চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মহামারিকালীন কীভাবে কুরবানি করবেন

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

১২ জুলাই, ২০২০ | ২:১৮ অপরাহ্ণ

বছর ঘুরে আবারো ফিরে আসছে কুরবানির ঈদ। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১ আগস্ট কুরবানির ঈদ হতে পারে। পবিত্র কুরবানি উপলক্ষে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় মূল কাজ দুটি- ঈদের নামায ও কুরবানি। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে অন্তত একটি ছাগল বা এ জাতীয় পশু জবেহ করার নাম কুরবানি। নিজের যৌক্তিক প্রয়োজন মেটানোর পর কারো নিকট যদি সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা সে পরিমান নগদ টাকা থাকে তাহলে তার ওপর একটি ছাগল বা ছাগল জাতীয় পশু কুরবানি দেয়া ওয়াজিব। গরু বা গরু জাতীয় পশু হলে অন্তত তার একভাগ কুরবানি দিতে হবে। না করলে গুনাহগার হবে। পবিত্র কুরআনের সূরা কাউছার-এর দ্বিতীয় আয়াতের আলোকে হানাফি অধিকাংশ ইমাম কুরবানিকে ওয়াজিব মনে করেন।

ইমাম শাফেয়ি ও মালেক (র.)-এর মতে সুন্নাত। ইমাম শাফেয়ী (র.)-এর মতে, একই পরিবার বা একাধিক পরিবারের একজন কর্তাব্যক্তি কুরবানি করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে (আল-ফিক্হ ‘আলাল্ মাজাহিব আল-আরবায়া, ২/১৬৭)। মহামারিকালীন জুমা-জামাতের বিষয়ে ইতিপূর্বে সরকার ১২টি শর্ত দিয়েছে। কুরবানি ঈদের নামায হয়ত প্রায় মানুষ সেভাবে আদায় করবেন, যদিও অনেকেই এখনো ঘরেই নামায আদায় করছেন এবং সরকারের দেয়া ১২টি শর্ত মানা হচ্ছে না। পুরাপুরি মানাও সম্ভব না।

অপরদিকে উপমহাদেশের মানুষের অধিকাংশ হানাফি মাজহাবের অনুসারী। তারা কুরবানি বিধানকে অবহেলাও করতে পারছে না। পাশাপাশি কুরবানির ঈদকে ঘিরে যে আয়োজন, উৎসব ও আমেজ হাজার বছর ধরে চলে আসছে সেটাকে বাদ দিতে তারা মানসিকভাবে অপ্রস্তুত। আবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে করাও সম্ভব না। এমন বাস্তবতায় অনেকেই চিন্তিত। জানতে চাচ্ছেন কুরবানির বিকল্প কিছু আছে কিনা অথবা কাযা করা যাবে কিনা ইত্যাদি। যদিও কুরবানির ঈদ এখনো প্রায় এক মাস বাকি তবুও “কোভিড-১৯ স্থায়ী হতে পারে” চিকিৎসকদের এমন বক্তব্যের আলোকে কুরবানি নিয়ে হিসাব কষতে হচ্ছে। আমরা আশা করছি ইনশা আল্লাহ করোনার প্রাদুর্ভাব চলে যাবে। আমরা স্বাভাবিক পরিবেশে কুরবানির ঈদ করবো। কিন্তু প্রস্তুতি নিতে হবে চিকিৎসকদের কথা অনুযায়ী।

মহামারিতে নামাযের ক্ষেত্রে আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে মিল ফতোয়া দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু কুরবানির বিষয়ে তাঁদের সাথে পুরাপুরি মিল রেখে ফতওয়া দেয়া যাচ্ছে না। তাই কুরবানির ক্ষেত্রে উপমহাদেশের মানুষের জন্য বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ যথেষ্ট পরিমাণ কসাইখানা, ফ্রিজআপ ব্যবস্থা, বন্টন করার উন্নত পদ্ধতির কোনটি আমাদের দেশে নেই। সৌদি আরবে হজের সময় প্রায় ত্রিশ লাখ কুরবানি হয়। তাঁরা আধুনিক পদ্ধতিতে জবাই করে এবং এগুলোর মাংস ফ্রিজআপ করে পরবর্তীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের দরিদ্র মানুষের জন্য পাঠিয়ে দেন। স্বাভাবিক অবস্থাতে যেখানে আমরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পশু জবাই করতে পারি না সেখানে মহামারিকালীন মোটেও সম্ভব না। তাই বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আলেম ও চিকিৎসকদের সমন্বয়ে সরকারীভাবে একটি সিদ্ধান্ত আসা প্রয়োজন, যাতে সার্বিক বিষয়ের আলোচনা পূর্বক একটি সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত হবে এবং মানুষ চিন্তামুক্ত হবে। গত ৬ জানুয়ারি অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহর একটি লেখার শিরোনাম ছিল “কোরবানির বিধান ও জীবন, দুটোই রক্ষা করতে হবে”। তবে তিনি স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য বাধ্য করতে হবেও বলেছেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কুরবানি করা মানে হলো ১২টি শর্ত দিয়ে মসজিদ উন্মুক্ত করে দেয়ার মত, যা নব্বই ভাগ মসজিদেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অবশ্য গ্রামে-গঞ্জে অনেকেই ইতিমধ্যে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে করছে। লকডাউন খুলে দেয়ার পর হাট-বাজারসহ সবকিছু স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে, যদিও কিছু কিছু এলাকাকে সরকার রেড জোন ঘোষণা করেছে। লকডাউন খুলে দেয়া বা রেড জোন ঘোষণা করা- যাই হোক না কেন, যাঁরা সচ্ছল ও সচেতন তাঁদের অধিকাংশই এখনো হোমকোয়ারেন্টিন করছেন। কারণ, কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব এখনোও কমেনি। এখনো প্রতিদিন ২৫ শতাংশেরও বেশি পজিটিভ রিপোর্ট আসছে। মারা যাচ্ছে প্রায় ৫০ জন করে। চিকিৎসকরা জুলাই মাসকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করছেন। অপরদিকে মৃত্যুর হারও কমছে না। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কারণে আতঙ্ক কাজ করছে জনমনে। তবে জীবিকার তাগিদে অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে বৈকি! এ ঝুঁকি যাঁরা নিচ্ছেন না, তাঁদের অধিকাংশ কুরবানিওয়ালা। এমতাবস্থায় ঠেলাঠেলি করে কুরবানির পশু ক্রয় করা, পশুকে দুই-তিন দিন নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করা, জবেহ করে আত্মীয়-স্বজনের বাসা-বাড়িতে মাংস বণ্টন করাসহ সংশ্লিষ্ট কাজগুলো হোমকোয়ারেন্টিনে থেকে বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা সম্ভব না। অপরদিকে ধর্মীয় দায়িত্ববোধ তাড়িত করছে কুরবানি করার আর হযরত ইব্রাহিম (আ.) ত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত আমাদের নবী (দ.)-এর সুন্নাত আদায় করার। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ সিদ্ধান্ত নেন যে, নিজে কিছু করবেন না, সবকিছু অন্যদেরকে দিয়ে করাবেন- তাহলে প্রশ্ন আসে নিজের জন্য যা পছন্দ করে না, তা অপরের জন্য পছন্দ করার।

চিকিৎসকরা ভয় করছেন কুরবানির বাজার, বেচা-কেনা, ঈদ উদযাপনকে কেন্দ্র করে করোনা আরো ছড়িয়ে পড়ার। এমন প্রেক্ষাপটে ফতোয়া প্রদান করা কঠিনও বটে। যতটুকু কঠিন কেতাবি দিক থেকে, তার চেয়ে বেশি কঠিন জনগণের আবেগের কারণে। তাদের যুক্তি হলো সবকিছু তো চলছে; ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাধা কেন? বাজারে যেতে পারলে মসজিদে আসতে পারবো না কেন? অর্থনৈতিক বিষয়টিও কম বাধা নয়। যেমন খামারিরা সারা বছর পশুপালন করেছে কুরবানির সময় বিক্রি করার জন্য। গ্রামের প্রায় ঘরে দুই-একটি করে পশু পালিত হচ্ছে। এগুলো কুরবানির সময় ভাল দামে বিক্রি করার আশায় তারা বুক বেঁধেছে। যদি কুরবানির বিকল্প কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত আসে তাহলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে চামড়া শিল্প। অবশ্য ঐতিহ্যবাহী চামড়া শিল্প গত কয়েক বছর ধরে রুগ্ন হয়ে আছে। চামড়ার ব্যবসার সুবিধা কাদের পকেটে যাচ্ছে সেটি অজানা। চামড়ার তৈরি পণ্যের দাম কমেনি বরং বেড়েছে; কিন্তু চামড়ার দাম নেই বললে চলে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এতিম-অসহায়রা। কুরবানির চামড়া বা এর মূল্য দরিদ্রের প্রাপ্য। দরিদ্ররা বঞ্চিত হলেও চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কুরবানির বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

এমতাবস্থায় আমাদের দুটি পথ খোলা আছে। এক. কুরবানির বিকল্প বের করা দুই. স্বাস্থ্যসম্মত কুরবানি করা। আরেকটি পথ হলো “যাই হবে হোক” নীতিতে যথারীতি কুরবানি করা। তৃতীয় মতটি কেউ প্রকাশ্যে সমর্থন করবে না। শরিয়তও অনুমোদন করে না। কারণ, ইসলামি শরিয়ার উদ্দেশ্য সমূহের প্রথম হলো মানুষের জীবন রক্ষা করা। তাই যখনই স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রশ্ন আসে তখন বিধানের ক্ষেত্রে ‘রুখছত’ বা হ্রাস করা, বাদ দেয়া, বিকল্প কিছু করার কথা এসেছে। যেমন কেউ রোযা পালন করতে না পারলে কাযা করার অথবা এর বিকল্প হিসেবে ফিদিয়া তথা সুনির্দিষ্ট অর্থ দরিদ্রকে পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কেউ যদি দমে শুকর তথা হজের কুরবানি করতে না পারে পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৯৬ নাম্বার আয়াতে তাকে দশটি রোযা পালন করতে বলা হয়েছে। কেউ যদি জিলহজের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত কোন পশু না পায় তাহলে কুরবানির সমপরিমাণ টাকা সাদকা করার কথা বলা হয়েছে ফিক্হর কিতাবে।

কুরবানির বিকল্প হিসেবে সাদকা করতে গেলে খামারি, পশুপালনকারী ও চামড়াশিল্পসংশ্লিষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাহলে উল্লেখিত দুটোর মধ্যে কোনটিকে প্রাধান্য দেয়া হবে? অবশ্যই শরিয়ত বলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে। বাংলাদেশের মানুষের অধিকাংশ লোক সেদিকে যাবে না। কারণ, আলেমরা এ বিষয়ে একমত পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। যেখানে মক্কা-মদিনা ও আল-আজহার থেকে ফতোয়া দেয়ার পরও মহামারিকালীন জুমা-জামাতের বিধান মানেননি সেখানে কুরবানির বিষয়ে একমত পোষণ করবেন কীভাবে? এখনো অনেকেই বলছেন, ছোঁয়াচে রোগ বলতে কোন কিছু নেই। তাহলে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি নীতি অবলম্বনপূর্বক ধর্মমন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ওয়ার্ড-ইউনিয়ন ভিত্তিক কুরবানির ব্যবস্থা করা যায়, যেভাবে সৌদি সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করে হাজিদের কুরবানি করার দায়িত্ব নিয়ে থাকে। মিসরসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে কুরবানির জন্য সেরকম ব্যবস্থা আছে। আমাদের কসাইখানা নেই বললে চলে। বাড়ির আঙ্গিনায়, ঘরের উঠানে, চলাচলের রাস্তায় পশু জবাই হয়, যা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত না। পরিবেশতো দূষণ হচ্ছেই। মহামারিকালীন কসাইখানার পাশাপাশি কমিউনিটি সেন্টারগুলো ব্যবহার করা যায়। অন্যথায় সহজে রক্ত, নাড়িভুঁড়ি অপসারণ করার মত জায়গা নির্ধারণ করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন করে কুরবানিওয়ালারা টাকা জমা দিতে পারেন। চেয়ারম্যান-মেম্বার-আলেম-ডাক্তার ও এলাকার গণ্যমাণ্য ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদেরকে নিয়ে কমিটি করে তাঁদের মাধ্যমে উক্ত উদ্যোগ সফল করা যেতে পারে।

পশুর জন্য বাজারকে কম ব্যবহার করে সরাসরি খামারি বা মালিক থেকে পশু ক্রয় করা যায়। কুরবানি করতে হবে তিন দিনব্যাপী। প্রথম দিনই করা আবশ্যক না। সীমিত দিনের জন্য বাজার বসবে। জিলহজের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত কুরবানির বাজার চলতে পারে। স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষিত ও সচেতন যুবকদেরকে দিয়ে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা যায়। কুরবানিওয়ালাদেরকে মাংসের একটি অংশ দিয়ে বাকি মাংস অন্যদের নিকট বণ্টন করা যায়। এতে কুরবানির একটি উদ্দেশ্যও সাধিত হবে। শুধু ওয়াজিব কুরবানি করা হবে, নফল নয়। অর্থাৎ একজনের পক্ষে শুধু একটি ছাগল বা একভাগ কুরবানি করা হবে। তবে ধর্মীয় বিষয়ে জনগণ জনপ্রতিনিধিদের প্রতি কতটুকু আস্থা রাখতে পারছেন- তা একটি বড় প্রশ্ন।

দেশীয় আইনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার যেমন বাধ্যবাধকতা নেই তেমনি ধর্মীয় কাজের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণও নেই বললে চলে। তাই র্যাব ও সেনাবাহিনীকে যুক্ত করে যদি উক্ত কমিটি গঠন করা হয় তাহলে জনগণ আস্থা রাখতে পারবে এবং সরকারীভাবে মোটামুটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে কুরবানি আদায় হবে বলে আশা করা যায়।

 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চবি ও সাবেক মুফতি, চট্টগ্রাম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা

 

 

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট