। শুধু তাকিয়ে ছিলেন ফ্যাল ফ্যাল করে। কোনো কথাই বলছিলেন না। তাঁকে আমি একটা দুটো প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি তাঁর জবাবে কিছুই বলছিলেন না। কিন্তু তাঁর চোখ কথা বলছিলো। মাথাটা সামান্য কাৎ করে চোখের ভাষায় তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে- আমি ভালো নেই রিটন।

পাশেই বসে ছিলেন আসাদ চৌধুরীর স্ত্রী শাহানা চৌধুরী। তিনি বললেন, তিনটা চারটা প্রশ্ন করলে হয়তো একটা প্রশ্নের জবাব দেয় তাও এক শব্দে। বাক্য কমপ্লিট করতে পারে না।

আহারে!
বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে সেরা একজন কথক বলেই জানে। চমৎকার কণ্ঠস্বরে দুর্দান্ত শব্দ চয়নে তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা যাঁরা জীবনে একবার শুনেছেন, কেউ ভুলতে পারবেন না সেই স্মৃতি। বাংলাদেশ টেলিভিশন যখন শাদাকালো ছিলো, রঙিন যুগ আসার আগে থেকেই বিটিভির উপস্থাপক হিশেবে নন্দিত ছিলেন তিনি। ছিলেন বিপুল মানুষের ভালোবাসাধন্য। বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য ভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘প্রচ্ছদ’ ছিলো সত্তুর-আশির দশকের অন্যতম প্রেস্টিজিয়াস অনুষ্ঠান বিটিভির। সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারাটা বিরাট একটা সম্মানের ব্যাপার ছিলো তখন। সেই অনুষ্ঠানে অতি তরুণ এই আমি রিটনকে তিনি ডেকেছিলেন। আমি পড়েছিলাম ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ নামের দীর্ঘ একটা ছড়া। খুবই রিদেমিক এবং প্রতিটি ছত্রে ঢাকার টুকরো টুকরো দৃশ্য তাতে চিত্রিত করেছিলাম। ঢাকা আমার ঢাকা ছড়াটা আসাদ ভাই শুনেছিলেন বাংলা একাডেমির একুশের ভোরের কবিতা পাঠের আসরে। রেকর্ডিং-এর দিন তিনি স্টুডিওতে একজন তবলা শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন আমার ছড়ার সঙ্গে তবলার অপরূপ বোলের সংযোজন করবেন বলে। ফলাফল দুর্দান্ত। রাতে প্রচ্ছদ প্রচার হবার পরদিন ঢাকা শহরের যেদিকেই গেছি লোকজন আমাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দ্বিতীয়বার অবলোকন করেছে। কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছে- আপনি সেই ঢাকা আমার ঢাকা কবিতার লেখক না? আপনাকে দেখলাম তো!

রাতারাতি আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো সারাদেশে। মনে রাখতে হবে তখন বাংলাদেশে সবেধন নীলমণি একটাই টেলিভিশন চ্যানেল ছিলো- বিটিভি। উঠতি বয়েসে অতি তরুণ ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনকে রাতারাতি বিখ্যাত বানিয়ে দিয়েছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী।

আসাদ চৌধুরীর প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’ ছিলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে আসাদ চৌধুরী ছিলেন আরাধ্য ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে তিনিই ছিলেন একমাত্র কবি যিনি সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনামা সাহিত্য সংগঠনের অনুষ্ঠানেও অতিথি হতেন। বাংলাদেশের হেন অঞ্চল নেই যেখানে আসাদ চৌধুরী অতিথি হননি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে অবহেলিত সাহিত্যকর্মীদের উদ্দীপ্ত করে আসতেন তাঁর অসামান্য বক্তৃতায়। সেই হিশেবে আসাদ চৌধুরী ছিলেন আমাদের জনসম্পৃক্ত কবিদের অগ্রগণ্য একজন। প্রথম সারির তো বটেই, জনসম্পৃক্ততায় শীর্ষেও।

কয়েক বছর আগে স্ত্রীকে সঙ্গে করে তিনি চলে এসেছিলেন কানাডায়। পুত্র আর কন্যার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাবেন বলে। বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে কানাডার আসার পর তাঁর জীবনটা হয়ে উঠেছিলো একেবারেই অন্যরকম। সমুদ্রের মাছকে ছোট্ট একটা পুকুরে এনে ফেললে যেমনটা হবে, ঠিক তেমনটি। শারীরিক ভাবে তিনি হয়তো বেঁচেছিলেন, কিন্তু মনটা তাঁর পড়ে থাকতো বাংলাদেশে। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যমণি হয়ে থাকা আসাদ চৌধুরীর শেষ জীবনটা ছিলো এক ধরণের নিঃসঙ্গতায় মোড়ানো। খালি চোখে সেই নিঃসঙ্গতাকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু তাঁর বুকের ভেতরের বিরামহীন হাহাকার আর গোপন অশ্রুপাতের বিষয়টি আমি জানতাম। অটোয়ায় আমাদের বাড়িতে আমার কাছে এলেই কেবল দেখতাম অতীতের উজ্জ্বল উচ্ছ্বল আনন্দপ্রিয় সেই আসাদ চৌধুরী বেরিয়ে আসছেন ক্রমশঃ খোলস ছেড়ে। আমাদের বাড়িতে আসাদ চৌধুরীর আসা মানে বাড়ি জুড়ে ঈদের আনন্দ। আমার স্ত্রী শার্লির রান্না করা খানাখাদ্যির সঙ্গে বিরামহীন হাস্য আর হৈ-হুল্লোড়ে কেমন করে যে কেটে যেতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা! সময় কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে আমরা টেরই পেতাম না। আড্ডা হয়তো শুরু হলো দুপুর বারোটায়। রাত সাড়ে এগারোটায় আমাদের সম্বিত ফেরে- আরে! অনেক রাত হয়ে গেলো তো!

কতো শতো স্মৃতি যে আমার আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে! সারাদিন বললেও শেষ হবে না। আমার ছড়ার জার্নিটা শুরু হবার কাল থেকেই, সেই সত্তুরের দশক থেকেই তিনি আমাকে ছড়াকার হিশেবে আলাদা মর্যাদা দিতেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই- বাংলাদেশের বিখ্যাত ও সিনিয়র কবি লেখক সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রতিশ্রুতিশীল ছড়াকার হিশেবে আমাকে প্রথম গুরুত্ব দিয়েছেন একজন আসাদ চৌধুরীই। ১৯৮২ সালে আমার প্রথম ছড়ার বই ‘ধুত্তুরি’ প্রকাশিত হবার পর থেকে আসাদ চৌধুরী আমাকে একজন প্রতিষ্ঠিত ছড়াকারের মর্যাদায় কাউন্ট করতেন। প্রথম বই ধুত্তুরি প্রকাশের পর থেকে আসাদ চৌধুরী আমাকে আর তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল লেখক ভাবেন নি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার প্রসঙ্গে তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যে, আমি তাঁদেরই সমগোত্রীয়!
সেই সম্মান সেই মর্যাদা সাহিত্যের অঙ্গণে আমাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো।

জীবনের শেষ কয়েকটা মাস অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। দম বন্ধ করা সেই কষ্ট। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলো বারবার। কেমো নিতে হতো। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় খেতে পারতেন না কিছু। খাদ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করেছিলেন চিকিৎসকেরা।
আসাদ চৌধুরীর পুত্রেরও অধিক পুত্র, জামাতা নাদিম ইকবাল প্রতিদিন নিয়ম করে তাঁর আপডেট জানাতো আমাকে।

গতকাল রাতেই নাদিম আমাকে জানিয়েছিলো অবস্থা সুবিধের নয়। যে কোনো সময় নির্মম কিছু ঘটতে পারে। অসহনীয় শারীরিক ব্যথার লাঘব ঘটাতে গতকাল রাতে তাঁকে মরফিন ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছিলো।

বড় অদ্ভুত একটা জীবন পার করছিলেন আসাদ চৌধুরী।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা জীবন।
কথা না বলা জীবন।
নিঃশ্বাস নিতে না পারা জীবন।
কবিতা না লেখা জীবন।
আহারে!

অনুজপ্রতিম বন্ধু হাসান মাহমুদ টিপু এবং শরীফ হাসান শিশিরের সঙ্গে গেলো মাসে যখন অশোয়ায় পুত্র আসিফের বাড়িতে আসাদ চৌধুরীকে দেখতে গিয়েছিলাম, আমাকে দেখে নির্লিপ্ত থাকা আসাদ চৌধুরী প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন সেটি ছিলো- শার্লি আসেনি? হ্যাঁ আমার স্ত্রী শার্লিকে তিনি অসম্ভব স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। বিভিন্ন সময়ে আমি দেখেছি শার্লির সঙ্গে খুব গভীর আলোচনা করছেন তিনি খুব নিম্নস্বরে।

পরে শার্লির কাছে জেনেছি তিনি তার জীবনের একান্ত কষ্টের এবং বেদনার বিষয়ে শার্লির সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই কষ্টের নাম ছিলো আসিফ। আসাদ চৌধুরীর বড় ছেলে। প্রচন্ড বোহেমিয়ান তুখোড় আড্ডাবাজ গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে আসর জমিয়ে ফেলা আসিফ হচ্ছে খ্যাপাটে ধরনের। কখনোই স্থির থাকে না। কখনো স্থির থাকে নি। টপাটপ প্রেমে পড়া ওর বৈশিষ্ট্য। সে কারণে সংসারটা ওর নড়বড়ে। আসাদ ভাই চাইতেন মনে-প্রাণে চাইতেন পাগলটা সুখি হোক। একটু স্থির হোক। চমৎকার একটা সংসার হোক ওর।

মন্ট্রিয়লে শিল্পী রাকিব হাসান আর কথাশিল্পী নাহার মনিকাদের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি আসাদ চৌধুরী এবং আসিফ চৌধুরী নামের দুই অসম বয়েসী পিতা-পুত্রের বিস্ময়কর বন্ধুত্বের অপরূপ দৃশ্যগুলো! মোটেলে ওদের পাশাপাশি কক্ষে ছিলাম আমি আর শার্লি। সকালে দেখেছি বাপের সঙ্গে কী রকম দুস্তি আর কুস্তি করে আসিফ ক্ষ্যাপাটা। এই জড়িয়ে ধরে এই আসাদ চৌধুরীকে। এই পাঁজাকোলা করে ওপরে তুলে ধরে। এই চুমু খায় আসাদ চৌধীর কপালে ও মাথায়। বয়স্ক পুত্রের এরকম পাগলামিতে আসাদ চৌধুরী হেসেই কুটিপাটি। প্রবীণ আসাদ চৌধুরীকে আমার তখন বারবার একজন ঝলমলে কিশোর মনে হয়েছে। ছেলেটা তার বাপকে শৈশবে কৈশোরে নিয়ে গেছিলো রোদ চকচক সেই উজ্জ্বল সকালে।

হাসপাতাল পছন্দ ছিলো না আসাদ চৌধুরীর। তিনি থাকতে চাইতেন না ওখানে। বাড়িতেই থাকতে চাইতেন তিনি। বারবার বলতেন আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।

আসাদ চৌধুরীর জীবনের শেষপ্রান্তে। নাদিম আমাকে আপডেট দিতো রোজ- রিটন ভাই শুনে আপনার মন খারাপ হবে তাও বলি- নার্সের ফোন পেয়ে আজ হাসপাতালে গিয়ে কী ভয়ংকর দৃশ্যই না দেখলাম! সেদিন হাসপাতালের নার্স কল করেছে নাদিমকে। আসাদ চৌধুরী নামের সিরিয়াস পেসেন্ট হাসপাতালের কেবিন থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন! দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গিয়েছে নাদিম। গিয়ে দেখে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন আসাদ চৌধুরী। তিনি কথা বলেন না বা বলতে পারেন না। মাথা তুলতে চেষ্টা করলেন নাদিমকে দেখে। কিন্তু সামান্য উঁচু করেই আবার শুয়ে পড়ছেন। এমনকি হাতটাও তুলতে পারছেন না। নাদিম তাঁকে তুলতে গেলো। কিন্তু শরীর আটকে আছে কোথাও। আসাদ চৌধুরীর গায়ের চাদরটি সরাতেই দেখা গেলো- নার্স এবং চিকিৎসকরা বেডের সঙ্গে আসাদ চৌধুরীর হাত এবং পা বেঁধে রেখেছেন। উচ্চস্বরে চিৎকার করে নার্সদের ডাকলো নাদিম- খুলে দিন এক্ষুণি খুলে দিন! ওরা বললো, তাঁকে কিছুতেই আটকে রাখা যাচ্ছিলো না। বারবার বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইছেন অর্থাৎ কি না পালাতে চাইছেন! শেষে বাধ্য হয়েই এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে তাদের।

আহারে!
আরেকদিন নাদিম বললো- বাবা আজ আমাকে একটা ইংরেজি বাক্য বলেছেন- আই ডোন্ট ডিজার্ভ দিজ! অর্থাৎ দিনের পর দিন অসহনীয় এই কষ্ট।

আরেকদিন। নাদিম বললো- আপনার আসাদ ভাই কথা বলতে পারেন না। বলার চেষ্টাও করেন না। কারণ তিনি পুরো বাক্যটা গোছাতে পারেন না। শব্দ হারিয়ে যায়। অসহনীয় ব্যথায় কাতর তিনি। আজ আমি যাবার পর বিছানায় যখন হেলান দিয়ে বসিয়েছি আসাদ চৌধুরী নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকানোর ভঙ্গি করে আমাকে ইশারা করেছেন বারবার- আমাকে গুলি করো। গুলি করো!

আহারে আসাদ ভাই!
সেদিন এঞ্জিওগ্রামের খবর দিলো নাদিম- দুটো ব্লক ধরা পড়েছে। একটা ৮৮% অন্যটি ৯৯% ব্লক।
পরদিন খুব সকালে নাদিমের ফোন- একটা হার্ট এটাক হয়ে গেলো রিটন ভাই!
বিধ্বস্ত শরীরে একের পর এক আঘাত।
একটার পর একটা।
আহারে!

আমার উপস্থাপনায় একুশের বইমেলা থেকে চ্যানেল আই পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ‘বইমেলা সরাসরি’ নামের একটি লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করতো। একবার ২০১৪ সালের এক বিকেলে কবি আসাদ চৌধুরী এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে হাতে একটি কিউট কবিতার বই নিয়ে। লাইভ সেই অনুষ্ঠানে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- আসাদ ভাই আপনার মনে হয় নতুন বই বেরুলো এই মেলায়?

লাজুক একটা হাসি উপহার দিয়ে আসাদ ভাই বইটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন- হ্যাঁ বই একটা বেরুলো আজই, বইটার নাম দিয়েছি- ‘এই ফুলটির অন্তত দশটা প্রেমপত্র পাওয়া উচিৎ’ (বা পাওয়ার কথা)! বলেই হাসতে এমন ভঙ্গিতে হাসতে থাকলেন যে মনে হলো দশটা প্রেমপত্র আসলে আসাদ ভাইয়েরই পাওয়া উচিৎ!
পাঠকপ্রিয় কবি আসাদ চৌধুরীর লেখা কবিতার বইয়ের নামগুলো ছিলো অসাধারণ, যেমন- জলের মধ্যে লেখাজোখা, দুঃখীরা গল্প করে, বিত্ত নাই বেসাত নাই, যে পারে পারুক, প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়, মেঘের জুলুম পাখির জুলুম, নদীও বিবস্ত্র হয়, কিংবা ঘরে ফেরা সোজা নয়।

দিনশেষে তিনি, আসাদ চৌধুরী তাঁর প্রিয় বাংলাদেশেই ফিরে যেতে চাইতেন। বহুবার আক্ষেপ করেছেন তিনি- এইদেশে আর ভাল্লাগে না। আমি ফিরতে চাই রিটন, বাংলাদেশে…।
কিন্তু ফেরা হয়নি তাঁর।
তিনি হয়তো জানতেন- ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’…।  সূত্র : ফেসবুক

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট