চট্টগ্রাম সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪

নবীজীর (স.) প্রতি ভালোবাসা

১৪ অক্টোবর, ২০২২ | ১২:১৯ অপরাহ্ণ

মোহাম্মদ নাম যতই যপি/ততই মধুর লাগে, নামে এতো মধু থাকে/ কে জানিত আগে…।’ (নজরুল)

মহান আল্লাহ তায়ালা আখেরী পয়গাম্বর, তামাম নবীকূল শিরোমণি গোটা সৃষ্টিকূলের রহমত, অনুকরণ, ভক্তি ও শ্রদ্ধার মূর্তপ্রতীক আমাদের প্রিয় নবীজি রাসুলে কারীম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। তাকে যথাযথ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্যেই আমাদের ঈমানের পূর্ণতা নিহিত। আর এ ঈমানের পূর্ণতা একজন মুসলমানের আমলে জিন্দেগীর সফলতা ও আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুলের পূর্বশর্ত।

খোদ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন: কুল ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিউনি। অর্থাৎ ওহে নবীজি হযরত মুহাম্মদ (স.)! আপনি জগতবাসীকে বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর, তোমাদেরকে আল্লাহ ভালবাসবেন….।’ রাসুলে খোদা (স.) নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন: কোন মুমিন প্রকৃত মুমিন কখনো হতে পারবে না যতক্ষণ না সে আমাকে তার পিতা, সন্তান (এমনকি) গোটা মানবমণ্ডলী থেকে অধিক ভালবাসবে।’ (তিরমিযী)।

আসলে যথোপযুক্ত ঈমান, ভক্তি, ভালবাসা ইসলামধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া পাওয়া। আমাদের সর্বাধিক ভালবাসা থাকতে হবে মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের প্রতি। তারপর নিঃসন্দেহে আমাদের নবীজীর (স.) প্রতি। নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’র (স.) প্রতি ভালবাসা, ঈমান ব্যতীত আল্লাহর প্রতি ভালবাসা অনর্থক।

রাসুলুল্লাহ (স.) মানবজাতির মধ্যে হতে আবির্ভূত হলেও তার শান ও মর্যাদা অতুলনীয়। আর তিনি অপরূপ হৃদয় আর চরিত্র ধারণ করেছিলেন যে, তাকে এক নজরে দেখে যে কোন মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ত, পাষাণ মানুষের হৃদয় হতো বিগলিত, এমনকি পশু-পাখি ও গাছপালা পর্যন্ত তার দর্শনের জন্য থাকতো ব্যাকুল। পরবর্তীতে তার ব্যক্তিত্ব ‘চরিত্র মাধুর্য্যে মুগ্ধ হয়ে’ তার পুত জীবনচরিত পড়ে আপ্লুত হয়ে তার আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে বিশ্বের অসংখ্য পণ্ডিত দার্শনিক।

ইসলামী শরীয়ত সু-শৃংখল জীবনব্যবস্থা। এখানে আল্লাহ ও তার রাসুলের (স.) প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। সর্বনিম্ন সীমারেখাতো আছেই। সর্বোর্ধ্বে রাসুলের ভালবাসা যেন আল্লাহর ভালবাসা ও মর্যাদা অতিক্রম না করে। কিন্তু এর মাঝখানে এক বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে নূরনবী (স.) কে ভালবাসার। এ ভালবাসার সাগরে ভেসেছে রাসুলের পূন্যাত্মা সাহাবীগণ (আল্লাহ তাদের সকলের উপরে তাই রাজী ও সন্তুষ্ট হয়েছেন)। পরবর্তী যুগে প্রকাশ পেয়েছে অযুত কোটি নবীপ্রেমিক আশিকে সাদিক।

আল্লাহতায়ালা তো কখনো নিজের সব সহায়-সম্পদ ত্যাগ করে নিঃস্ব হতে বলেন নি। কিন্তু হযরত আবু বকর (রাদি.) নবীপ্রেমে উৎসর্গ করেছিলেন তার সমূদয় সম্পদ, নিত্যব্যবহার্য পারিবারিক-সাংসারিক দ্রব্যাদিও। এসব দেখে নবীজী (স.) নিজেও আশ্চর্যাম্বিত হন এবং বিচলিত হয়ে জানতে চেয়েছিলেন: আবু বকর! তোমার ঘরে আর কিছু রাখনি? বললেন: আল্লাহু ওয়া রাসূলুহু আমার ঘরে এখন কেবল আল্লাহ ও তার রাসুলই…. …।’ এ ধরনের সীমার মধ্যে অসীম ভালবাসার কারণেই আবু বকর (রাদি.) এ উম্মতের মধ্যে রাসুল (স.) এর পর সবচে’ মর্যাদাশীল ও সম্মানিত। বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্তও। সে যুগে রাসুলবন্দনার কারণে হযরত হাম্মান বিন সাবিত (রাদি.) ভূষিত হয়েছিলেন শায়িরুর রাসুল বা ‘রাসুলের (স.) কবি’ হিসেবে।

শুধু মানবজাতি কেন, তামাম কায়েনাত মাখলুকাত সৃষ্টিকূল নবীজীর স্মরণে হয়ে থাকে ধন্য। ইশকে আল্লাহ ইশকে নবী, ইশকে কাবা মদীনা শরীফ বাংলাভাষী প্রতিটি হৃদয়তন্ত্রে উতনে দেনেওয়ালা কবি নজরুল (যাকে একসময় এক শ্রেণির আলিম-ওলামা কাফির বলতেন) বুলবুলি পাখির কণ্ঠে সুমধুর সুর প্রকাশ হওয়ার রহস্য খুঁজে পেয়েছেন।

তিনি বলেছেন, নিশ্চয় বুলবুলি নবীজীর ‘মুহাম্মদ’ নামের দরুদ জপেই সুকণ্ঠী হয়েছে। তার ভাষায়- ‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি/বুলবুলি তুই আগে তাই কিরে/তোর কণ্ঠেরই গান/এতোই মধুর লাগে……।’
এ বিশ্লেষণ তার কবিত্বের চোখে, তার প্রেমিকদর্শনের। তার এ অভিব্যক্তি আমি শরীয়ত বলব না, তবে ইবাদত ও নিখাদ নবীপ্রেমের বা সাওয়াবের মাধ্যম বলতে আমার দ্বিধা নেই।

ইসলাম কখনো হিকমতা বা বুদ্ধিভিত্তিক প্রচার, মাওয়ায়িজ- উত্তম আলোচনা ও উপমার মাধ্যমে আকৃষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করেন নি। বস্তুত:পক্ষে একজন প্রকৃত মুসলমান যখন সারাদিন শিরক করেনা, মুনাফেকী করে না জঘন্য বিদআতে লিপ্ত হয় না, তখন সে যেসব সুচিন্তা লালন করে সুস্থ ও শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে সবই ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। যেমন হাদিস শরীফে আছে, কেউ যদি ইশা’র জামাত পড়ে ঘুমায় সে অর্ধরাত ইবাদতের সাওয়াব পায়। আর যখন পরবর্তী ফজরের জামায়াতেও সামিল হয় তাহলে পুরো রাতের নফল ইবাদতের সাওয়াব পায়, (তিরমিযী)।

সুতরাং যদি শিরক জাতীয় কিছু না থাকে, উপরন্তু যেখানে থাকে আল্লাহর স্মরণ নবীজীর (স.) দরুদের আয়োজন তা নিঃসন্দেহে ইবাদত। এ দিক দিয়ে মিলাদ শরীফ একটু উত্তম নফল ইবাদত। মিলাদ শরীফে কি করা হয়? এতে আমরা হাদীসে বর্ণিত দোয়াসমূহ পড়ি, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করি, প্রয়োজন ও সময় অনুপাতে বিভিন্ন বরকতপূর্ণ আয়াত ও সূরাসমূহ তিলাওয়াত ও বিশ্লেষণ করি, ময়-মুরব্বীদের জীবন স্মরণ করে আখিরাত সম্পর্কে শিক্ষা হাসিলের চেষ্টা চালাই, হযরত রাসুলে কারীম (স.) এর শানে ভক্তির সাথে সালাতো সালাম নিবেদন করি, আখের আঞ্জাম দু’হাত তুলে পরওয়ার দিগার রাব্বুল আলামিনের দরবারে কুরআনের বর্ণিত আয়াত, হাদীসে বর্ণিত দোয়া ও পূন্যাত্মা বুজুর্গদের শেখানো তরীকায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোনাজাত করি। এখানে কোন বিষয়টি সাওয়াবের সাথে সম্পৃক্ত নয়?

আর সব’চে বড় কথা, বিভিন্ন দেশে এধরনের মাহফিল আল্লাহতায়ালাকে ডাকা ও স্মরণ করা এবং নবীজীর জীবনকথা ও তার প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের একটি খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। এর মাধ্যমে সাধারণ মুসলমান খুব দ্রুত ধর্ম-কর্ম পালনে উদ্বুদ্ধ হয়।

সুতরাং যা আমাদের দ্বীনের পথে দ্রুততার সাথে উদ্বুদ্ধ করে এমন হিকমতপূর্ণ অনুষ্ঠানাদির বিরোধিতা করা কি উচিৎ! নবীজীর শানে নাত, দরূদ প্রভৃতির বিরোধীতা করার জন্য আমাদের কেউ কেউ যেমন কোমড় বেঁধে নামেন, অন্যান্য সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী কৃষ্টি কালচার ও অনুষ্ঠানমালা দমানোর জন্য তো সেভাবে মাঠে ময়দানে প্রতিবাদমুখর দেখি না।

লেখক : অধ্যাপক,টিভি উপস্থাপক ও

জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট