চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

কারবালা যুদ্ধের খলনায়কদের করুণ পরিণতি

৭ আগস্ট, ২০২২ | ৪:৫৮ অপরাহ্ণ

কারবালার প্রান্তরে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত হোসাইন (রা) একাই লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা হয়। পাপিষ্ঠ শিমার তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে প্রেরণ করা হয়। ইমামের খণ্ডিত মস্তক দেখে ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। একমাত্র ছেলে হজরত জায়নুল আবেদিন ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর ও মহিলাসহ সবাই একে একে শাহাদাত বরণ করেন। এই যুদ্ধে হোসাইন (রা)সহ ৭৮জন বীর সৈনিক শাহাদাত বরণ করেন। এর মধ্যে নবী পরিবারের শহীদ হন ২৭জন। হোসাইন (রা:) এর দেহ কারবালায় আর মাথা দামেস্কে। দুই জায়গায় কবর।

ইয়াজিদকে অনেকে কাফির বলে। একজন মানুষ কাউকে যদি হত্যা করে এই কারণে কাফির হয় না। কাউকে হত্যা করলে সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ, ফাসিক হবেন। কাফির হওয়ার জন্য শিরক করতে হয়। কোন আকীদা অস্বীকার করতে হয়। আকিদা অস্বীকার কিংবা শিরক করার প্রমাণ নেই। কবিরা গুনাহ হত্যার মধ্যে সে লিপ্ত। পাপিষ্ঠ বলা হবে। যুগে যুগে অনেক দেশে মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করেছে। আল্লাহর প্রিয় হাবিব হাদীসে এটা বলেছেন,“তোমরা এক অপরকে হত্যা করবে। তবেই জাহান্নামী হবে এই কারনে”।কোন মুসলমানকে হত্যা করা তার জন্য বৈধ মনে করলে আকিদা নষ্ট হবে। তখন কাফির হয়ে যাবে। হযরত ঈমাম ইবনে হাম্বল (রা) এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, এমন কিছু মানুষ দেখা যায়, যারা ইয়াজিদকে মহব্বত করে। তাদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তখন তিনি বললেন, সত্যিকার মুমিন, নবী প্রেমিক ইয়াজিদকে কখনো মহব্বত করতে পারে না। তাহলে আপনি তাকে লানত কেন করেন না। ইয়াজিদের মতো আরো হাজার বাকি আছে আমিতো তাদের লানত নির্দিষ্টভাবে করিনি। এভাবে করি হত্যাকারীদের উপর আল্লাহর লানত। জালিমদের উপর লানত। মিথ্যুকদের উপর লানত।

ব্যাপকভাবে লানত করা কোরআন-সুন্নাহ’য় এসেছে। কোন নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে লানত করা আসেনি। এটা নবী করতে পারেন। কারণ-তিনি জানেন ইয়াজিদের মৃত্যু কুফরি অবস্থায় না ঈমান অবস্থায় হয়েছে। আমরা জানবো না, কার মৃত্যু কি অবস্থায়। আপনি আজীবন মদ পান করে মৃত্যুর সময় তওবা করেছেন কিনা, এটা আমি জানি না। তাই ব্যাক্তিগত লানত করা বৈধ নয়। হতে পারে আপনার শেষ মুহূর্তে এমন কোন আমল পাওয়া গেছে যেই কারনে আপনি জান্নাতি হয়ে গেছেন।

মানুষ ৪ প্রকার। ১. লাওহে মাহফুজে জান্নাত লেখা আছে, দুনিয়াতেও জান্নাতি আমল করছেন। ২. লাওহে মাহফুজে জাহান্নামি লেখা আছে, দুনিয়াতেও জাহান্নামি আমল করছেন। ৩.লাওহে মাহফুজে লেখা আছে জান্নাতি, তিনি জাহান্নামি আমল করছেন। ৪. শেষ মুহূর্তে এমন একটি আমল করল, যার কারনে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। ঠিক এর বিপরীতে লওহে মাহফুজে লেখা আছে জাহান্নামি, কিন্তু দুনিয়াতে আমল করছেন জান্নাতি। শেষ মুহূর্তে এমন একটি আমল করল, যার কারনে তিনি জাহান্নামি হয়ে গেলেন। শেষ পরিণতি ভাল যার, সব ভাল তার।

যারা হোসাইন (রা)এর বাহিনীকে শহীদ করেছেন তাদের উপর আল্লাহর লানত। তাদের উপর আল্লাহও প্রতিশোধ নিয়েছেন। ইয়াজিদের এই জয়লাভ বেশি দিন টিকে থাকেনি। মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। এর কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যু হয় ইয়াজিদ পুত্রের। কারবালার এই মর্মান্তিক হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই কুফার গভর্ণর মুখতার সাকাফির বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এরপর ইয়াজিদের বংশের কেউ শাসন ক্ষমতা লাভ করেনি।

কারবালার ঘটনায় যারা কাজ করেছে তারা ইতিহাসের পাতায় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবারবর্গ শাহাদাতের পরপরই ঐসব নেপথ্য নায়কদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

ইয়াজিদ: ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনার মূল নায়ক ইয়াজিদ। ইয়াজিদের নির্দেশেই কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেনকে শহীদ করা হয়। কারবালার যুদ্ধের পর মুসলিম দুনিয়ায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। বিশেষ করে মক্কা-মদীনার অধিবাসীগণ ইয়াজিদের এহেন কুকর্মের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে লাগল। ইতোমধ্যে ইয়াজিদ বাহিনী মক্কা-মদীনা আক্রমণ করে বহুসংখ্যক লোককে শহীদ করল। ইয়াজিদ এক অজ্ঞাত রোগে মারা যায়। তার অনুসারীরা রাতের আঁধারে অজ্ঞাত স্থানে কবর দিয়াছিল। আজ পর্যন্ত কেউ ইয়াজিদের কবরের সন্ধান পায়নি। ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তার ছেলের হাতে লোকেরা বাইয়াত গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করল। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। এরপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ৪০ দিন পর মারা যায়।

মুখতার সাকাফীর প্রতিশোধ গ্রহণ: ইয়াজিদের মৃত্যুর পর মারওয়ান ক্ষমতা দখল করল। এর পরপরই মক্কা-মদীনা ও কুফাসহ সমগ্র আরব বিশ্বে বিদ্রোহ চরম আকারে দেখা দিল। কুফাবাসীরা বেশি অনুতপ্ত ছিল। কেননা তাদের বিশ্বাস-ঘাতকতার ফলে এহেন হূদয়বিদারক ঘটনা ঘটল। তারা ভাবল, কিভাবে এর প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। কুফার গভর্ণর ইবনে যিয়াদ পালিয়ে দামেস্কে চলে যায়। মুখতার সাকাফী কুফার গভর্ণরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুখতার সাকাফী ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের বদলা নেয়ার জন্য ডাক দিলো। সাথে সাথে সমগ্র কুফাবাসী তার আহবানে সাড়া দিল। শুরু হলো প্রতিশোধ নেয়ার পালা।

আমর বিন সাদ ও তার ছেলে: সর্বপ্রথম পাপিষ্ঠ আমর বিন সাদকে তলব করা হলো, যে ইয়াজিদের বর্বর বাহিনীর সেনাপতি ছিল এবং তারই পরিচালনায় কারবালায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তার ছেলে এসে বলল, আমার পিতা এখন সবকিছু ত্যাগ করে নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছে। তিনি ঘর থেকে বের হন না। সাকাফী কোন অজুহাত গ্রহণ করলেন না। তারপর তাকে ধরে এনে পিতা-পুত্রের মাথা কেটে মদীনা শরীফে মুহাম্মদ বিন হানফিয়ার কাছে পাঠিয়েছিল।

হাওলা বিন ইয়াজিদ: হাওলা বিন ইয়াজিদ হোসাইনের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল।

শিমার: শিমার ইমাম হোসেনের গলায় ছুরি চালিয়েছিল। মুখতার সাকাফী যখন ইমাম হোসেন (রা.)-এর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী এক একজনকে হত্যা করছিল তখন পাপিষ্ঠ শিমার কুফা থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। এ পাপিষ্ঠের শেষ রক্ষা হয়নি। সে মুখতার সাকাফীর বাহিনীর হাতে ধরা পড়ল। তাকে দু’ টুকরা করে মুখতার সাকাফীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং লাশ কুকুরকে খাওয়ানো হয়েছিল।

হাকিম বিন তোফায়েল: এই নরাধম, যে হযরত আব্বাস (রা.)-এর শরীর থেকে পোশাক খুলে নিয়েছিল এবং ইমাম হোসাইনের প্রতি তীর নিক্ষেপ করেছিল, তাকেও হত্যা করা হয়েছিল এবং তার মাথা বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে মুখতার সাকাফীর সামনে আনা হয়েছিল।

যায়েদ বিন রেকাত: এই জালিম, যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে আকিল (রা.)-এর কপালে তীর নিক্ষেপ করেছিল। তাকে ধরে এনে জীবিত জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল।

আমর বিন সবী: এই আমর বিন সবী, যে গর্ব করে বলে বেড়াত ‘‘আমি হোসাইনের কোন সাহাবীকে হত্যা করার সুযোগ পাইনি বটে, কিন্তু তীর নিক্ষেপ করে অনেককে যখম করতে সক্ষম হয়েছিলাম। একে ধরে সকলের সামনে বর্শার আঘাতে হত্যা করা হয়েছিল।

নরাধম ইবনে জিয়াদের করুণ পরিণতি: ইয়াজিদের পর এই নরাধম ইবনে জিয়াদ সবচেয়ে জঘন্য অপরাধী। কারবালার ঘটনার সময় এই ব্যক্তি কুফার গভর্ণর ছিল। মুখতার সাকাফী এই নরাধমকে হত্যা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। সে ইব্রাহিম বিন মালেক আলতাবকে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী ইবনে জিয়াদকে পরাস্ত করার জন্য প্রেরণ করল। ‘মুসল’ শহরের নিকটে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে ইবনে জিয়াদের বাহিনীর পরাজয় ঘটে। ইবনে জিয়াদ পলায়নকালে ইব্রাহিম মালেকের সৈন্যবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ইব্রাহিম মালেককে সৈন্যরা ইবনে জিয়াদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়। মাথা বর্শার অগ্রভাগে তুলে কুফায় নিয়ে আসে।

তখন সাকাফী কুফাবাসীর উদ্দেশ্য করে বলে, ‘‘দেখ আজ থেকে ছয় বছরে আগে এই দিনেই এই জায়গায়, এই জালিমের সামনে ইমাম হোসাইন (রা)-এর মস্তক রাখা হয়েছিল। আজ আমার সামনে সেই জালিমের মাথা রাখা হয়েছে’’। এভাবে মুখতার সাকাফী কারবালার শহীদদের পবিত্র রক্তের যথাযথ বদলা নিয়েছিলেন। ফলে ৯২ বছর উমাইয়া শাসনের পর আব্বাসীয় খিলাফত ফিরে আসে।

কারবালা ট্রাজেডি থেকে হকের উপর অটল থাকার শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন আল্লাহপাক।

পূর্বকোণ/আর/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট