চট্টগ্রাম রবিবার, ১২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

জন্মদিনে রোজা রাখতেন মুহাম্মদ (সা.)

নাসির উদ্দিন

৮ অক্টোবর, ২০২২ | ১:৩৫ অপরাহ্ণ

আরবি রবিউল আউয়াল বরকতময়, মহিমান্বিত মাস। এই মাস মুসলিম উম্মার জন্য আনন্দ এবং বেদনা দুটোই বয়ে নিয়ে এসেছে। আল্লাহপাক সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ  নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে এই মাসে দুনিয়াতে পাঠান। আবার এই মাসে উম্মতকে এতিম করে বিদায় নেন প্রিয় নবী।

এক হাজার ৪৫২ বছর আগে আরবের মরু প্রান্তরে মা আমিনার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। সোমবার সুবহে সাদেকের সময় মক্কাতুল মোকাররমায় নবীজির জন্ম। নবীজির পিতা হযরত আবদুল্লাহ, মা হযরত আমেনা। দুধ মা হালিমা। নবীজি জন্মের আগেই মারা যান পিতা আবদুল্লাহ। তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন তৌহিদের মহান বাণী নিয়ে। প্রচার করেছেন শান্তির ধর্ম ইসলাম।

নবীজির শুভাগমন এবং বিদায়ের মাস রবিউল আউয়াল। জন্ম দিন সোমবার। এ নিয়ে কারো দ্বি-মত নেই। কিন্তু কোন তারিখে নবীজির শুভাগমন তা নিয়ে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ আছে। ওলামায়ে কেরামদের মধ্যে কারো মতে ৮, কারো মতে ১০, আবার কারো মতে ১২ রবিউল আউয়াল নবীজির শুভাগমনের তারিখ। কিন্তু এসব মতের মধ্যে প্রসিদ্ধ মতামত ১২ রবিউল আউয়াল। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায়ও নেন ১২ রবিউল আউয়াল। এতে কারো মতভেদ নেই।

অর্থাৎ রাসুল (সা.) এর জন্ম দিন ও মৃত্যু দিন একই দিনে। যেহেতু জন্ম দিন ও মৃত্যু দিন একই দিনে, সেহেতু মুসলিম সমাজের জন্য এটি একই সাথে যেমন আনন্দের আবার তেমনি কষ্টদায়ক। আর এই কারনেই অনেকেই এই দিনে আনন্দ উৎসব পালন করেন না ও পালনে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। আমাদের বাংলাদেশে এই দিনটাকে মিলাদুন্নবী হিসেবে বলা হলেও অন্যান্য জায়গায় অন্যান্য নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অনেকে এই দিনটাকে নবী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুরও অনেক পরে থেকে মিলাদুন্নবীর প্রচলনে ঘটে। মহানবী (সা.) এর জীবদ্দশায় ও সাহাবিদের সময়কালেও এই ঈদে মিলাদুন্নবী নামে কোন কিছুই ছিল না। মোহাম্মদ (সা.) প্রতি সোমবার করে রোজা রাখতেন । তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন, সোমবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেছেন, এই দিনেই তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন এবং কোরআন শরীফ এই দিনেই তাঁর উপর নাজিল হয়েছে। আর সেই কারনেই শুকরিয়া স্বরুপ এই দিনে রোজা রাখতেন।

এছাড়াও প্রতি সোমবার রোজা রাখার পেছনে আরেকটি কারন উল্লেখ করে রাসুল (সা.) বলেন –“ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমল উপস্থাপন করা হয় আল্লাহর কাছে। আর আমার আমল উপস্থাপন করার সময় রোযারত থাকাকে পছন্দ করছি।” এ জন্যে সোমবার রোজা রাখা সুন্নত। আরবের মধ্যে এই রোজার খুব প্রচলন আছে। আমাদের দেশেও অনেকে রোজা রাখেন। উৎসবের চাইতে এটি অনেক বড় ফজিলতের কাজ। 

ঈদে মিলাদুন্নবী ৪র্থ হিজরি থেকে শুরু হলেও এটি আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ৭ম হিজরিতে। তাই এটা বলা যায় রাসূল (সা.), সাহাবী গনদের সময়ে কোন ঈদে মিলাদুন্নবী বলতে কিছুই ছিল না। এই ৭ম হিজরি ছিল ইসলাম পরবর্তী বর্বর যুগ। এই যুগে মুসলিমগণ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল আর তাদের মাঝে প্রায়ই গৃহযুদ্ধ লেগে থাকত।

ঈদে মিলাদুন্নবীর স্বপক্ষে দলিলঃ এখন, যারা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেন ও এটিকে সমর্থন করেন তাদের দেওয়া কিছু যুক্তি হলো। আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে বলেন।

“আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে খুশি পালন কর, যা তোমাদের সমস্ত ধন দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়।” – (সূরা ইউনুস-৫৮)।

অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি নিশ্চয় আপনাকে পুরো বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি”।

তো এখান থেকে বোঝা যায় যে, যেহেতু এই দিনে রাসুল (সা.) এর আগমন ও নবুয়ত প্রাপ্তি হয়েছে তাই আমরা চাইলেই এই দিনটাকে ঈদ হিসেবে পালন করতেই পারি। কিন্তু সমস্যা হলো এই একই দিনে আবার রাসূল (সা.) ওফাত বরন করেন। তাহলে যেদিন আমাদের রাসুল (সা.) মৃত্যু বরন করলেন সেইদিনে কিভাবে একজন মুসলিম হিসেবে আপনি আনন্দ উৎসব করতে পারেন?

তাই এই দিনে আনন্দ মিছিল ও উৎসবের আয়োজন করা একেবারেই যুক্তিহীন। আমরা চাইলে অবশ্যই এইদিনে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাঃ এর জন্ম ও মৃত্যুদিন হিসেবে ইবাদত বন্দেগি করতেই পারি, চাইলেই রোজাও রাখতে পারি, তার জীবনি নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এইসব বিষয় নিয়ে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু আমাদের উচিত না কোন বিষয় নিয়েই বাড়াবাড়ি করা। কেননা রাসূল (সা.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।

নবীজির জন্মের সময় পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকগুলো আর্শ্চজনক ঘটনা ঘটে । সেই সময় পরাশক্তি ছিল রোম সম্রাট ও পারস্য সম্রাট। পারস্য সম্রাট ছিল অগ্নি পূজারী। পারস্য সম্রাট বিশাল প্রাসাদের মধ্যে থাকতেন। যেইদিন ভোরে প্রিয় নবীজির জন্ম হয় ওই সময় পারস্য সম্রাটের বিশাল প্রাসাদ থর থর করে কেঁপে উঠে। ‘আইওয়ানে খিসা’ নামের এই প্রাসাদের অনেক দামি ১৮টি পাথর খসে পড়ে।

ওই সময়ে সম্রাট স্বপ্ন দেখেন, আরব থেকে একটি তেজী ঘোড়া একদল উটকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে এবং ফোরাত নদী পার হয়ে সারা পৃথিবী গ্রাস করে ফেলছে। লোকেরা জানালো, পারস্য সাম্রাজ্যের হাজারো বছরের প্রজ্বলিত অগ্নি মশাল হঠাৎ নিভে গেছে। তিনটি আশ্চর্যজনক ঘটনায় সাম্রাজ্যে তোলপাড়।

বড় বড় পাদ্রিদের ডাকা হল। ওই সময়ের আসমানি কিতাব খুলে তারা দেখলো আখেরী নবী যিনি হবেন, তাঁর শুভাগমনের আলামতগুলো মিলে যাচ্ছে। তারা সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে পৌছাল নিশ্চয়ই আরবের কোন এলাকাতে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে। একজন  পাদ্রি পাঠানো হলো মক্কায়। ওই ভোরে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে কিনা তা যাছাইয়ের জন্য। আবদুল্লাহ আগেই মারা গেছেন। খবর নিয়ে দেখল, আবদুল মোত্তালিবের ঘরে একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে।

পাদ্রি বললো: আমি একটু পিঠ দেখবো। তখন নবীজিকে উল্টে পিঠ দেখানো হল। পিঠ দেখার সাথে সাথে জ্ঞান হারান পাদ্রি। পরে যখন তার জ্ঞান ফিরল। তখন জানালেন: “আমি পিঠে দেখলাম দুই বাহুর মাঝখানে খতমে নব্যুয়তের মোহর’। এবং আমি বুঝতে পারলাম যে, যেমন তেমন শিশু নয়, ইনি হলেন-কুল কায়েনাতের সর্দ্দার আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)”। মোহরে নব্যুয়ত দেখে নিশ্চিত হন পাদ্রি।

বনি ইসরাইলের সালেম গোত্রের লোকরা মূর্তি পূজা করতো। গোত্র সর্দার ছিল আব্বাস। আব্বাস নিজে ‘দেমাহ’ নামের একটি মূর্তি তৈরী করে তার উপাসনা করত। তার মৃত্যুর পর ছেলে মেরদাসকেও মূর্তিটির উপাসনা করার জন্য অসিয়ত করে যান। একদিন মেরদাস দেখেন মূর্তি আরবিতে কথা বলছে। মেরদাস তোমার গ্রামের লোকদের বলে দাও, মূর্তি পূজার দিন শেষ। মসজিদ ওয়ালার দিন এসে গেছে। নবী মুহাম্মদ এসে গেছেন, দুনিয়াতে সবার জন্য রহমতস্বরূপ।

মিলাদুন্নবীর অর্থ হলো- নবীজির জীবন সম্পর্কে আলোচনা করা। নবীজির সুন্নতকে মজবুত করে ধারণ। এ মাসে নবীজিকে নিয়ে আলোচনা করা মোস্তাহাব। সাহাবীরা বলেন, কেয়ামত পর্যন্ত যিনি নবীজির সুন্নতকে মজবুতভাবে আকড়ে ধরবেন এবং সে মোতাবেক আমল করবেন আল্লাহ তার জন্য রহমত এবং বরকতের সব দরজা খুলে দিবেন। এখন দেখা যায় অতিরঞ্জন। রবিউল আউয়াল মাসে যে যত বড় ডেক পাকাবে সে তত বড় সুন্নী। ইসলাম খানা-পিনার মধ্যে মজে আছে। কেউ মারা গেলে লাশ দাফন করার আগেই চুলায় ডেকসি বসানো হয়। পীর,আউলীয়া, মাজারসহ নানা দরবারের নামে চলে খানা। ইসলাম যদি খানা-পিনার মতো এত সহজ হতো, তাহলে তখন সাহবায়ে কেরাম পেটে পাথর বাঁধতেন না। আবু হুরায়রা (রা.)বলেছেন, অনেক সময় না খেয়ে খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছি। নবীজিকে নিজ চোখে দেখেন, না খেতে খেতে পেটে দুটি পাথর বাঁধতেন।

নবীজি-সাহাবায়ে কেরাম কিভাবে সুন্নত পালন করতেন। কয়দিন পর কেউ হয়তো কেককাটা শুরু করবে। নাউজুবিল্লাহ। অনেকে আবার নবীজির দাঁড়ি, চুল মোবারক ইত্যাদি দেখিয়ে প্রতারণা করেন। নবীজির জিনিস কি এত সস্তা। যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। নবীজির প্রত্যেকটি জিনিস তাঁর অভিভাবক আল্লাহপাক হেফাজত করেছেন। ইসলাম যদি এত সহজ হতো তাহলে সাহাবায়ে কেরাম গোশত খেয়ে খেয়ে ইসলাম কায়েম করতেন। নবীজির সুন্নতের উপর চলা ইসলাম। নবীজির সুন্নতের উপর আমল করা প্রকৃত আশেকে রাসূল। ডেক পাকাইয়া খাওয়া ইসলামে নেই। এসব ইসলামের কলংক। আল্লাহপাকে আমাদের সকলকে বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।

ব্যুরোচিফ,বাংলাভিশন,চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট