চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

ইব্রাহিম (আ.)’র হজের নিয়ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন মহানবী (সা.)

২১ জুন, ২০২২ | ৬:০৭ অপরাহ্ণ

শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা ফরজ। আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধারিত সময়। হজ পালনের জন্য সৌদি আরবের মক্কা নগরী এবং সন্নিহিত মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা প্রভৃতি স্থানে গমন এবং অবস্থান আবশ্যক। নামাজ, রোজা, যাকাতকেও আল্লাহ ফরজ করেছেন। কিন্তু এই তিনটিকে ফরজ করলেও কোরআনের আয়াতের সঙ্গে আল্লাহ নিজের নাম উল্লেখ করেননি। এখানে ফরজ করার নিয়ম ভিন্ন। হজকে আয়াতের মাধ্যমে বান্দা-বান্দিদের জন্য ফরজ করেছেন। ওই আয়াতের বর্ণনা ভিন্ন।
ওয়াহ কিমুস সালাতা-নামাজ কায়েম কর।
ওয়াহ তুজ যাকাতা-যাকাত আদায় কর।
কুতুবা আলাইকুমুস সিয়াম-রোজা পালন কর।

কিন্তু আল্লাহপাক হজের ব্যাপারে বলছেন- ওয়ালিল্লাহি-আল্লার জন্য। ঈমান-দিলের মধ্যে । নামাজ-ঘরের মধ্যে। রোজা-শরীরের ভেতর এবং জাকাত দেওয়া হয় গোপনে, কেউ দেখছেন না। কিন্তু হজ অবশ্যই অন্যরা দেখবে, জানবে। হজ ফরজ করার আগেই কোরআনের আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন: হে বান্দা-বান্দি হজ তোমাদের উপর ফরজ করে দিচ্ছি মনে রাখবে ওয়ালিল্লাহি-যেন আল্লার জন্য হয়। তাই হাজীদের প্রথম বিষয় হলো- হজ হবে আল্লাহকে রাজী এবং সন্তুষ্টি করার জন্য। অন্য কোন উদ্দেশে নয়।

 

মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে অনুসারীদের কাবাগৃহে ইবাদতের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারপর থেকেই হাজার হাজার বছর ধরে পবিত্র হজব্রত পালিত হয়ে আসছে। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা প্রথম কাবাঘর নির্মাণ করেন। কাবাঘরে প্রথম হজ আদায়ও করেন তাঁরা। এরপর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) কাবাঘরকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেন। পরবর্তী সময়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তা পুননির্মাণ করেন। কাবাঘর পুর্ননিমাণের পর থেকে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর প্রদর্শিত পথে হাজার হাজার বছর ধরে পবিত্র হজব্রত পালিত হয়ে আসছে।

ইসমাইল (আ.) এর বয়স যখন ৯ বছর তখন হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্ন দেখেন আল্লাহ তাঁকে তাঁর প্রিয় বস্তু কোরবানির নির্দেশ দিচ্ছেন। এ স্বপ্ন দেখে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ১০০ উট কোরবানি দেন। দ্বিতীয় দিনও তিনি একই স্বপ্ন দেখেন। এবারও তিনি ১০০ উট কোরবানি দেন। তৃতীয় রাতেও তাঁকে প্রিয় বস্তু কোরবানি দিতে বলা হয়। ইব্রাহিম (আ.) উপলব্ধি করেন ইসমাইল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। আল্লাহ তাকেই কোরবানির নির্দেশ দিয়েছেন। সে নির্দেশ পালিত হয়নি বলেই বারবার একই স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে।

 

এ উপলব্ধি কঠিন পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেয় ইব্রাহিম (আ.)-কে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের জয় হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) সিদ্ধান্ত নেন যত কষ্টকরই হোক আল্লাহর হুকুমই তিনি পালন করবেন। পুত্রকে কোরবানি দেওয়ার জন্য নিয়ে চলেন দূরবর্তী ময়দানের দিকে। মাঝপথে ইসমাইল (আ.)-কে জানান আল্লাহর আদেশের কথা। ইসমাইল (আ.) বলেন, আল্লাহর আদেশে কোরবানি হওয়া তো সৌভাগ্যেরই ব্যাপার। মিনা ময়দানে ছেলেকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হন আল্লাহর নবী। পিতৃস্নেহ আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কোরবানির আগে নিজের চোখ বেঁধে নেন। তারপর ছেলের গলায় চালান ধারালো ছুরি। কোরবানি শেষে চোখ খুলেই দেখেন পাশে দাঁড়িয়ে ছেলে ইসমাইল। তার বদলে একটি দুম্বা জবাই হয়ে আছে।

ফেরেশতা এসে নবীকে জানান, আল্লাহপাক তাঁর উৎসর্গিত মনোভাবে খুশি হয়েছেন। তিনি তাঁর কোরবানি গ্রহণ করেছেন। তখন হজরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে কাবাঘর পুর্ননিমাণ করেন। কাবাঘর প্রদক্ষিণের নিয়মও প্রবর্তন করেন তাঁরা। হজ উপলক্ষে হজব্রত পালনকারীরা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি অনুসরণে কোরবানি দেন। এ নিয়মও চলে আসছে সাড়ে চার হাজার বছর ধরে।

কাবাঘর স্থাপিত হয়েছিল আল্লাহপাক এক, তার কোন শরীক নেই- এই চেতনাকে উদ্ভাসিত করার জন্য। কালক্রমে এ পবিত্রঘর ভণ্ড পুরোহিতদের আখড়ায় পরিণত হয়। আবার অন্ধকার নেমে আসে এবং এই দুই নবীর অনুসারীরা বিপথগামী হয়ে পড়ে। তারা ভুলে যায় আল্লাহর নির্দেশের কথা। ভুলে যায় ইব্রাহিম (আ.)-এর শিক্ষা। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার জন্য যে কাবাঘর পুনর্নির্মিত হয়েছিল, সেখানে শুরু হয় দেবদেবীর পূজা। হজের নামে প্রবর্তিত হয় ব্যভিচার আর বেলেল্লাপনা। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারি মক্কা বিজয়ের পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজ পালনে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নির্দেশিত নিয়মই আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।

 

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা জয়ের আগের কয়েক শ’ বছর ধরে হজ পালন, কাবা প্রদক্ষিণ এবং কোরবানির নামে যা হতো তার সঙ্গে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর শিক্ষার কোনো সম্পর্কই ছিল না। তাঁর সরাসরি বংশধর কাবা শরিফের খেদমতকারীর দাবিদার কুরাইশদের নেতৃত্বেই চলত হজের নামে নাচ-গান, মদপান, আর ব্যভিচার। কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ করা হতো নগ্নভাবে।

নারী-পুরুষ উলঙ্গ কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করত এবং বলত, ‘আমরা যে অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছি সে অবস্থায় আল্লাহর সামনে হাজির হয়েছি।’ পশু কোরবানির পর কাবাঘরের সামনে মাংস ফেলে রাখা হতো এবং ভাবা হতো, আল্লাহ এ মাংস ভোগ করবেন (নাউজুবিল্লাহ)। আরবের বিভিন্ন গোত্রপতি কোরবানির নামে নিজেদের আর্থিক সামর্থ্যের জানান দিত। হজ উপলক্ষে যে বিশাল সমাবেশ হতো, সেখানে মেজবানির ব্যবস্থা করে দম্ভ প্রকাশেরও চেষ্টা চলত।

 

হজরত ইব্রাহিম (আ.) -এর মৃত্যুর এক হাজার বছর পর থেকে শুরু হয় এসব অনাচার এবং তা কমবেশি দুই হাজার বছর অব্যাহত ছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে মক্কা বিজয়ের পর কাবাগৃহ থেকে সব মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) হজের যে নিয়ম প্রবর্তন করেন সাড়ে চার হাজার বছর আগে, তা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
মহানবী (সা.) হাদীসে পাকে ইরশাদ ফরমান: আখেরী জামানাতে এমন এক সময় আসবে, মানুষ ৪টি কারণে হজ্ব করবে, আল্লাহর জন্য নয়।

১। ব্যবসার জন্য: যাওয়ার সময় মালামাল নিয়ে যাবে। একইভাবে আসার সময় নিয়ে আসবে। ব্যবসা হবে ওই চিন্তায় হজ্বে যাবে।
২। ভ্রমণের জন্য: অন্যদেশ দেখার মতো সৌদিআরবেও যাবে ভ্রমনের উদ্দেশ্যে। একইসাথে মক্কা ও মদিনাও দেখা হবে।
৩। ভিক্ষার জন্য: কারো কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে হজ্বে যাবে। টাকার বিনিময়ে কারো হ্জ্ব কিংবা ওমরাহ করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। বাস্তবে ভিক্ষার মাধ্যমে রোজগার করবে।
৪। লোক দেখানোর জন্য: আলেম–ওলামা-ধনীব্যাক্তি, রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বারবার হজে যাবেন লোক দেখানোর জন্য। লোকজন বলাবলি করবে-উনি ১৫-২০বার হজ করেছেন। এমন হাজীদের কপালে শুধু অভিশাপ।
অবশ্য আল্লাহপাক বলেন: যারা এসব কারণে হজ করবে না শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে। প্রত্যেক কাজ হবে আল্লাহর জন্য। গুণাহর কাজ থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহপাক তার হজ্ব কবুল করবেন। ফলে বান্দা-বান্দির পেছনের সমস্ত গুণাহ মাফ করে আল্লাহ তাদের নিষ্পাপ হিসেবে দেশে ফেরত পাঠাবেন।

 

হজ্বের সময় দিল থাকবে আল্লাহর নিকট রুজু। হজের আগে নিজেকে নিয়ে মরাকাবা কিংবা ধ্যানে বসতে হবে। কিভাবে আল্লাহকে রাজী করাবো-এই চিন্তা থাকবে মগজে। দিলের মধ্যে স্ত্রী, সন্তান, সম্পদের চাইতে আল্লার মহব্বত থাকতে হবে অনেক অনেক বেশি। এই অবস্থায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারলে আল্লাহপাকের দরবারে কবুল হবে হজ। বান্দা বলবে “লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক” আল্লাহ আমি হাজির। আল্লাহ বলবেন: লাব্বাইক, লাব্বাইক, লাব্বাইক-আমার বান্দা তুমি হাজির আছ। আল্লাহতায়ালা সবাইকে মকবুল হজ নসীব করুন।

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট