চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা : চাই সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

৭ জুলাই, ২০২১ | ৮:০৭ অপরাহ্ণ

জলাবদ্ধতা সমস্যায় চট্টগ্রামবাসীকে ভুগতে হচ্ছে অনেকদিন থেকে। কপাল পোড়া চট্টগ্রামবাসী এই ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে যেন মুক্তির কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। জনপ্রতিনিধিগণ যেন আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে এই হতভাগা নগরবাসীকে। এটাই এখন নগরবাসীর গলার কাঁটা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

গত ৩০ জুন চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকার টিএন্ডটি কলোনীর বাইলেইন সড়কে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটে। সিএনজি অটোরিক্সা টিএন্ডটি কলোনীর বাইলেইন সড়ক হয়ে মূল সড়কে আসার পথে সরু সড়কটি দখল করে গড়ে উঠা একটি সিঁড়িতে ধাক্কা লাগে। এই সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেটি পাশের চশমা খালে পড়ে যায়। পানির স্রোতে ভেসে যায় প্রায় ১০০ ফুট দূরে। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন স্থানীয়দের সহায়তায় সিএনজি অটোরিক্সাটি খাল থেকে উদ্ধার করে।

চালক এবং যাত্রীকে মুমূর্ষ অবস্থায় দ্রুত চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করে। সিএনজি অটোরিক্সার অন্যযাত্রীরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জনগণের চলাচলের রাস্তার উপর অবৈধভাবে বাড়ির সিঁড়ি নির্মাণ করায় এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে যায়- অন্যদের মতো এ ঘটনায় আমিও ভীষণ শোকাহত। এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা, যা পাষাণ হৃদয়কেও নাড়া দিতে বাধ্য।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা সমস্যা, এটি অনেক পুরানো, নতুন কিছু নয়। এই পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আসবে, কয়েক বছর ধরে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে এমন আশ্বাস পেয়ে আসছিল নগরবাসী। এই আশ্বাস শুধু মুখেই সীমিত, বাস্তব চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। ভারী বৃষ্টি হলেই এখন আগের মতোই ডুবছে নগরী। যেন এক টুকরো কর্ণফুলী শহরের মাঝে অবস্থান করছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে চারবছর আগে হাতে নেওয়া প্রকল্পের কাজের অগ্রগতিও থেমে আছে আগের জায়গায়। এরই মধ্যে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে আরো দুই বছর। জলাবদ্ধতার কবলে পড়ার আশংকা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে এবারের বর্ষায়। অবশ্য বর্ষার আগেই গ্রীষ্ম মৌসুমের প্রথম ভারী বৃষ্টিতেই নগরীর অনেক এলাকা তলিয়ে যায় অনেক পানিতে। প্রকল্পের কাজের অংশ হিসাবে নগরীর খালগুলোর মধ্যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খালগুলো খনন না করায় এতে জন্মেছে আগাছা। আটকে গেছে পানি চলাচলের পথ। ফলে বর্ষার আগেই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী।

চট্টগ্রাম শহরে ভারী বৃষ্টি জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার সময় প্রতিবছর মানুষের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে যায়। এতে নষ্ট হয় বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতায় গত এক দশকে ২৫১৭ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০০০ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামবাসীর কপালে বড় দুঃখ আছে বলতে হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে বিভিন্ন কমিটির উদ্ভব ঘটে কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে সেগুলো উধাও হয়ে যায়। এবছরও নগরবাসী জলাবদ্ধতায় শিকার হওয়ার যে আশংকা করছে তার জন্য অর্থাভাবসহ নানা জটিলতায় জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে কাজের ধীরগতি ও করোনার প্রভাবকে দায়ী করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সিডিএ’র প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। সিডিএ’র ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়। ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে খালের আবর্জনা অপসারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রকল্পের কার্যক্রম। ইতিমধ্যে নগরের ৩৫টি খাল থেকে ৩ হাজার ১৭৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।

২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল প্রকল্পের কাজ উদ্বোধনের সময় তৎকালীন সিডিএ’র চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেছিলেন, এ বছর না হলেও আগামী বছর দৃশ্যমান পরিবর্তন হবে। তার সেদিনের সেই কথা যেন কথার ফুলঝুড়িতে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। অনেক বড় বড় জনপ্রতিনিধিরাও জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে অনেক আশা দিয়ে রাখেন চট্টগ্রামবাসীকে কিন্তু জলাবদ্ধতা থেকে আদৌ মুক্তি পাচ্ছে না নগরীর বাসিন্দারা। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ ১ বছর বাড়িয়ে চলতিবছর জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, এখন আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। এভাবে দুই দফায় মেয়াদ বাড়তে চললেও প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ। গতবছর পর্যন্ত যা ছিল ৪০ শতাংশ। নগরীর বিভিন্ন খালে চলছে প্রতিরোধ দেওয়ালের নির্মাণ কাজ। পাঁচটি খালের মুখে দেওয়া হচ্ছে জলকপাট। এসব কারণে খালগুলোর বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় খালের ভিতরেই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে পানি চলাচলের পথ সরু হয়ে গেছে। নগরীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ চাক্তাই খাল। এই খালের চকবাজার কাঁচাবাজার অংশে রীতিমতো ঝোপঝাড় জন্মেছে। অনেক জায়গায় ময়লা আবর্জনা আর পলিথিনে ভর্তি হয়ে আছে। কর্ণফুলী নদীর সাথে যুক্ত খালে চলছে জলকপাট নির্মাণ।

গত ৩০ জুনের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি নগরবাসীকে প্রতিক্ষণেই তাদের হৃদয়কে নাড়া দিচ্ছে। আর যেখানে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে তা হচ্ছে চশমা খাল। এ খাল ২নং গেইট ও মুরাদপুর এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খাল প্রশস্ত করতে ও প্রতিরোধ দেওয়াল নির্মাণের জন্য বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে পানি জমে থাকছে।

আগামী ১ মাস পুরোদমে কাজ চলবে বলে বাঁধগুলো পুরোপুরি অপসারণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক লে. কর্ণেল মো. শাহ আলী। এখন খাল পরিষ্কারের কাজ চলছে। যেভাবে ঢিমেতালে কাজ চলছে তা নগরবাসীর দুঃখই বরং বাড়তেই থাকবে। আর এই দুঃখের শেষঠিকানা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা একমাত্র জানেন আল্লাহতা’লা। চট্টগ্রামবাসীর দুঃখ এই জলাবদ্ধতা কবে নিরসন হবে সেই আশায় বুক বেঁধে আছি আমরা কপালপোড়া নগরবাসী।

লেখক: ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট