আরবী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহররম। এ মাসের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। বিশ্ব ইতিহাসের অনেক উত্থান-পতন ও বিপ্লবী স্রোতধারার জলন্ত সাক্ষী পবিত্র আশুরা। তাই মানবজাতির জীবনে এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
হাদীস শরীফের মাধ্যমে জানা যায়, আশুরা’র দিনে আল্লাহসুবহানাহু তায়ালা আসমান-যমিন, পাহাড়-পর্বত, তারকারাজী, আরশ-কুরসি, লওহে মাহফুজ ও ফেরেস্তাদের সৃষ্টি করেন। এ’দিন আদম (আ.) সহ দু’হাজার পয়গাম্বর ওফাত প্রাপ্ত হন। হযরত আদম হাওয়ার তাওবা কবুল হয়েছিল এদিনে। আর অঝোর ধারায় রহমতের বৃষ্টির সূচনা হয়েছিল এ দিনে, পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এদিনে। আঁ-হযরত (স.) কে এদিনেই চিরতরে নিষ্পাপ ঘোষণা করা হয়েছিল।
এছাড়া আরো অসংখ্য মহিমাময় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এদিনে ঘটিত হয়েছে। সে সবের উল্লেখ না করলেও বলা যায়, একেকদিন হিসেবে এর থেকে স্মরণীয় দিন মানব ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। উম্মতে মুহাম্মাদীর জীবনে এদিনটি একটি বিশেষ কারণে অবিস্মরণীয়। ৬১ হিজরীর এ দিনে নূর-নবীর দৌহিত্র হযরত আলী-ফাতেমার প্রাণের দুলাল হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি.) ও নবী পরিবারের প্রায় সকল পুরুষ সদস্য কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ করেন।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সম্পাদিত চুক্তির মোতাবেক হযরত মুয়াবিয়া (রাদি.) এরপর ইমাম হুসাইন (রাদি.) এর খিলাফত লাভের কথা স্বীকৃত হলেও হযরত মুয়াবিয়া স্বেচ্ছাচারিতা করে তার অযোগ্য পুত্র ইয়াযিদকে ৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তরাধিকার নিযুক্ত করেন। পরের বছর তিনি ইন্তেকাল করেন। খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে ইয়াজিদ হোসাইনকে তার বশ্যতা স্বীকার করার নির্দেশ দিয়ে এক পত্র প্রেরণ করেন। দুশ্চরিত্র মদ্যপায়ী ইয়াজিদের অবৈধ ক্ষমতারোহন ও এর যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে ন্যায়নিষ্ঠ সৎ অকপট বীরপুরুষ শীর্ষস্থানীয় সাহাবাদের সমর্থন লাভে ধন্য জনপ্রিয় ইমাম হুসাইন ইয়াজিদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং ইয়াজিদের উত্তরাধীকারকে মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ বলে অবিহিত করে প্রতিবাদ করেন। মক্কা-মদীনায় তার খিলাফত লাভ ন্যায়সঙ্গত বলে প্রবল জনমত গঠিত হয়। কুফাবাসীও তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁকে কুফা সফরের আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম হুসাইন স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সপরিবারে কুফার পথে রওনা হন। ইতিমধ্যে কুফাবাসী ইয়াযীদী বাহিনীর যুগপৎ ভয় ও প্রলোভনে ইমাম হুসাইন থেকে সমর্থন উঠিয়ে নেয়।
কুফাবাসী ইয়াযিদের পক্ষে যোগদানের খবর শুনে বিচলিত না হয়ে তিনি রাজধানীর সন্নিকটে উপনীত হলে প্রতিপক্ষের তামীম গোত্রের লোকেরা বাঁধা দান করে। অগত্যা ফোরাত নদীর উপকণ্ঠে কারবালায় ইমাম হুসাইন তাঁবু ফেলেন। এরপরই ইয়াযিদ সেনাধ্যক্ষ ওবাইদুল্লাহ নবীজীর দৌহিত্র ও তার সঙ্গীদের অবরোধ করেন। এমনি মুহূর্তে রক্তপাত বন্ধের জন্য হুসাইন তিনটি প্রস্তাব দেন। তাঁকে মদীনায় রিটার্ন করতে সুযোগ দেয়া হোক নতুবা তুর্কী সীমান্তের দূর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক অথবা ইয়াজিদের সাথে আলোচনা করার জন্য তাকে দামেস্কে প্রেরণ করা হোক। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইমাম হোসাইনকে বিনাশর্তে আত্মসমপর্ণ করতে আদেশ দেন। সত্যের আপোষহীন সংগ্রামীপুরুষ তা দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন।-‘শির দেগা নাহি দেগা আমামা ….।’
৬৮০ সালের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন এবং ইয়াজিদ বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ইমামের সাথে সব মিলিয়ে মাত্র ৭৩ জন ভক্ত-অনুরক্ত আর ইয়াজিদ বাহিনীর সংখ্যা ৬ হাজার। ইয়াজিদ সেনারা ইমামের বাহিনীকে ফোরাত নদীর পানি হতে বঞ্চিত করলে তাদের শিবিরে পানির হাহাকার পড়ে যায়। এ যুদ্ধে ভ্রাতুস্পুত্র কাশেম প্রথম শাহাদাত বরণ করেন এবং পরে ইমাম হুসাইনের ৭২ সঙ্গী একে একে শহীদ হন। তারপর পিপাসার্ত ইমাম হোসাইন পুত্র আসগরকে নিয়ে নদীতে পানি পানে অগ্রসর হলে আসগর শরবিদ্ধ হন। অল্পক্ষণপর অন্য একটি শরের আঘাতে ইমাম হুসাইনের বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়।
পিশাচ সীমার তাঁর শিরচ্ছেদ করতে উদ্যত হলে ইমাম হুসাইনের নির্দেশে তাঁর ঘাড় মোবারকের উপর তরবারী চালিয়ে পবিত্র মস্তক বিচ্ছিন্ন করে। এভাবে আশুরার দিনে আল্লাহর পেয়ারা হাবীবের দৌহিত্র, মহাবীর আলীর পুত্র শাহাদাতের অমীয় শরবত পান করেন।
সালিহ নবী (আ.) আল্লাহর রাহে উট কোরবাণী দিয়েছিলেন, হযরত ইব্রাহীম পুত্র সন্তান কুরবাণী দেন। আখেরী নবী দ্বীন ইসলামের জন্য কোরবানী দিয়েছেন পুরো বংশ, হযরত ফাতিমা উৎসর্গ করেছেন উম্মতের শ্রেষ্ঠ সন্তান হযরত হাসান হুসাইনকে। হযরত হুসাইন তার নানাজীর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপন ভক্ত-অনুরক্তসহ জীবন বিলিয়ে দেন। হযরত হুসাইনকে যেরূপ নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়, মানব ইতিহাসে সে রকম হত্যার ঘটনা বেশী নেই। তেমনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ইমাম যে সাহসিকতা, নির্ভিকতা, ত্যাগ ও নিষ্ঠার নজির তুলে ধরেন তাও সুলভ নয়। হযরত ইমাম হুসাইনের এই মর্মন্তুদ পরিণতি সারাবিশ্বের মুসলমানকে শোকে-দুঃখে মুহ্যমান করে তোলে, তেমনি সত্য প্রতিষ্ঠাকামী মানুষের কঠোরতম সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে মহত্তর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে।
খ্রিস্টান লেখক ও ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গীবন ডিকলাইন এ্যান্ড ফল অব দ্য রোসান এম্পায়ার নামক বিখ্যাত গ্রন্থে লিখেছেন- ইমাম হোসাইনের মর্মন্তুদ মৃত্যুর দৃশ্য যুগে যুগে পাষানতম পাঠকের অন্তরেও জাগিয়ে তুলবে মর্মবেদনা। ইমাম হোসাইন জীবন দিয়ে শিখিয়ে গেছেন, কিভাবে স্বৈরচারের প্রতিবাদ করতে হয়, কীভাবে অন্যায়ের বিরোদ্ধে কথা বলতে হয়। তাই সর্বযুগে তাঁর ‘শাহাদাত’ মুক্তিকামী, স্বাধীকার ও স্বাধীনতাকামী মানুষের অনুপ্রেরণা ও সাহসের ভিত্তি।
দুনিয়ার যেথা স্বৈরচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উঠে জাগি-্
ইমাম হোসাইনের কণ্ঠস্বর সেথা শোনা যায় থাকি থাকি!
আপাতদৃষ্টে কারবালার হত্যাকাণ্ড শোকের উদ্বেগ করলেও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, কারবালার বিপর্যয়ের মধ্যেই ইসলামের বিজয় সুচিত হয়েছিল। শাহাদাতে কারবালা পরবর্তী যুগে যখনই ইসলাম মুসলমানের ঈমান ও আক্বীদার উপর কোন পাপিষ্ঠ কালিমা লেপনের চেষ্টা করেছে তখনই ইসলামের পুত: স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের হিফাযতকারীদের জন্য ‘আহলে বায়’আত’ তথা নবী পরিবারের আত্মদানের নজীর দুর্জয় শক্তি যোগিয়েছে। এজন্যই বলা হয় থাকে: ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়; হার কারবালাকে বাদ’। এখানেই আশুরার মহিমা নিহিত।
লেখক : মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।
পূর্বকোণ/আর