চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনা অর্থনীতির দ্বিতীয় বাজেট : কিছু প্রস্তাবনা

 ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম 

২৭ মে, ২০২১ | ১:৩৬ অপরাহ্ণ

বিধ্বংসী করোনা থাবায় ক্ষতবিক্ষত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রণীত বাজেট শিগগিরই মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন হতে যাচ্ছে। সচরাচর বাজেট প্রস্তুতকালে প্রবৃদ্ধিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয় কিন্তু এবারের বাজেটে গুরুত্বপ্রাপ্ত বিষয় হল জনগণের জীবন-জীবিকা। আনুমনিক ৬ লক্ষ কোটি টাকার এ বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লক্ষ কোটি টাকার মত, যা জিডিপির প্রায় ৬.৫ ভাগ।

ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক খাত হতে পারে অন্যতম উৎস। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্যের মজুদ রয়েছে। তাছাড়া উন্নয়ন সহযোগিরা আরও সাহায্য প্রদানে আগ্রহী। সরকার ইচ্ছা করলে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ১ লক্ষ কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার করতে পারে। এদিকে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঘাটতি অর্থায়নে তেমন সমস্যা হবে না, কারণ ব্যাংকসমূহে রয়েছে ব্যাপক তারল্য। কেবল মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকসমূহে অতিরিক্ত তারল্য ২ লক্ষ কোটি টাকার অধিক। সার্বিক বিবেচনায় ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়নে তেমন বেগ পেতে হবে না, বরং জিডিপির ৬.৫ ভাগ ঘাটতি বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটাই কাম্য। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বল্পোন্নত দেশের জন্য জিডিপির শতকরা ৫ ভাগ ঘাটতি বাজেট সুপারিশ করে থাকে।

স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষির মত খাতসমূহকে গুরুত্ব দেয়া হলে বাজেটের বড় ঘাটতি বরং কল্যাণকর হতে পারে। করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিপথ ফিরে পেতে হলে বর্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে বেশ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আসন্ন বাজেটে এডিপির জন্য বরাদ্দ প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতই এডিপি বরাদ্দের বড় অংশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পে ব্যয় হবে। সমসাময়িক পরিস্থিতির আলোকে এডিপির খাতসমূহ পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। বর্তমান সময়ে করোনার সংক্রমণ ন্যূনতম রাখতে বারবার লকডাউন ঘোষণা করতে হয়।

কিন্তু বিশাল জনগোষ্ঠীকে টীকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক কর্মকা- বন্ধ রাখার প্রয়োজন হবে না। স্বাস্থ্যখাতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ নিতান্তই অপ্রতুল। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে অপারগতা এ খাতের দৈন্যদশার পরিচায়ক। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর স্বাস্থ্যমন্ত্রলায় প্রথম আট মাসে এডিপিতে বরাদ্দের মাত্র ২০ ভাগ ব্যয় করতে পেরেছে। এমন মহামারিতেও ২০২১ সালে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ০.৯২ ভাগ যা পূর্বের বছর ছিল ০.৮৪ ভাগ।
করোনায় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত অপর খাত হল শিক্ষা। গত বছরের মার্চ থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী ঘরে আটকা, যদের দুই-তৃতীয়াংশ প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকায় অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। ২০২১-২০২২ অর্থবছর শিক্ষাখাতে এডিপির প্রস্তাবিত বরাদ্দ মাত্র ২৩ হাজার কোটি টাকা। উচ্চাভিলাসী খাতসমূহের বরাদ্দ কমিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি অধিক সময়োপযোগী হবে।

তুলনামূলক বিবেচনায় বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় প্রতিবেশি সকল দেশের তুলনায় কম। দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ গড়ে জিডিপির ৬ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যয় করে, ইউরোপে যদিও এ পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ কিন্তু বাংলাদেশে কখনোই তা জিডিপির ৩ ভাগের অধিক ছিল না। তা-ও আবার এ ৩ ভাগের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ ব্যয়িত অর্থের যে হিসাব তা অন্তর্ভূক্ত! বাজেটে বরাদ্দ পুনর্বন্টনের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বৃদ্ধি অপরিহার্য।

করোনা অভিঘাত আমাদের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। গত এক বছরে ২.৪৫ কোটি মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। ২০১৫ সালে সরকার ৩.৫৭ কোটি দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় আনার নিমিত্তে ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল’ (এনএসএসএস) প্রণয়ন করে কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। যারা এ সুবিধা প্রাপ্য তারা তালিকাভুক্ত না হয়ে বরং ক্ষমতাসীনদের সানুগ্রহে ভুল ব্যক্তিবর্গ সামাজিক সুবিধার ভাগ নেয়। বর্তমান বাজেট সামাজিক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করবে এমনটিই সকলের চাওয়া। প্রয়োজনে পৃথক বরাদ্দ রেখে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপাত্ত সম্বলিত একটি সুসংহত তথ্যভান্ডার তৈরি করা যেতে পারে।

গত বছর মার্চ মাস হতে সরকার সর্বমোট ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার ২৩ টি প্রণোদনা পেকেজ ঘোষণা করেছে যা জিডিপির শতকরা ৪.৯ ভাগ। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অধিকাংশই ব্যাংক-নির্ভর। সত্যিকার অর্থে এসব প্রণোদনার সুফল যারা পেয়েছে তারা লক্ষ্য ছিল না। বড় শিল্প ও ব্যবসায়ীরা সহজেই ব্যাংক হতে ঋণ সংগ্রহ করতে পেরেছে কারণ ব্যাংক তাদের ব্যাপারে অধিক আগ্রহী।

ফলস্বরূপ, এসব খাতে প্রণোদনা প্রায় শতভাগ বণ্টিত হয়েছে। পক্ষান্তরে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে ব্যাংক অতটা মনোযোগী না থাকায় এ শ্রেণি প্রণোদনার সুবিধা পায়নি। শ্রমনিবিড় এসব শিল্প সরকার প্রদত্ত প্রণোদনার সুবিধা ভোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ও ব্যবসায়ীদের জন্য ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের শতকরা ৭৩ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র। এ খাতে প্রণোদনা বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হল সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকা। কারা ক্ষুদে ব্যবসায়ী আর কারা বড়, কতজন শ্রমিক নিয়োজিত থাকলে এ সুবিধার আওতায় আসবে এসব বিষয় অস্পষ্ট থাকায় করোনা মহামারিতে অধিকাংশ ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়েছে এবং অবশিষ্ট অংশ অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বাজেটে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য নগদ সুবিধার ব্যবস্থা রাখলে তা অধিক ফলপ্রসূ হবে। অবশ্যই এ কাজ সফল করতে সঠিক তথ্যভান্ডার থাকা চাই। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মত এদেশেও কর্মসংস্থান স্কীম থাকা আবশ্যক। এতে করে করোনার মত যেকোনো অভিঘাতে কর্মহারা মানুষগুলো অস্থায়ীভাবে হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।

করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেটটি প্রস্তুত করতে সরকার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। পূর্ববর্তী বছর এ সুযোগ ছিল না। তড়িঘড়ি করে দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি বাজেট উপস্থাপন করা হয় যেখানে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা ছিল ৮.২ ভাগ, যা পরপর দু’বার পরিবর্তন করে নির্ধারণ করা হয় ৬.১ ভাগ, যদিও বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হতে পারে সর্বোচ্চ ৫.৬ ভাগ। করোনার প্রথম বাজেট প্রস্তুতকালে অনুমান করা হয়েছিল, তিন বা চার মাসের মধ্যে মহামারি নিশ্চিহ্ন হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রণীত বাজেট এমন ভুল অনুমান-নির্ভর নয়। তাছাড়া অর্থনীতির কিছু সূচক অনেক সুসংহত, প্রবাসিদের প্রেরিত আয় তথা রেমিট্যান্স তাদের মধ্যে অন্যতম। ২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স অর্জন করে। দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।
ডিজিটালাইজেশনসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মূল কারণ। অর্থনীতির চালিকাশক্তি রপ্তানিখাত কিছু আঞ্চলিক সুবিধা পেতে পারে। ভারতের ক্রমাবনত কোভিড পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের রপ্তানিতে ধনাত্বক প্রভাব ফেলতে পারে। এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সমাগম লক্ষণীয়। সার্বিকভাবে, সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব ও আর্থিক নীতির সংমিশ্রণে প্রণীত করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট মুদ্রাস্ফীতিকে ৫ ভাগে আটক রেখে ৭ ভাগ জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে- এমনটিই আশা।

লেখক: ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট