চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

যেভাবে নেক আমল বদ আমলে পরিণত হয়

১০ জানুয়ারি, ২০২৩ | ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ

সৃষ্টির সেরা মানুষ সবসময় ভাল কিছু চান। মন্দ পছন্দ করেন না কেউই। এটি মানুষের স্বভাব। প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ চায় আমি ভাল জিনিসটা নেব, খারাপটা নেব না। আমরা জীবন-যাপনের জন্য ভাল চাকরি, কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য চাই। চিকিৎসা করার জন্য ভাল ডাক্তার দেখি। মামলা পরিচালনার জন্য ভাল আইনজীবী। বিয়ের জন্য ভাল পাত্র-পাত্রী দেখি। জীবনের সবক্ষেত্রে সবকিছু ভাল চাই। সৃষ্টাও চান আমরা উত্তম আমল নিয়ে জীবন-যাপন করি। তবে সমস্যা তৈরী হয়, সেখানে যখন আমরা আখেরাতের তুলনায় জীবনকে প্রাধান্য দিই। তাই অসম প্রতিযোগিতায় মন্দ কিংবা লোকদেখানো কাজে ঝুঁকে পড়ে মানুষ।

 

আমল অর্থ কাজ। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে আমল বলতে সৎ কাজকেই বুঝায়। মানুষ সৃষ্টির কল্যাণে এবং আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আদেশ, নিষেধ মেনে যে কাজ নিজ জীবনে সম্পাদন করে তাই আমল। আল্লাহপাক বলেন, মৃত্যু এবং হায়াত রাখলাম তোমাদের পরীক্ষা নেব বলে। কি পরীক্ষা? কেয়ামতের মাঠে কে আমার কাছে ভাল আমল নিয়ে এসেছে। অধিক আমল কিংবা বেশি আমল বলেননি। ভাল আমল কে নিয়ে এসেছ।

 

আমরা যে কাজই করি না কেন, তাতে আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। আল্লাহ যেহেতু আমাদের স্রষ্টা, রিজিকদাতা, পালনকর্তা ও বিধানদাতা; তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার হুকুমকেই সামনে রাখতে হবে। তিনি যা করতে বলেছেন, তা করতে হবে। আর যা ছাড়তে বলেছেন, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। এটাই প্রকৃত মুমিনের কর্তব্য। নিজের খেয়ালখুশিমত চলা হলো শয়তান ও পশুর কাজ।

 

আমরা যেমন ভাল জিনিসি খুঁজি তেমনি আল্লাহপাকও ভাল আমল খুঁজবেন। তিনি ভাল আমলগুলো দেখবেন। রাসূল (সা) এক সময় সাহাবীদের প্রশ্ন করলেন, সবচেয়ে গরীব কে? সাহবায়া কেরামদের অভ্যাস ছিল উত্তর জানলেও বলতেন না। তাঁরা বলতেন, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলই ভাল জানেন। আদব-কায়দা মানতেন। নবীজির মোবারক জবান থেকে শুনতে চাইতেন।

 

এসময় নবীজি বললেন, তোমার মনে কর যার কাছে ধন- দৌলত, টাকা-পয়সা নেই সেই গরীব। আসল গরীব হলো সেই ব্যাক্তি যিনি ভাল আমল নিয়ে আল্লাহপাকের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না। অনেক আমল, পাহাড়ের চেয়ে বেশি আমল নিয়ে আল্লাহপাকের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর হিসেব-নিকেশের সময় যখন হবে। বিভিন্ন লোক আসবে আল্লাহপাকের কাছে নালিশ করবে। পাহাড় সমান আমল নিয়ে এসছেন এই ব্যাক্তি, অনেক আমল নিয়ে আপনার সামনে উপস্থিত। একব্যাক্তি অভিযোগ করলেন, হায় আল্লাহ, ওই ব্যাক্তি জোরপূর্বক আমার জায়গা দখল করেছেন, আমার শক্তি ছিল না তাকে প্রতিরোধ করার। অনেক আমল রোজা, নামাজ, হজ, ওমরাহ করেছেন মসজিদ মাদরাসা করেছেন অনেক।

 

আল্লাহপাক বলবেন, আজকে তো জায়গা দেয়ার সুযোগ নেই। আমল দিয়ে দাও। দুই পয়সার জন্য ৭০০ কবুল আমল দিয়ে দিতে হবে। একজনের অভিযোগ-আমাকে একদিন থাপ্পড় দিয়েছে লোকজনের সামনে অপমানে কিছূ বলেতে পারি নাই। যে হাত দিয়ে থাপ্পড় দিয়েছে সেই হাতই সাক্ষি দেবে। তখন হাত বলবে আজ আমাকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে আল্লাহ। মুখ মোহর মেরে বন্ধ করে দেয়া হবে। মুখ দিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। পা কথা বলবে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কথা বলবে।

নবীজি বললেন, ওই লোক অনেক আমল নিয়ে আসলেন, কিন্তু দুনিয়াতে কারো হক নষ্ট করেছেন, কারো হক দেন নাই। লোকজনের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন। তাদের সবার হক আদায় করা হবে তার আমল কেড়ে নিয়ে। আদায় করতে করতে অনেক বেশি আমল তার শেষ। আর আমল নেই। কিন্তু হকদার থেকে যাবে। শেষে বলবে আমার কোন আমল নেই। তখন হকদারের গুনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। এভাবে পরপর অনেকজনের গুনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। যে পরিমান নেকি আর সওয়াব নিয়ে আল্লাহর সামনে উপস্থিত। সব নেকি শেষ হয়ে ওই পরিমান গুনাহ তার মাথার উপর আসবে। তারপর জাহান্নাম ফয়সালা হবে। নবীজি বলেন, সেই প্রকৃত গরীব হয়ে গেল।

আল্লাহপাক বলেন, আমল যেটা করবে সেটা সুন্দরভাবে-উত্তমভাবে কর। তোমাদের মধ্যে কে উত্তম আমল নিয়ে আমার কাছে আসবে আমি তা দেখতে চাই। উত্তম আমল কিংবা ভাল আমল কোনটা-যে আমলে আল্লাহপাক এর হুকুম থাকবে। এবং রাসূল (সা) এর তরীকামতো হবে। নবীজি যেভাবে করে গেছেন এবং উম্মতকে দেখিয়ে দিয়েছেন।

বর্তমানে যে অবস্থায় আছি সেভাবে চলে যাই। কিন্তু ভবিষ্যত যাতে খারাপ না হয়। একটু ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়াই, জায়গা-জমি কিনে রাখি। ভবিষ্যতে যেন আরাম-আয়াশে জীবন যাপন করতে পারি। ভবিষ্যতের চিন্তায় অনেকে জমা করেন।

 

আল্লাহপাক বলেন, আসল ভবিষ্যত হলো আখেরাত। হে আদম সন্তান আল্লাহকে ভয় কর। ভবিষ্যতের জন্য কি করেছ চিন্তা কর। এই ভবিষ্যত হলো আখেরাত। পরকাল আসল ভবিষ্যত। ভবিষ্যতের জন্য কি সঞ্চয় করেছ, সেই চিন্তা কর। কারণ আল্লাহপাকের নিকট ভাল-মন্দ সব খবর জমা আছে। আল্লাহপাক সব জানেন । আমরা কি করছি, কি করবো, কোন অবস্থায় আছি। আমরা যেটা পাঠাবে সেটা আল্লাহপাক কয়েকগুণ বাড়িয়ে আামদের ফেরত দেবেন। কখনো নষ্ট হবে না। জমা থাকবে আল্লাহপাকের নিকট।

 

আল্লাহপাক বলেন, তোমার কাছে যা আছে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। জীবন শেষে সবকিছু ফেলে তুমি চলে আসবে আমার কাছে। আল্লাহপাকের নিকট যেমন আছে তিমনি থাকবে। আখেরাতের জন্য সঞ্চয় করতে আমাদের দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আমল যাতে নষ্ট না হয়ে যায়। তাই হেফাজত করতে হবে। আল্লাহপাককে রাজী করানোর জন্য হবে সব আমল। আল্লাহপাককে রাজী করাতে পারলে তার কোন চিন্তা, ফেরেশোনি নেই। কোন ভয় নেই। এরপর শান্তি আর শান্তি, আরাম আর আরাম।

 

আল্লাহপাক বলেন, দুনিয়া দেখছো বিধায় দুনিয়াকে প্রধান্য দিচ্ছ। দুনিয়ার চেয়ে আখেরাত উত্তম। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আখেরাত চিরস্থায়ী। দুনিয়া শেষ হয়ে যাবে। আখেরাত কখনো শেষ হবে না। যা ইচ্ছে হবে তা পূরণ হবে। ঘুম হবে না। ঘুম হয় তখন মানুষ যখন ক্লান্ত হয়। শুধু ভোগ করবে, আর ত্যাগ নেই। হুররা গাইবে কত মধূর সূর হবে। সবার কণ্ঠস্বর হবে দাউদ (আ.) এর মতো মধুর । আদম (আ.) এর মতো লম্বা হবে। ইউসূফ (আ.) এর মতো সৌন্দর্য হবে। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর মতো আখলাক এবং চরিত্র হবে জান্নাতীদের। ইসা (আ.) এর মতো ৩৩ বছরের যুবক হবে। শান্তির জায়গা আখেরাত।

 

আমাদের ভালো কাজ অনেক সময় মন্দ কাজে পরিণত হয় একটি মাত্র ভুলের কারণে। আর তা হল নিয়ত ঠিক না থাকা। আমরা দ্বীনের কাজই করি, কিন্তু উদ্দেশ্য থাকে লোক দেখানো। লোকে আমাকে ভালো বলবে। নামাজ পড়লে নামাজি বলবে। যাকাত দিলে দাতা বলবে। হজ করলে হাজি বলবে। এরকম নানা ধরনের ভ্রান্ত নিয়ত থাকায় আমাদের সব নেক আমল বদ আমলে পরিণত হয়।

 

অথচ, এই আমল আমি কতো কষ্ট করে করেছি। এর পেছনে কতো সময় ব্যয় করেছি। একটিমাত্র ভুলের কারণে আমাদের পুরো কষ্ট, সময় সব বরবাদ। যে কাজ কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়, তখন সেই কাজকে পূর্ণ ও সফল করার দায়িত্ব আল্লাহর। তার জন্য কোনো কৌশল করার প্রয়োজন পড়ে না।

আল্লাহপাক বলেন- ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করতে চায়। অথচ তিনিও তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে সক্ষম। যখন তারা নামাজে দাঁড়ায় তখন আলস্যভরে দাঁড়ায়। তারা লোকদের দেখায় যে তারা নামাজ আদায় করছে, কিন্তু আল্লাহকে তারা কমই স্মরণ করে।’ (সুরা নেসা : আয়াত ১৪২)

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কেয়ামতের দিন) শুনিয়ে দিবেন। আর যে লোক দেখানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কেয়ামতের দিন) দেখিয়ে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

আবার কেউ নেক আমল করে দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ই চায়। আল্লাহর সন্তুষ্টিও চায় আবার নিজেদের সুনামও চায়। এমন লোকদের ভালো কাজও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের আমল বরবাদ হয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন নবীজি।

 

জান্নাত–জাহান্নাম সম্পর্কে নবীজি এত বেশি আলোচনা করেছেন সাহাবীরা সর্বাবস্থায় চোখের সামনে তা দেখতেন। শুনতে শুনতে কল্পনায় এসে যেত। আখেরাতকে কামাই করার জন্য সর্বাবস্থায় সাহাবায়ে কেরাম সচেষ্ট ছিলেন। আর আমরা আখেরাত যে দিকে যাবে যাক। দুনিয়া নিয়ে পড়ে রইলাম। অথচ দুনিয়া যে দিকে যাবে যাক, আমার আখেরাত ঠিক রাখার কথা। আল্লাহপাক আমাদের সব আমলকে কবুল করুন। আমিন।

লেখক : ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/আরএ/এএইচ

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট