চট্টগ্রাম শনিবার, ১১ মে, ২০২৪

আওয়ামী লীগ, বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাথা

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

২৩ জুন, ২০২১ | ১০:০২ অপরাহ্ণ

আজ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্মদিন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পুরোনো ঢাকার টিকাটুলী কে এম দাশ লেইনের রোজ গার্ডেন হল রুমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী ও মাওলানা ভাসানীর আহবানে অনুষ্ঠিত এক কনভেনশনে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ভূমিষ্ঠ হয়। নবজাতকের নামকরণ করা হয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, সেদিন সাম্প্রদায়িকতাকবলিত রাজনৈতিক পরিবেশে সেটাই ছিলো সঙ্গত। শুধু আওয়ামী লীগ নামকরণ করলে মুসলিম লীগ সরকার খড়গ নিয়ে ছুটে আসতো। নতুন দলের মধ্যে ‘হিন্দুয়ানি’ আবিষ্কার করে উদ্যোক্তাদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়ার অপপ্রয়াস পেতো।

যাই হোক, আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হয়েছিলেন মাওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক এবং যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু)। পদ না নিলেও সোহরাওয়ার্দী সাহেবই ছিলেন মূল নেতা। তিনি পরে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন।

রোজ গার্ডেন সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে ১১ জন ডেলিগেট যোগ দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। অনেক অনুসন্ধান করে ১০ জনের নাম আমি জানতে পেরেছি। তাঁরা হচ্ছেন এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, সালারে জিলা শেখ মোজাফফর আহমদ (শহীদ), আমীর হোসেন দোভাষ, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, ইউনুস খান, মাওলানা ছালে জহুর, মাওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, রেদওয়ানুল বারী। বাকী একজনের নাম নিয়ে আমি নিঃসন্দেহ হতে পারিনি। এক্ষেত্রে তিনটি বিকল্প নাম আমি বিবেচনায় এনেছি। তিনটি নাম হচ্ছে- আবুল খায়ের সিদ্দিকী, গোরা আজিজ (চকরিয়ার আজিজুর রহমান) ও হারবাংয়ের ডা. আনোয়ার হোসেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে একজন আবুল খায়েরের নাম আছে। আবু খায়ের সিদ্দিকী ছাড়া দ্বিতীয় কোন আবুল খায়ের আমি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুঁজে পাইনি। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় সিদ্দিকীও বিভাগ-পূর্ব মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দী ব্লকে ছিলেন। ফজলুল কাদের চৌধুরীও তাই। সিদ্দিকী এবং চৌধুরী রোজগার্ডেন সম্মেলনে যোগদানের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনীকাররা এমন তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা গিয়ে চৌধুরী মত পরিবর্তন করেন। রোডগার্ডেন-এ তিনি আর যাননি। সিদ্দিকী সম্পর্কে ভিন্ন কোন তথ্য আমি পাইনি। সুতরাং তিনি রোজগার্ডেন সম্মেলনে যেতেও পারেন। তবে সিদ্দিকী পরবর্তীকালে কখনো আওয়ামী লীগ করেন নি। তিনি সারাজীবন মুসলিম লীগেই ছিলেন। তাকে বাদ দিলে গোরা আজিজের নাম আসে। গোরা আজিজ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। স্বাধীনতার পর তাঁকে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম থেকে গণভবনে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা থেকে এমনটা ভাবতে প্রলুব্ধ হই যে, তিনি হয়তো রোডগার্ডেন সম্মেলনে গিয়েছিলেন। তিনি যদি না যেয়ে থাকেন তাহলে যে নামটি আমার সামনে চলে আসে সেটি হলো ডা. আনোয়ার হোসেন। তিনি এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের আগে পরে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তাঁর বলিষ্ঠ পদচারণার প্রমাণ পাওয়া যায়। একারণে তাঁর রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

রোজ গার্ডেন সম্মেলন থেকে এসেই নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের শাখা গঠন করার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেন এবং অল্প দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে ফেলেন। চট্টগ্রামে প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটিই কমিটি গঠন করা হয়। টেকনাফ থেকে শুভপুর পর্যন্ত একটিই চট্টগ্রাম জেলা- চট্টগ্রামে দুটি মহকুমা- সদর ও কক্সবাজার; রাঙামাটিও  চট্টগ্রাম জেলার অধীন একটি মহকুমা। শহর আওয়ামী লীগ ছিলো তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে চিহ্নিত। শহর আওয়ামী মুসলিম লীগের স্ট্যাটাস ছিলো একটি   সাংগঠনিক থানার সমান।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সালারে জিলা শেখ মোজাফফর আহমদ, সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ। জহুর আহমদ চৌধুরী জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক অথবা সহ-সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতেও প্রথম দিকে বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন প্রসঙ্গ আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন প্রথম দিকে দু’কমিটি জেলায় সেখানকার নেতার আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করে ফেলেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম একটি। অন্য যে দুজেলার তিনি নাম উল্লেখ করেন, সে দুটি হলো- আবদুল জব্বার খদ্দরের নোয়াখালী, মশিউর রহমানের যশোর, মুজিবুর রহমানের রাজশাহী। চট্টগ্রামে তাঁর বন্ধু আজিজ, জহুর, শেখ মোজাফ্ফরসহ এবং ডা. সুলতান আহমদের কথা উল্লেখ করেছেন। ডা. সুলতান পরে কুমিল্লায় স্থানান্তরিত হয়ে সেখানেই বাকী জীবন অতিবাহিত করেন।

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ অথবা ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমভাগে আমীর হোসেন দোভাষকে সভাপতি ও জহুর আহমদ চৌধুরীকে সাধারণ করে পৃথক শহর আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্মের (১৪ আগস্ট ১৯৪৭) ১০ মাস পর (২৩ জুন ১৯৪৯), আওয়ামী লীগের আবির্ভাবের তাৎপর্য বুঝতে হলো কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পূর্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম যথা ফকির বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তিতুমীরের লড়াই, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীর কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা কংগ্রেসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা- যেমন স্বদেশী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, বিওসির শ্রমিক ধর্মঘট, আসামের চা বাগান শ্রমিকদের রক্তাক্ত আন্দোলন চাঁদপুরে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে অস্ত্রাগার দখল ও স্বাধীনতা ঘোষণা করে চট্টগ্রামের বিদ্রোহ, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলীতে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পর প্রীতিলতার আত্মাহুতি- সংগ্রামের এইসব ধাপ অতিক্রম করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট বিপ্লবে ব্রিটিশকে ভারত ছাড়ার জন্য যখন ভারতবাসীর চরম সংকল্প ঘোষণা হলো, ঠিক তখনই মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ধূয়া তুলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য অনমনীয় জেদ ধরলে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম সাম্প্রদায়িকতার চোরাবালিতে বিপথগামী হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি কেঁপে উঠেছিলো, নেতাজী সুভাষ বসু এই সুযোগে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।  কিন্তু আমেরিকার পারমানবিক বোমা নিক্ষেপের পর জাপানের আত্মসমর্পণ, পরপর হিটলার ও মুসোলিনির পরাজয়ের পটভূমিতে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশকে পাকিস্তান ও ভারত দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত ক্ষমতা ত্যাগ করে। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরতচন্দ্র ও কিরণ শঙ্কর রায় শেষ মুহূর্তে বাংলা ভাগ ঠেকাতে চেয়েও ব্যর্থ হন।

পাকিস্তান হলো, কিন্তু বাঙালি স্বাধীনতা পেলো না। বাংলাদেশ  (সে সময় পূর্ববঙ্গ) নতুন করে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলো। বঙ্গবন্ধু এটা সবার আগে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি কলকাতা থেকে ঢাকা আসার পূর্বে ইসলামিয়া কলেজের সিরাজদ্দৌলা হলে তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীদের নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়ে বলেছিলেন আমরা হয়তো স্বাধীনতা পেলাম না। আমাদের নতুন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করতে হবে ঢাকায় গিয়ে।

ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ গঠনের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতার সংগ্রামে সূচনা করেছিলেন তিনি। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল হলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে  ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করা হলো।

১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা হন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮, ১৯, ও ২০ মার্চ ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ৬ দফা ঘোষণা করার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি নতুন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকলো। সেই ধারা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হলো। ৬৯-এর প্রবল গণঅভ্যুত্থানে সেই মামলা খড়কুটের মতো উড়ে গেল। ক্যান্টনমেন্টের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ । ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাঙালির একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত হলো। পাকিস্তানি জেনারেলরা বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দেয়ার চক্রান্তে মেতে উঠলো। চাপের মুখে ৩ মার্চ ’৭১ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন ডেকেও  ১ মার্চ এক আকস্মিক ঘোষণায় ইয়াহিয়া সেই অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলো।

২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গণহত্যার মিশন নিয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণ পরাজয় বরণ করে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগেরই অবদান।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বীর মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক।

পূর্বকোণ/মামুন/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট