চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দুনিয়া কাজের-কবর ঘুমানোর, পরকাল আরামের না শাস্তির?

৪ নভেম্বর, ২০২২ | ২:৫৪ অপরাহ্ণ

নিশ্চয়ই চূড়ান্ত ফায়সালার একটি নির্দিষ্ট দিন রয়েছে। সেটি হলো কেয়ামত। এটি অবধারিত বিষয়। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে, একদিন ধ্বংস হবে। মহান আল্লাহ তায়ালার এই ঘোষণা চিরন্তন। পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করে সম্পদের ভিত্তিতে। আর আল্লাহর কাছে আমার, আপনার মূল্য সস্পদের ভিত্তিতে ও না বংশের ভিত্তিতেও না এবং ডিগ্রীর ভিত্তিতেও না। নেক আমলের ভিত্তিতে আল্লাহ মানুষকে মূল্যায়ন করবেন।

 

আল্লাহপাক আমাদের দুনিয়াতে হায়াত দেন আমল করার জন্য। দুনিয়া হলো কাজের, কবর হলো ঘুমানোর এবং পরকাল হবে আরামের। আপনি দুনিয়াতে আল্লাহ রাজি হয় এমন কাজ করতে পারলে কবরে আরামে ঘুমাতে পারবেন। পরকালে জান্নাতে আরাম করার সুযোগ পাবেন।

 

আল্লাহপাক তাই চূড়ান্ত ফায়সালার একটি নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ করেছেন। সেটি হলো কেয়ামতের দিন। ময়দানে হাশর। পৃথিবীতে মানুষ অন্যায় করে। একে অপরের হক নষ্ট করে। সবকিছুর হিসাব পরকালে আল্লাহপাক কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেবেন। সেখানে আপনি দেখতে পাবেন আপনার আমলের সাক্ষি আপনার আমলনামা। আপনার আমলের সাক্ষি ফেরেশতাগণ। আপনার ভাল-মন্দ সব আমলের সাক্ষি আপনার অঙ্গ-প্রতঙ্গ। কারণ সেদিন মানুষের মুখ বন্ধ করে দেবেন আল্লাহপাক। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাক্ষি দেবে।

 

সূরা ইয়াসিনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহপাক মুখ বন্ধ করে দেবেন। দুনিয়ায় মুখ বিভিন্ন মিথ্যা কথা বলেছিল। আল্লাহ মুখ এবং জিহবা বন্ধ করে দেবেন। মানুষের হাত কথা বলবে, পা কথা বলবে কোথায় গিয়ে সে অপরাধ করেছে। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যে কাজে ব্যাবহৃত হয়েছে সে সে কাজের সাক্ষ্য দেবে। ভাল-মন্দ সব আমলনামা মানুষ দেখতে পাবে। আল্লাহর হক, বান্দার হক সব সাজানো গোছানোভাবে মানুষ দেখতে পাবে।

 

মানুষ যখন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আমলানামায় দেখবে তখন তারা আশ্চর্য হয়ে চিৎকার দিয়ে বলবে, এই আমলনামার কি হলো? বড় বড় বিষয়গুলো যেমনি অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে, ঠিক তেমনি ছোটছোট বিষয়ও আনা হয়েছে। যে বিষয় আমরা গুরুত্ব দেয়নি সে বিষয়ও আল্লাহপাক আমালনামার মধ্যে একত্রিত করেছেন। তখন সে চিৎকার করবে এই অবস্থার মধ্যে আমার কি হবে? আল্লাহপাক ছোট-বড় সব বিষয়ের হিসাব নেয়ার জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

 

ইসরাফিল (আ.) কে যখন সৃষ্টি করলেন তখন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার জন্য সৃষ্টি করলেন। তার কাঁধের মধ্যে শিঙ্গা তুলে দিলেন। এবং বলে দিলেন ইসরাফিল তোমার আর কোন কাজ নেই। এই শিঙ্গা নিয়ে তুমি বসে থাক। যখন আমি আল্লাহ পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য চিন্তা করবো। তখন তোমাকে নির্দেশ দেব তখন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার জন্য।

 

আল্লাহর প্রিয় হাবিব বলেন, কেয়ামত যতদিন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা হবে না, সর্বশেষ ঈমানদার যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে তখন আল্লাহপাক ইসরাফিল (আ.) কে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া শুরু করতে বলবেন। প্রথম হালকভাবে শিঙ্গায় ফুঁ দিলে পৃথিবীর সমস্ত মানুষগুলো আতংকগ্রস্থ হয়ে যাবে।

 

পৃথিবীর হায়াত যখন শেষ হয়ে যাবে তখন আল্লাহপাক ইসরাফিল (আ.) কে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার নির্দেশ দেবেন। শিঙ্গার ফুৎকারের ফলে পুরো পৃথিবী প্রকম্পিত হবে। কম্পনের মাত্রা ও ফুৎকারের আওয়াজ উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। এত বিকট হবে ,যার ফলে সমস্ত প্রাণী প্রাণ হারাবে। জমিন ফেটে যাবে। পাহাড়-পর্বত উড়তে থাকবে ধূনিত তুলার মতো। টুকরো টুকরো হয়ে পড়বে গ্রহ-নক্ষত্র। সূর্য আলোহীন হয়ে যাবে। আসমান ভেঙ্গে পড়বে। সমুদ্র উত্তাল হবে। স্তন্য দানকারী ভুলে যাবে তার দুধের শিশুকে। গর্ভবতী গর্ভপাত করে দেবে। মানুষকে মনে হবে মাতাল। আসলে তারা মাতাল নয়। এই বিভিষিকাময় অবস্থার বিবরণ সকল নবী-রাসূল তার উম্মতকে দিয়েছেন। কিন্তু মহানবী (সা) এসে বলেছেন, কিয়ামত আসন্ন। আমি এই পৃথিবীতে শেষ রাসূল। তবে কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে তার সঠিক সময় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

 

দুনিয়াতে কর্মের প্রতিদান দেওয়ার নীতি কোন না কোনভাবে চালু আছে। তবুও এর পূর্ণ বিকাশ ঘটবে আখেরাতে। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে তার ভাল ও মন্দ কাজ অনুযায়ী পরিপূর্ণ প্রতিদান শান্তি ও শাস্তি প্রদান করবেন। অনুরূপ দুনিয়াতে অনেক মানুষ ক্ষণস্থায়ীভাবে কারণ-ঘটিত ক্ষমতা ও শক্তির মালিক হয়। কিন্তু আখেরাতে সমস্ত এখতিয়ার ও ক্ষমতার মালিক হবেন একমাত্র মহান আল্লাহ। সেদিন তিনি বলবেন, ‘‘আজ রাজত্ব কার?’’ অতঃপর তিনিই উত্তর দিয়ে বলবেন, ‘‘পরাক্রমশালী একক আল্লাহর জন্য।’’

 

তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন কেউ কারোর কোন কাজে আসবে না, কারোও সুপারিশ স্বীকৃত হবে না, কারোও নিকট হতে ক্ষতিপূরণ গৃহীত হবে না এবং তারা কোন প্রকার সাহায্যও পাবে না। যেদিন কেউ কারও কোন উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সকল কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর। এটা হবে বিচার ও প্রতিদান দিবস। আর তোমরা সেদিনের তাকওয়া অবলম্বন কর যেদিন কোন সত্তা অপর কোন সত্তার কোন কাজে আসবে না। কারো কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ হবে না এবং কোন সুপারিশ কারো পক্ষে লাভজনক হবে না। আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।

 

এসব আয়াত থেকে বোঝা যায়, আখেরাতে শাফা’আত বা সুপারিশ কোন কাজে আসবে না। মূলত : ব্যাপারটি এরকম নয়। এ আয়াতের উদ্দেশ্য শুধু কাফের মুশরিক, আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের জন্য কোন শাফা’আত বা সুপারিশ কাজে আসবে না। যেমন পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “আর আল্লাহ যার উপর সন্তুষ্ট নয় তার জন্য তারা সুপারিশ করবে না।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ২৮) আল্লাহ কাদের উপর সন্তুষ্ট নয় তা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করে বলেছেন, “আর আল্লাহ তার বান্দাদের কুফরিতে সন্তুষ্ট নন। (সূরা আয-যুমার: ৭) সুতরাং কাফেরদের জন্য কোন সুপারিশ নয়।

 

আর কাফেররাও হাশরের দিন স্বীকৃতি দিবে যে, তাদের জন্য কোন সুপারিশকারী নেই, তারা বলবে “আমাদের তো কোন সুপারিশকারী নেই” (সূরা আশ-শু’আরা: ১০০) তাদের সম্পর্কে আল্লাহ নিজেও বলেছেন, “সুতরাং সুপারিশকারীর সুপারিশ তাদের কোন উপকার দিবে না”। (সূরা আল-মুদাসসির: ৪৮)। এতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যারা কুফর, শিরক, নিফাক অবস্থায় মারা যাবে তাদের জন্য কোন শাফা’আত বা সুপারিশ নেই।

 

তবে আমাদের নবীর পর যেহেতু কোন নবী আসবে না, তাই তিনি কিয়ামতের বিবরণ দিয়েছেন স্ব-বিস্তারে। যেন মানুষ আখরাতের প্রস্তুতি নিতে পারে। নবী করিম (সা:) কেয়ামতের বেশ কিছু নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। নিদর্শনগুলো হলো-

* জালিমকে তার জুলুমের ভয়ে লোকজন সম্মান করবে।
* অপরাধী লোক সমাজের সর্দার হবে।
* মানুষ সরকারি মালকে নিজের মালের মতো ব্যবহার করবে।
* অন্যের আমানত খেয়ানত করবে।
* যাকাত দেয়াকে জুলুম মনে করবে। (নাউজুবিল্লাহ)
* আল্লাহকে রাজি করার জন্য নয়, মানুষ কোরআন, হাদিসের এলেম নিয়ে দুনিয়া কামাই করবে।
* মায়ের সাথে নাফরমানি করবে।
* বন্ধু-বান্ধবকে কাছে রাখবে, জন্মদাতা পিতাকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
* হত্যা ও মারামারি বৃদ্ধি পাবে। হত্যাকারী নিজেও জানবে না কেন সে হত্যা করল। ফিতনা-ফাসাদ চরম আকার ধারণ করবে। প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ বেড়ে যাবে।
* সুদ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে ।
* জিনা-ব্যভিচার ব্যাপকভাবে প্রকাশ পাবে।
* পুরুষ স্ত্রী’র তাবেদারি করবে।
* মসজিদে উচ্চস্বরে দুনিয়াবি কথাবার্তা হবে।
* গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র প্রচুর পরিমাণে বিস্তার লাভ করবে।
* পরবর্তী লোকেরা পূর্বপুরুষদের মন্দ বলবে।
* মদপান বাড়বে, ভূমিকম্প হবে, জমিন দেবে যাবে, লোকের রূপান্তর হওয়া, পাথর বর্ষিত হওয়া ইত্যাদি দেখা যাবে।

 

রাসুল (সা:) ফরমান “তোমরা অপেক্ষায় থাক। আরো অনেক বিপদ-আপদ এমনভাবে উপর্যুপরি আসতে থাকবে, যেমন তসবিহ মালা ছিঁড়ে গেলে দানাগুলো খসে পড়তে দেরি হবে না। তেমনি একর পর এক বিপদ আসতে থাকবে”।

 

কেয়ামতের আলামতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তীব্র ঠান্ডা ও দাবদাহসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। এতে করে মাঠঘাট যেমন ফসলহীন হয়ে পড়বে; প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার মরু অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টির কারণে ঘটবে এর উল্টোটা।
আল্লাহ আমাদের সকলকে এসব আজাব থেকে হেফাজত করুন। 

লেখক : ব্যুরােচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট