চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

মুসলমানে-মুসলমানে যুদ্ধ

৪ আগস্ট, ২০২২ | ১১:৪৩ অপরাহ্ণ

মদীনার গভর্নর ওয়ালিদ যখন বললেন, মুয়াবিয়া ইন্তেকাল করেছেন। তখন হোসাইন (রা) ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন পড়েন। এরপর বললেন, আপনি ইয়াজিদের জন্য বায়েত গ্রহণ করুন। তখন তিনি বললেন, আমার মতো মানুষ গোপনে বায়েত গ্রহণ করা ঠিক নয়। মসজিদে সবাইকে ডাকেন। সবার সম্মতিতে আমি বায়েত গ্রহণ করবো। এই বলে তিনি চলে যান।

এরপর দেখা গেল হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের তার আত্মীয় স্বজন নিয়ে মদিনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে গেলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর তখন হজের মধ্যে ছিলেন। আর হোসাইন (রা) একদিন পর মদিনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে গেলেন। মক্কায় যাওয়ার পর তিনি দেখতে পেলেন কুফা থেকে বিভিন্ন চিঠিপত্র আসছে।

সে চিঠির মধ্যে লেখা হচ্ছে- হোসাইন আপনি কুফার মধ্যে আসেন, আমরা আপনাকে খলিফা ঘোষণা করবো। আপনার হাতে আমরা বায়েত গ্রহণ করবো। কারণ আমরা ইয়াজিদের বায়েত প্রত্যাখ্যান করছি। এভাবে দেড়শ’র মতো চিঠি এলো মক্কার হোসাইন (রা) এর দরবারে। মক্কার গভর্নর ছিল আমর বিন সাইদ। তিনি হোসাইন (রা) উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি সেখানে গেলে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। এরচেয়ে আমি আপনাকে নিরাপত্তা দিলাম, মক্কাতে বসবাস করুন। কিন্তু তিনি দেড়শ’ চিঠি পাওয়ার পর বললেন, আমি যাছাই করবো। তখন চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিদকে পাঠালেন কুফার খবর নিয়ে আসার জন্য। তিনি যখন কুফায় গেলেন, দেখলেন কুফাবাসী হোসাইন আসার পক্ষে। এবং তার হাতে ১৮ হাজার বায়েত গ্রহণ করেছে হোসাইন (রা) এর জন্য। তখন তিনি হোসাইন (রা) এর কাছে চিঠি পাঠালেন কুফায় যাওয়ার জন্য।

এদিকে এই সংবাদ যখন ইয়াজিদের দরবারে পৌঁছল। ইয়াজিদ তখন সিরিয়ায় ছিলেন, ঘটনা হচ্ছে ইরাকে। তখন তিনি ইরাকের বিনয়ী গভর্ণরকে বরখাস্ত করে পাষাণ ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। তাকে কুফার গভর্নরের দায়িত্ব নেয়া এবং যারা হোসাইনের বায়েত গ্রহণ করবে তাদের কঠোর হস্তে দমনের নির্দেশ দেয়া হয়। যারা হোসাইনের পক্ষে নামবে তাদের হত্যারও নির্দেশ দেয়া হয়। তাকে এই নির্দেশ দুটি দিয়ে বশরা থেকে কুফায় পাঠানো হয়। ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ যখন পাগড়ি বেঁধে কুফায় প্রবেশ করছেন তখন মানুষ মনে করেছিল হোসাইন আসছেন। সবাই তখন তাকে মারহাবা দেন। পরে প্রাসাদে গিয়ে দেখতে পেলেন হোসাইন নন ওবায়দুল্লাহ। তখন সকলে লজ্জিত হলেন। এরপর কৌশলে বিভিন্ন খবরা খবর নিয়ে মুসলিম বিন আকিদকে শহীদ করেন ওবায়দুল্লাহ।

এদিকে হোসাইন (রা) চিঠি পাওয়ার পর জিলহজ মাসের ৮ তারিখ মক্কা শরীফ থেকে রওয়ানা দেন। আর অনেকে তাঁকে বুঝান মক্কায় থেকে তাদের বায়েত গ্রহণ করার জন্য। কুফায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ সেখানে গেলে ফেতনার আশংকা রয়েছে। কিন্তু হোসাইন (রা) বললেন, আমি সেখানে কল্যাণ দেখছি। তাই সেখানে অবশ্যই যাবো, আমি পরিস্থিতি দেখবো। এরপর অনেক বুঝানোর পরও তিনি শুনেননি। আসলে তকদিরের কারনে তিনি সেদিকে রওয়ানা দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর কায়সার ইবনে মুসফিককে কুফার উদ্দেশ্যে পাঠালেন পরিস্থিতি জেনে জানানোর জন্য। তাকেও সেখানে শহীদ করা হয়। এই খবর হোসাইন (রা) পাননি। অর্ধপথ চলে যাওয়ার পর খবর এলো হোসাইন এর দুইজন দূতকেই ইয়াজিদের নির্দেশে ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ হত্যা করেছে। বায়েত গ্রহণকারী কুফাবাসী কিছুই করতে পারেনি। সকলে জিয়াদকে ভয় করছে, আপিন না গেলে ভাল হবে।

হোসাইন (রা) এর সফরসঙ্গি ছিলেন মাত্র ১০০জন। মহিলা ও কিছু ছিল। আব্বাস (রা) বলেছিলেন আপনি মহিলাদের নিবেন না। কারণ কোন খারাপ পরিস্থিতি হলে তারা কান্নাকাটি করবে। তারপরও তাদের আগ্রহের কারণে সফরসঙ্গি হন। তাদের বহরের সাথে কিছু বহিরাগতও যোগ দেন। তারা আশা করেছিলেন এমন জায়গায় যাবেন, যেখানে ভাল ফসল পাবেন, জীবন যাপনে সুবিধা হবে। কিন্তু বিধিবাম। বহিরাগতদের হোসাইন (রা) চলে যাওয়ার কথা বললে তারা এদিক ওদিক চলে যান।

পথিমধ্যে বিখ্যাত উমাইয়া কবি ফরাজদাক এর সাধে হোসাইন (রা)এর সাক্ষাত হয়। তখন তিনি হোসাইন (রা)কে উদ্দেশ্য করে বললেন,“আপনি এমন একটি জায়গায় যাচ্ছেন, কুফাবাসীর অন্তর হলো আপনার সাথে। অর্থাৎ তারা আপানকে মহব্বত করে। কিন্ত তাদের তলোয়ার হলো ইয়াজিদের সাথে, জিয়াদের সাথে, উমাইয়াদের সাথে। আর সিদ্ধান্ত হলো আপনার হাতে। ফয়সালা হলো আল্লাহর হাতে ”। অতএব আপিন এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ আপনি যাবেন, মহব্বত পাবেন। কিন্তু বাহিনী পাবেন না। কারণ তাদের তলোয়ার উমাইয়ার দিকে। তারা সেদিকে চলে যাবে।
তারপরও তিনি হোসাইনকে বললেন, আপনি আকিদ না, সেখানে গেলে পরিস্থিতি পাল্টেও যেতে পারে। এ কথা বলার পর হোসাইন (রা) রওয়ানা দিলেন।

ওদিকে কুফার গভর্নর ওবাদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ, হুর বিন ইয়াজিদের নেতৃত্বে এক হাজার বাহিনী পাঠাল হোসাইনের বাহিনীকে অবরোধ করার জন্য। সেখানে যাওয়ার পর দেখল হোসাইনের বাহিনী হুর বিন ইয়াজিদের বাহিনীর সাথে। হুর বিন ইয়াজিদ বলল, আমি আপনার সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আপনার পেছনে পেছনে থাকব। উভয়দল একসাথে নামাজ পড়েছে হোসাইনের পেছনে। এরপর হুর বিন ইয়াজিদকে হোসাইন বললেন, “হে হুর আমি এখানে স্বেচ্চায় আসিনি, আমাকে দেড়শ’র মতো চিঠি প্রদান করা হয়েছে। ওই চিঠির কারণে তোমাদের এলাকায় এসেছি। যদি আমার আসা তোমাদের পছন্দ না হয়, আবার মক্কায় ফিরে যাব। আর না হয় এমন একটি সীমান্ত এলাকায় চলে যাব, সেখানে গিয়ে দাওয়াতের কাজ করব”। হুর বিন ইয়াজিদ বললেন, ক্ষমতা আমার হাতে নেই্। ইবনে বিন জিয়াদের হাতে। সে নির্দেশ দিয়েছে আপনার সাথে দেখা করার জন্য। সিদ্ধান্ত তার কাছ থেকে আসতে হবে। এই কথা বলার পর যখন কারবালা প্রান্তরের দিকে গেলেন।

এবার ইবনে বিন জিয়াদের কাছে নির্দেশ এলো কারবালা প্রান্তরে হোসাইনের বাহিনীকে অবরোধ করে রাখার জন্য। সামনে যেন আর অগ্রসর হতে না পারে। তাকে সাহায্যের জন্য এবং হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আরেকটি বিশাল বাহিনী পাঠানেরা হলো। ইবনে জিয়াদ আবার চার হাজার বাহিনী পাঠালেন। দুটি বাহিনী জড়ো হওয়ার পর তারা তারা হোসা্ইনের সামনে দুটি প্রস্তাব পেশ করেন। হয় আপনি ইয়াজিদের হাতে বায়েত গ্রহণ করুন। না হয় যুদ্ধ করুন। যে কোন একটি বেঁচে নিতে হবে। তখন হোসাইন (রা) তিনটি প্রস্তাব দিলেন। আমি এসছি তোমাদের চিঠির কারনে তোমরা যদি সে চিঠি অস্বীকার কর, আমি আবার মক্কায় ফিরে যাব। না হয় সিরিয়া ফিরে যাই। অথবা আমি কোন ভিন্ন এলাকার মধ্যে চলে যাই।

ওমর বিন সাদ বললেন, অবশ্যই ৩টি প্রস্তাব সুন্দর। যদি ৩টি প্রস্তাবের ১টিও পাশ হয়ে যায় আমার জন্য কল্যাণ। আমি চাই না আপনার সাথে যুদ্ধ করতে। এই প্রস্তাব যখন জিয়াদের মাধ্যমে কুফার গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ কাছে পাঠানো হলো। সে যে কো্ন একটিতে রাজী হওয়ার জন্য চেয়েছিল। তখন সেখানে ওবায়দুল্লাহর পাশে বসা ছিল সীমার। সীমার বলল, সে যদি ইয়াজিদের হাতে যায়, তাহলে আপনার অপমান। তাকে শর্ত দেন আপনার হাতে বায়েত গ্রহণ করার জন্য। আর কোন ধরনের প্রস্তাব হোসাইনের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হবে না, এটিও জানিয়ে দেন। তখন সে কথা বলার পর ইবনে জিয়াদ বলল, ঠিক আছে। তাহলে তুমি আবার চূড়ান্ত চিঠি নিয়ে যাও। সে যেন আমার হাতে বায়েত গ্রহণ করে। না হয় যুদ্ধ শুরু করে। এই চিঠি ওমর বিন সাদকে দিয়ে সীমার পাঠালেন হোসাইনের কাছে। ইবনে জিয়াদের হাতে বায়েত গ্রহণ করবে না হয় যুদ্ধ করবে। হুর বিন ইয়াজিদ এই সিদ্ধান্ত জানার পর হোসাইনকে বললেন, আমি প্রথম এই সিদ্ধান্ত জানলে আপনাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিতাম। এই বলে ৩০জন বাহিনী নিয়ে তিনিও হোসাইনের দেলে যোগ দিলেন। ১০ মহররম যুদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল ।

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট