চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অনলাইন আর নয়, সরাসরি ক্লাস চাই

২১ জুন, ২০২১ | ৮:২১ অপরাহ্ণ

প্রাচীনকালে বৌদ্ধবিহারকে কেন্দ্র করে জ্ঞান অন্বেষণের যে চেষ্টা তা থেকে কালের আবর্তে আধুনিক শিক্ষার প্রচলন হতে থাকে। মধ্যযুগে মোগল আমলে পাঠশালা কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা যা থেকে বিজ্ঞান ও মনন চর্চার ক্ষেত্র তৈরি হয়। কুঁড়েঘরে বা গাছতলার যে শিক্ষা তখন গড়ে উঠেছিল তা ছিল মননচর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সময়োপযোগি, যাকে বাস্তবভিত্তিক লোকশিক্ষা হিসাবেও অবহিত করা হয়েছিল। মধ্যযুগের এই প্রাথমিক শিক্ষার ধরন ছিল মূলত পাঠশালা শিক্ষা + লোকশিক্ষা = সাধারণ শিক্ষা।

বস্তুত তখন গ্রামের আনাচেকানাচে এই ধরনের শিক্ষার প্রচলন ছিল। ১৮০৩ সালে ইংরেজ লেখক ওয়ার্ড তার গ্রন্থে লিখেছিলেন এভাবে, ‘বাংলার প্রায় সব ঘরেই লেখা-পড়া ও অংক শেখানোর জন্য পাঠশালা ছিল।’ এভাবে কালে কালে শিক্ষাবিস্তার ও প্রয়োজন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠে। কিন্তু মহামারি করোনা এসে সবকিছুকেই এলোমেলো বিধস্ত করে দিয়েছে। হঠাৎ ঘোষণা ২০২০ সালের মার্চের ১৭ তারিখ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সেই যে বন্ধ হল, আর শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকার্যক্রমে আসতে পারেনি। তাদের সুন্দর পবিত্র মুখ যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখেনি তেমনি তারাও হাসি আনন্দের জায়গা প্রতিষ্ঠান দেখতে পায়নি। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে আমার এই লেখা।

পুরোবিশ্ব এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। হতভম্ব পুরোবিশ্ব নানাভাবে থমকে গেছে। এটি যে শিক্ষা শুধু তাই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কি জীবন যাপনে এসেছে নানা পরিবর্তন। আপনজন হয়েছে পর। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের সবকিছু ধীরে ধীরে চালু হয়, মানুষের মধ্যে গতি ফিরে আসে। কিন্তু সকল ধকল চলে আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর ক্ষেত্রে এবং পাবলিক পরীক্ষাগুলো গ্রহণের ক্ষেত্রে। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন তার জবাব সাদামাটাভাবে কয়েকবার হয়ত শিক্ষামন্ত্রী দিয়েছেন কিন্তু এই যুক্তিগুলো অনেকক্ষেত্রে মিলেনি। শিক্ষা উপ-মন্ত্রী বলেছেন, এটি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্ত নয়, কারণ করোনাবিষয়ে কারিগরি কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও এর সাথে সম্পৃক্ত। প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

এই পরিস্থিতির জন্য শুধু যে শিক্ষামন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দায়ী তা নয়, শিক্ষকসমাজও জোর করে কিছুই বলছেন না। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে বেসকারি বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের কিছু বলবার দৃশ্য। কার্যত তেমন জোরালো ভূমিকা শিক্ষকসমাজের দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষকসমাজের এই অবস্থা দেখে আমার মনে হয় পুরো দায়টা সরকারের। এখানে বলা দরকার যে, এমপি, সরকারি, ক্যাডেট সকল পর্যায়ের শিক্ষকগণ তাদের বেতন-ভাতা যথাসময়ে পাচ্ছেন। তাহলে খোলার বা দরকার কি এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। যা মোটেই স্বস্থির বিষয় নয়।

করোনায় আমাদের পুলিশবাহিনী, ডাক্তার, সাংবাদিক সবাই কমবেশি এগিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেকেই আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। শিক্ষকসমাজকেও এগিয়ে আসা উচিত ছিল। সরকার ইতিমধ্যে বলছেন ৪০ বছরের উপরের অধিকাংশ শিক্ষককে ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছেন। তাহলে ভয়টা কোথায়? শিক্ষকসমাজ একযোগে দায়িত্ব নিক, বলুক আমরাও প্রস্তুত আছি, ছাত্রদের শ্রেণিকার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে, তাহলে সরকারও নড়েচড়ে বসবেন। বলবেন তাহলে পরীক্ষামূলক হলেও দায়িত্ব দিয়ে দেখা যাক, কি হয়? হতে পারে। কিন্তু উভয়পক্ষ  নীরব।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সকল শিক্ষক, শিক্ষা-উদ্যোক্তা, গবেষক একসাথে বসে একটি কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। যে কর্ম-পরিকল্পনার মাধ্যমে কবে কখন, কিভাবে প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকার্যক্রম চালু করা যায়, তার একটি দিক-নির্দেশনা বের করা সম্ভব। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে এর সমাধান কখনও হবে না। সরকার বলবে সব করব, এমন একটি চিন্তুা শিক্ষকসমাজ থেকে কখনও কোন কালে কেউ আশা করেনি। শিক্ষার্থীদের সকল বিধিবিধান মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই ভূমিকা পালন করবে। এসব পরিস্থিতির আলোকে আমার কিছু পরামর্শ তুলে ধরতে চাই- 

ক) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রয়োজনীয় ক্লাসগুলো প্রথমে চালু করুন। খ) এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস চালু করুন। যে সকল প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী বেশি তাদের একাধিক শিফট করুন। আসনসংখ্যা কমিয়ে আনুন। দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাসে বসবার ব্যবস্থা করুন। প্রবেশ-বাহির ও অবস্থানে কড়া নজরদারি করুন। স্বাস্থ্যবিধি যাতে উপেক্ষিত না হয় সেদিকে নজরদারির জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সামর্থবান শিক্ষকদের সমন্বয়ে নজরদারি টিম তৈরি করুন। প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের সস্পৃক্ত করুন। অভিভাবদের এই বিষয়গুলোতে সম্পৃক্ত করুন। এই কার্যক্রমটি ১৫ দিনের জন্য চালু করুন। যদি সুন্দর অবস্থা থাকে তাহলে ধীরে ধীরে বড় থেকে ছোট ক্লাসগুলো একই পদ্ধতি চালু করুন।

অপরদিকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কোনক্রমেই বাদ দিয়ে অন্যকোন চিন্তা না করার পরামর্শ দিচ্ছি। কারণ পরীক্ষা ব্যতিত বিকল্প পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সুদূরপ্রসারী যে প্রতিক্রিয়া এটি এখনও বুঝবার সময় আসেনি। দয়া করে সেদিকে পা বাড়াবেন না। এই ক্ষেত্রে পরামর্শ হল- ক) নম্বর, বিষয়, সময় কমিয়ে কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করুন। খ) প্রয়োজনে এমসিকিউ পদ্ধতিতে অতি সংক্ষেপে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করুন।

২০২১ সালের জুনের ২৮ তারিখ সোমবার থেকে জুলাই মাসের ১৫ তারিখ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে শ্রেণিকার্যক্রম শুরু করা যায়। এতে করে পবিত্র ঈদ-উল আজহার পূর্বে আমরা পরিস্থিতি বুঝবার সুযোগ পাব। ঈদের পর অন্যান্য শ্রেণির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও সম্ভব হবে এবং আগস্টের মাঝামাঝি বা শেষদিকে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করতেও আর বাঁধা থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা জাতি হিসাবে কতটা ক্ষতির কাছাকাছি আমরা পৌঁছে যাচ্ছি তা অনুমান করাও কঠিন হবে। বিকল্প অনেক ভাবতে পারবেন, তবে আমার কাছে এর চেয়ে সুন্দর বিকল্প আর এই মুহূর্তে নাই। আমি জানি আমাদের এই আবেদনগুলো আপনাদের পর্যন্ত পৌঁছায় না।

অনলাইন ক্লাস ইতিমধ্যে তার যে অবস্থান; শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী বা অভিভাবকের কাছে ঠুনকো করো দিয়েছে। তার জৌলুশ হারিয়েছে বহু আগে। আর সরকার যে পদ্ধতিগুলো দিয়েছে তাও ইতিমধ্যে ছাত্রদের কাছে হারিয়েছে সবকিছু। শারীরিক উপস্থিতির আবেদন কখনও শিক্ষাপ্রতষ্ঠান হারাবে না। বরং মোবাইল আসক্তি আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের ধীরে ধীরে তাদের ধ্বংসলীলায় পৌঁছে দিচ্ছে। তাদের আচার-আচরণ কথা ও চলনে এক ধরনের মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছে, যা মোটেই আমাদের জন্য স্বস্থির কারণ হতে পারে না। তাই স্বল্পসময়ের মধ্যে শ্রেণিকার্যক্রম নিয়ে ভাবনার প্রয়োজনীয়তা দেখি। আমার বিশ্বাস সরকার মানুষের তথা আগামীদিনের কথা সহসা ভাবতে চেষ্টা করবে। প্রজন্মকে বাঁচাবে।

মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন- শিক্ষাবিদ, নজরুল গবেষক।

পূর্বকোণ/এএ /পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট