চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সমাজ

বিলাস কান্তি দাস

৩০ ডিসেম্বর, ২০২৩ | ৭:৫২ অপরাহ্ণ

একাত্তরের অগ্নিঝড়া দিনগুলিতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দখলদারের হাত থেকে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন সেই অকুতোভয় বাঙালীর দামাল সন্তানদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। সর্ব্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে তারাইতো বাঙালীর দীর্ঘদিনের লালিত কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সৈন্যদের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা লাল সবুজের পতাকাতলে মাথা উঁচু করে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছি। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা তাঁদের স্যালুট জানাই।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হল ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান ও স্বাধীকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং বাঙালী গণহত্যার প্রেক্ষাপটে এই জনযুদ্ধ সংঘটিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার মাধ্যমে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। এর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী সাধারণ বাঙালী নাগরিক, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, স্বাধীনতাকামী পুলিশ ও ইপিআর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্ধি করে, যাতে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের দুর্বার আন্দোলন থেমে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানে সহায়তার জন্য তারা পাকিস্তান সমর্থনকারী রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী নিয়ে আধা-সামরিক বাহিনী-রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে। পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহায়তাকারী আধা-সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, উচ্ছেদ, ঘরবাড়ী জালানো ও ধর্ষণের মতো লোমহর্সক ঘটনা ঘটাতে থাকে। প্রায় এক কোটি বাঙালী শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয় এবং আরও তিন কোটি মানুষ দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতাকে বুদ্ধিজীবীরা গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

 

বাঙালী সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। জেনারেল এমএজি ওসমানী ও ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করে। বাঙালী গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তানি নৌবাহিনীর উপর অপারেশন জ্যাকপট সহ ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। তাই একে প্রবাসী সরকারও বলা হয়। বাঙালী সামরিক, বেসামরিক ও কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ মুজিবনগর সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত হাজার হাজার বাঙালী পরিবার আফগানিস্তানে পালিয়ে যায়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করে। যুদ্ধে বাঙালী উদ্বাস্তুদের দুর্দশা বিশ্ববাসীকে চিন্তিত ও আতংকিত করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করেন। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কয়েকজন সঙ্গীতজ্ঞ বাংলাদেশীদের সহায়তার জন্য নিউইয়র্কে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিশ্বের প্রথম কনসার্ট আয়োজন করেন। উত্তর ভারতে পাকিস্তানের বিমান হামলার পর ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগদান করে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর উপর্যুপরি বিমান হামলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে আত্মসমর্পন করে এবং দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার যে চিত্র মানসপটে ভেসে উঠে তা যেকোনো বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে ভাবিয়ে তুলে। পরাজয় আঁচ করতে পেরে ডিসেম্বরের শুরু থেকে এদেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে হত্যাযজ্ঞের মিশন বাস্তবায়ন করতে পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল তা ভাবলে এখনো গা শিউরে উঠে। অনেক পরিবার এখনো জানে না মুক্তিযুদ্ধকালীন দখলদার পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত তাদের প্রিয় মানুষটির দেহাবশেষ এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত কাঙ্খিত স্বাধীনতার সুফল বাংলার সাধারন জনগন সর্বোতভাবে ভোগ করার ক্ষেত্রে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন না হয় তা দেখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ সম অধিকার এবং সমমর্যাদা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধকে মন মানসিকতায় কতটুকু ধারন করতে পারছে তাও আমাদের ভাবতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধ কোন মামুলি অভিনয়ের বিষয় নয়, একটি পরাধীন জাতির দীর্ঘদিনের শোষন, বঞ্চনা শৃংখল ভাঙ্গার করুন ইতিহাস। যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বদরবারে বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম বীরের জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে- জাতির অকুতোভয় সেই সূর্যসন্তানদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। জয়তু- মৃত্যুঞ্জয়ী চিরস্মরণীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

 

লেখক: বিলাস কান্তি দাস প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চবিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট