চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিশুর বিকাশ ও পারিবারিক পরিবেশ

অনলাইন ডেস্ক

১০ আগস্ট, ২০২৩ | ৭:৪৯ অপরাহ্ণ

ক্লাস নাইনের ঘটনা। তখন স্কুলে যাওয়া-আসায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১৪ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হতো। একই কাজ নিত্যদিন করতে সংগত কারণেই একঘেয়ে লাগত। তাই যে ক’জন একসঙ্গে চলতাম তারা মাঝেমধ্যেই বৈচিত্র্যময় কিছু করার চেষ্টা করতাম।

নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, হ্যান্ডেল না ধরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া ছিল যার অন্যতম। সেদিন স্কুল ছুটির পর রাস্তায় উঠতেই ওই রুটের এক বাস আমাদের অতিক্রম করে। তখন এক সিনিয়র বলল, তুমি কি এই বাসের আগে মালঞ্চি রেলগেটে পৌঁছতে পারবে? সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। আমার কাণ্ড দেখে বাসের চালক-যাত্রীরাও বিষয়টা আঁচ করতে পারে। শেষ পর্যন্ত আমি জিতে যাই। তবে প্রায় সাত কিলোমিটার রেসের পর শরীর বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। পরিচিতজনরা বাতাস দেয়, কেউবা পানি এগিয়ে দেয়।

প্রাথমিক ধকল কাটার পর দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি এসে আমাকে দিলেন প্রচণ্ড এক ধমক। তিনি ওই বাসে বসে পুরো ঘটনাটি দেখেছেন। নামকরা স্কুলের ছাত্র হয়েও এমন ঝুঁকি নেয়ায় তিনি আমাকে তিরস্কার করলেন। পরে বুঝিয়ে বললেন, কেন যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা উচিত নয়। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, মানুষ একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়। কিন্তু যন্ত্রের ক্লান্তি নেই। তাই এমন অসম প্রতিযোগিতায় নামা আমার মোটেই ঠিক হয়নি। ভবিষ্যতে এমনটা করলে তিনি হেডস্যার ও আমার অভিভাবকের কাছে অভিযোগ করবেন বলে শাসিয়ে গেলেন। ভদ্রলোককে আমি চিনতাম না। তবুও তার কথাগুলো নীরবে শুনলাম, আজ পর্যন্ত মেনে চলছি। পরে জেনেছিলাম, তিনি পাইলট স্কুলের শিক্ষক নৃপেন স্যার। পরবর্তী সময়ে সাক্ষাতে পড়ালেখার খোঁজ নিতেন। সঙ্গে মৃদু হেসে জানতে চাইতেন, আর সাইকেল রেস করি কিনা?

তিন দশক পর হঠাৎ কেন আজ স্যারের কথা মনে পড়ল? আসলে তখন ছোটদের শাসন করা বা উপদেশ দেয়ার জন্য সরাসরি শিক্ষক বা মুরব্বি হওয়া জরুরি ছিল না। সমাজের নানা স্তরের মানুষগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, উপদেশ, পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়া নিজেদের কর্তব্য জ্ঞান করতেন। ছোটরাও সেটা গ্রহণ করার মানসিকতা লালন করত। কারণ সেটা উপেক্ষা করলে অভিভাবকের কান পর্যন্ত পৌঁছার বিপদ আমরা ভালোভাবেই বুঝতাম। ফলে অচেনা-অজানা ব্যক্তিরাও নিঃসংকোচে সামাজিক অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতেন। সেদিন যেমনটা নৃপেন স্যার করেছিলেন।

সময় বদলে গেছে। পালে আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে। সমাজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো দূরের কথা অধিকাংশ পরিবারে এখন শাসন উঠে গেছে। আগের দিনে পরিবারের মুরব্বিদের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। এমনকি সন্তানরা বড় চাকরি-ব্যবসা করলেও সামাজিক বা পারিবারিক ইস্যুতে মা-বাবার সামনে বিনয়ী থাকত। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের দ্বারস্থ হওয়াই নিয়ম ছিল। ছোটরাও বড়দের দেখে অবচেতন মনে সেটা গ্রহণ ও চর্চা করত। কিন্তু এখন দিন বদলের ধারা স্পষ্ট। হয়তো সে কারণেই পরিবারের ছোট্ট শিশুটি হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় মস্তান! সে বড়দের কথা কী শুনবে বরং বড়রা তটস্থ থাকে তার মেজাজ-মর্জি ঠিক রাখতে। আদব-কায়দা গেছে নির্বাসনে। বহু পরিবারে অন্য সদস্যরা পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যকে বিশেষভাবে ‘কেয়ার’ করে চলে! বাইরে দাপুটে কর্তা ব্যক্তিও ঘরে ফিরে অসহায় হয়ে পড়েন। দুঃখের কথা কাউকে বলতে পারেন না। কোনোরকমে হজমের চেষ্টা করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

এমন চর্চার ফল কি খুব ভালো হচ্ছে? না, অধিকাংশ পরিবারে সেটা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে একটা বিষয় খুবই উদ্বেগজনক। সেটা হলো, কঠোর পরিশ্রম করে জীবনে ঈর্ষণীয় সাফল্য পাওয়া ব্যক্তিরাও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। নিজে মেধাবী ছিলেন ও কঠোর পরিশ্রম করেছেন বলেই আজ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তার সন্তানরা হাজারো সুবিধা পাওয়ার পরও স্কুলের পরীক্ষায় পাস করতে পারছে না! প্রতিযোগিতামূলক (বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরি প্রভৃতি) পরীক্ষায় ভালো করছে না। প্রত্যাশিত আচার-আচরণ শিখছে না। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিশতে পারছে না। ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে থাকছে চরমমাত্রায় উদাসীন। অনেকের সন্তান হচ্ছে নেশায় আসক্ত। জন্ম দিচ্ছে নানা কেলেংকারির। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে খুনোখুনির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া মা-বাবার কিছুই করার থাকছে না। মাত্র এক প্রজন্মের ব্যবধানে এমন কী ঘটে গেল যে হিসাব কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছে না!

নিশ্চয়ই এমনটা হওয়ার পেছনে অসংখ্য কারণ রয়েছে। তবে এ নিবন্ধে একটি দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেটা হলো, আজকাল অনেকেই ভাবেন, শিশুদের ‘শাসন করা’ উচিত নয়। তাদের আদর-ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু শেখাতে হবে। নিজেরা পারিবারিক কঠোর অনুশাসনে বড় হওয়ার পরও হঠাৎ এমনটা মনে হলো কেন? খুব সম্ভবত তারা শুনেছেন (অথবা দেখেছেন) বিদেশে শিশুদের শাসন করা হয় না। কথাটা শুনতে ভালো হলেও আমাদের বাস্তবতা কি এ ধারণাকে সমর্থন করে? অবশ্যই না। কারণ সেসব দেশে প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। শিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠালে সেখানে ওই বয়সে তার যা যা শেখা দরকার তা নিশ্চিতভাবে শেখানো হয়। আমরা কি সেটা কল্পনাও করতে পারি? সেখানে শিক্ষক, চিকিৎসক, পুলিশ, প্রশাসন সবাই নিজ নিজ কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। তাদের পাঠ্যসূচি প্রণয়নে বিস্তর গবেষণা হয়। শিশুদের নৈতিক, সামাজিক ও মানবীয় গুণাবলির বিকাশে রাষ্ট্র তৎপর থাকে। কারণ রাষ্ট্রের টেকসই কল্যাণের স্বার্থে সুনাগরিক তৈরির প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করে। তাছাড়া সেখানে আইনের শাসন ও নিয়ম-কানুন সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হয়।

আবার উচ্চতর পড়ালেখায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার ভালো প্রতিষ্ঠানে চান্স পায় না। এমনকি তাদের অধিকাংশ উচ্চতর পড়ালেখায় আগ্রহী হয় না। বরং তাদের পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনায় নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ থাকে। সেসব দেশে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতি, প্রভাব বিস্তার করে ফল নিজেদের পক্ষে আনা যায় না। দুর্নীতিবাজরা যুগের পর যুগ গুরুত্বপূর্ণ পদে দাপটের সঙ্গে টিকে থাকতে পারে না। আমাদের প্রেক্ষাপটে আপনি কি এর কোনোটাও আশা করতে পারেন? সাধারণত না। তাহলে সবকিছু তাদের থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও শুধু সন্তানকে শাসন করার ক্ষেত্রে তাদের নীতি অনুসরণের মাধ্যমে আসলে আমরা কী অর্জন করতে চাইছি? এক বোতলের ছিপি আরেক বোতলে লাগাতে গেলে যে বিপত্তি ঘটে এক্ষেত্রেও কি তেমনটা হওয়া সংগত নয়? তদুপরি, এ চর্চা উসকে দেয়ার পেছনে বিরাট ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। সেটা নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

যা বলছিলাম, আগে অচেনা-অজানা মানুষরাও ছোটদের শাসন করার অধিকার রাখত বলে কিশোর-তরুণরা বেয়াড়া হওয়ার সাহস পেত না। তাছাড়া তখন সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকদের এত আদিখ্যেতা ছিল না। এখন বহু চেষ্টার পর দু-একটা সন্তান হওয়ায় অভিভাবকরা তাকে শাসন করার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু সন্তানের কল্যাণের জন্যই তো শাসন দরকার। নইলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রিয়তম সন্তানটি ও তার পরিবার। কারণ শাসনের মধ্যে বড় হলে সন্তানরা ঘাতসহ হয়। নইলে সামান্য ঘটনায় হতাশ হওয়া, বাসা থেকে পালানো, নেশাগ্রস্ত হওয়া, আত্মহত্যা চেষ্টার প্রবণতা বাড়ে। প্রত্যাশিত মাত্রায় কষ্ট সহ্য করার চর্চা না থাকায় তারা সামান্যতে ভেঙে পড়ে। তাই তাদের কল্যাণের কথা ভেবেই সোহাগের পাশাপাশি শাসন করা জরুরি। আমার পরিচিত একজনের (ছয় বছর বয়সী) সন্তান বাসায় তো বটেই এমনকি স্কুলে যাওয়ার পথেও পুরো সময় স্মার্টফোনে ব্যস্ত থাকে। তাকে বললাম, ক্লাসে যাওয়ার পরও তো সন্তান দীর্ঘসময় পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে পারবে না। জবাবে তিনি বললেন, ফোন না দিলে সে তো স্কুলেই যাবে না!

নিজের সন্তানের ওপর এতটুকু নিয়ন্ত্রণ না থাকলে অন্যদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এখন প্রতিবেশী, সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজনের সন্তানদের অগ্রহণযোগ্য আচরণ সবাই ওভারলুক করি। তাদের বেয়াদবি দেখার পরও নিজের মানসম্মান রক্ষায় বিষয়টা এড়িয়ে যাই। এমন আচরণের মাধ্যমে আমরা আসলে নিজেদের সন্তানদেরও উচ্ছন্নে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করছি। কারণ সে তো তেমন সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গেই মিশবে। তাদের আচরণকে রেফারেন্স হিসেবে মাঝেমধ্যে উল্লেখ করবে, তার ভেতরেও তেমনটা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হবে। আসলে নিজেদের গুটিয়ে নিতে নিতে আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যে পাশের ফ্ল্যাটে মাঝরাতে উচ্চশব্দে মিউজিক বাজলেও কিছু বলা যায় না। এমনকি পরিবারের তরুণ সদস্যটি বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করলেও কিছু বলতে পারি না। কর্মক্ষেত্র, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র এমন বিশৃঙ্খলা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। আসলে পিঠ অনেক আগেই দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর পেছানোর জায়গা অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। তাই ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। আর সেটা নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ আগে ঘর, তবে তো পর, তাই না?

পরিশেষে বলব, কুমোরদের আকর্ষণীয় মৃৎপাত্র বানানোর পদ্ধতিটা খেয়াল করুন। কাজের শুরুটা হয় এক দলা কাদা মাটি থেকে। কাঙ্ক্ষিত পাত্র তৈরির লক্ষ্যে তারা চারপাশ থেকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় চাপ দিতে থাকে। দৃঢ় হাতের চাপ খেয়ে মাটির দলাটি ক্রমেই প্রত্যাশিত আকার ধারণ করতে থাকে। তারপর সেটা নির্দিষ্ট সময় ধরে উচ্চতাপে আগুনে পোড়ানো হয়। তবেই পাওয়া যায় দৃষ্টিনন্দন ও টেকসই মৃৎপাত্র। উপমা হিসেবে বলা হয় শিশুরা কাদামাটির মতো। শৈশবে তাদের যেভাবে গড়া হয় বড় হয়ে তেমন আকারই ধারণ করে। আমাদের শৈশবে নিশ্চিতভাবেই বহুমুখী চাপে থাকতাম। হয়তো সে কারণেই আজকের পর্যায়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এখনকার শিশুরা অতিদরকারি সেই চাপ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে নিত্যদিন অপ্রত্যাশিত নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বহু চেষ্টা করেও প্রত্যাশিত ফল মিলছে না। সৌজন্য: বণিক বার্তা

লেখক: ড. মো. আব্দুল হামিদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক

পূর্বকোণ/সাফা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট