চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

উপলব্ধিতে শান্তিনিকেতন

ফেরদৌসী বিকন

১৪ এপ্রিল, ২০২১ | ২:১৪ অপরাহ্ণ

‘শান্তি’ ব্যাপারটা যে অনেকটাই মানসিক তা শান্তিনিকেতন গিয়েই টের পেয়েছিলাম। শান্তি মনে থাকতে হয়, শরীর মানসিক শান্তি বহনের মাধ্যম মাত্র। মনটাকেইতো মানুষ বয়ে বেড়ায়। তারপর জায়গা, মানুষ, ফুল, পাখি সবকিছুর ঠাঁই হয় এই মনেই। “স্বর্গের কাছাকাছি” পড়তে গিয়ে দেখলাম, শান্তিনিকেতনবাসীর উপর সময়ে অসময়ে রবীন্দ্রনাথের বিরক্তির প্রকাশ পেয়েছে! প্রতিটি মানুষ এবং তাঁর জীবন, তাঁর চিন্তার প্রতিচ্ছবি মাত্র। মানুষের চিন্তাই তাঁর ইন্দ্রিয় এবং বাস্তব জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সাহিত্যে পড়া রবীন্দ্রনাথের কিছু অনুভূতিকে ঘিরে শান্তিনিকেতনকে অশান্তির জায়গা এবং সব শান্তিনিকেতনবাসীকে এক পাল্লায় মাপাটা অবান্তরই বৈকি।

ঠিক তাই হল, শান্তিনিকেতনে পা রাখতেই আমার সমস্ত দ্বান্দ্বিক অনুভূতির সমাপ্তি ঘটলো বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোতে। বিষয়গুলোকে যে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি সে কথা সত্য, তবে সেই উপলব্ধির কোন কারণই হয়তো আজ এই মুহুর্তে আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আমি হেঁটে বেড়িয়েছি, গাছ দেখেছি, ফুল দেখেছি, সুনীল আকাশের নীচে ওই অতোটুকুন ছোট্ট একটা শহরে আশ্চর্যরকম এক ভালো লাগা অনুভব করেছি। যখনই গরমে হাঁপিয়ে উঠেছি ক্ষণে ক্ষণে শান্তিনিকেতনের শীতল বাতাস এসে তাঁর সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে আমার স্থিতি স্বরণ করিয়ে যেতো। অদ্ভুত বন্ধুসুলভ সব মানুষ দেখেছি। সুস্বাদু সব খাবার খেয়েছি। যদিও এইসবই আমার একান্ত অনুভূতি। শান্তিনিকেতনের মানুষের কাছে সে অভিজ্ঞতা হয়তো ভিন্ন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আমার আর শান্তিনিকেতনের সম্পর্ক হল অনেকটা প্রেমের সম্পর্ক।

তাই যে কদিনই শান্তিনিকেতনে ছিলাম দিনরাত একরকম মুগ্ধতা ঘিরে ছিলো আমাকে। প্রেমে মুগ্ধতার পাল্লাই ভারী থাকে। আবার এও বুঝেছি শান্তিনিকেতনের সাথে একজন শান্তিনিকেতনবাসীর সম্পর্ক অনেকটা দাম্পত্য সম্পর্কের মতো। সেখানে মুগ্ধতা কেটে গেছে অনেক আগেই। এখন সেখানে দেয়া-নেয়া আর চাওয়া-পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে এখন আর কেবল মুগ্ধতা দিয়ে মন ভরেনা, এখন সেখানে দায়িত্ব আর কর্তব্যের বোঝা বইতে হয়।

একজন শান্তিনিকেতনবাসীর প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত শান্তিনিকেতনের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। ঠিক সেরকম, রবীন্দ্রনাথকে হয়তো সেই কঠোর বাস্তবতাই বারবার আঘাত করতো। চারপাশের সকল বিদুষী, নিষ্ঠাবান আর বড় হবার, বিখ্যাত হবার, পরিচিতি পাবার স্বপ্নে বিভোর পুরুষের ঈর্ষার পাত্র, চোখের কাঁটা, বুকের মধ্যে তুষার আগুন হয়ে উঠতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ। সেজন্যই বোধহয় লিখেছিলেন, ‘ঈর্ষা জিনিসটার মধ্যে একটা সত্য আছে, আর তা হল এই যে, যা কিছু ভালো তা সকলেরই পাওয়া উচিৎ ছিলো!’

বড় মানুষদের জীবন এমনি হয়। তাঁরা নিজের গণ্ডির মধ্যে পরিতৃপ্ত হতে পারেননা বলেই সে গণ্ডি ভেদ করে, দেশ কাল, এমনকি যুগের সীমাকেও অতিক্রম করে, সকল যুগের সকল মানুষের হয়ে ওঠেন। ঠাঁই করে নেন মানুষের অন্তরে, মৃত্যু যেখানে স্পর্শ করতে পারেনা। আর সেজন্যেই হয়তো রবীন্দ্রনাথের সাথে বাঙালির সে যোগাযোগ আজো এতোটুকু মলিন হয়নি।

আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত লেখক জেমস জয়েস ডাবলিন এবং ডাবলিনের লোকদের উপর এতোই ক্ষিপ্ত ছিলেনযে প্রায় সারাটা যৌবনই প্রবাসে কাটিয়েছেন। ওনার প্রায় লেখালেখির কাজই সম্পন্ন করেছেন উনি ইতালি এবং ফ্রান্সে থেকে। একই হয়েছে সেমুয়্যাল বেকেটে, অস্কার ওয়াইল্ডের মতো লেখকদের ক্ষেত্রেও। অথচ আজ এই জেমস জয়েসকে নিয়েই ডাবলিন শহরের মানুষের একটা আলাদা অহংকার আছে। ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শান্তিনিকেতনবাসী অহংকার করে।

কিন্তু তবু ডাবলিনে এলে ইয়েটস পরিবারকে জানতেই হবে। ইয়েটস পরিবার আয়ারল্যান্ডে আভিজাত্যের প্রতীক। জন বাটলার ইয়েটস পেশায় ছিলেন আইনজীবী কিন্তু পরে তিনি হয়ে যান চিত্রকর। জন বাটলার ইয়েটস গর্বিত পিতা হিসেবেও বিশ্ববিখ্যাত। তার দু ছেলে, দু মেয়ে সবাই তাদের নিজ নিজ শাখায় বিশ্ববিশ্র“ত। জন বাটলার ইয়েটসের বড় ছেলে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসকে ১৯২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এই কবি বাঙালিদের কাছেও প্রিয়। তার একটি কারণ হলো এই আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গীতাঞ্জলীর ভূমিকা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ডব্লিও বি ইয়েটস-এর সখ্যতা ছিল। তাদের এই বন্ধুত্ব ৩৭ বছর স্থায়ী হয়েছিল।

কাব্যস্বভাবের দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে ইয়েটসের প্রচুর মিল পাওয়া যায়। দু’জনেই ছিলেন ইংরেজদের একনিষ্ঠ ভক্ত । কিন্তু একটা জায়গায় তাঁরা কখনও আপোস করেননি, সেটা হলো তাঁদের সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর সাহিত্য, কাব্য, নাটক, উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পে বাংলাকে তুলে ধরেছেন হৃদয়-বিস্ফোরিত আবেগ ও দরদ দিয়ে; ইয়েটসও তেমনি তাঁর সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডকে। ইয়েটসের বিখ্যাত কবিতার একটি ‘দ্য লেক আইল অব ইনিসফ্রি’।

এই কবিতায় স্বদেশের প্রতি তাঁর তীব্র আবেগ ও স্মৃতি-কাতরতা ফুটে উঠেছে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে, যেমনটি আমরা লক্ষ্য করি বাংলার মহাকবি মধুসূদনের বিখ্যাত সনেট ‘কপোতাক্ষ নদ’-এ। ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে মধুসূদন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন তাঁর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে; ইয়েটসও তাঁর শৈশব-কৈশোরের লেক আইল নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন লন্ডনে অবস্থানকালে। মধুসূদন সনেটের শুরুতে বলেন: “সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে”; ইয়েটস তাঁর কবিতার শুরুতে বলেন: “আমি জেগে উঠবো এবং এখনই যাবো, যাবো আমার ইনিসফ্রি-তে।”

মধুসূদন তাঁর সনেটে বলেন:

“বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে!”

ইয়েটস তাঁর কবিতায় বলেন:

“যেখানে ঝিঁঝিপোকা গান গায়, যেখানে মধ্যরাত্রি
জ্বলজ্বল করে জ্যোৎস্নায় এবং দুপুর গনগন করে জ্বলে
আর সন্ধ্যা ভরে থাকে লিনেট পাখির ডানার শব্দে,
আমি সেখানে কিছু শান্তি পাবো। কারণ সেখানে শান্তি
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে সকালের অবগুণ্ঠন থেকে।“

যেন জীবনানন্দ দাশ এরই পুনরুক্তি করেছিলেন তাঁর ‘বনলতা সেন’-এ:
“আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন!”

আসল কথা হলো দেশপ্রেম নেইতো দেশ ও নেই। দেশ নেই তো সাহিত্য সংস্কৃতি নেই, কবিও নেই। কবিরা কখনও শূন্যে বাঁচে না; তাদেরকে বাঁচতে হয় মাটি ও মানুষের ভালোবাসার টানে ।

লেখক: ফেরদৌসী বিকন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট