চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দুই বছরেই কোটিপতি জয়নাল

চাকরির ১৫ বছর ১০ মাসে বেতন ভাতা পান ২২ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ টাকা হ স্ত্রীর নামে সম্পদ, ভাইয়ের নামে কিনেছেন পাঁচটি ট্যাক্সি হ আরো মামলা করবে, অনুসন্ধান চালাবে দুদক

ইমাম হোসাইন রাজু

১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

মাত্র ২ হাজার ৯৩০ টাকা বেতনে ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে পিয়ন পদে নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন জয়নাল আবেদীন। সর্বশেষ চলতি বছরের আগস্টে সর্বসাকূল্যে ৩৭ হাজার ৮৫০ টাকা বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন তিনি। হিসেব অনুযায়ী চাকরির ১৫ বছর ১০ মাসে তিনি সরকার থেকে বেতন ভাতা প্রাপ্ত হন সর্বসাকূল্যে ২২ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ টাকা। যার সবগুলো টাকাই তিনি প্রতিমাসে উত্তোলন করেছেন।
চাকরির বাইরে জয়নালের অন্য কোন আয়ের উৎস না থাকলেও মাত্র দুই বছরে মালিক হয়েছেন কয়েক কোটি টাকার। যার কিছু অংশ তার স্ত্রী আনিছুন নাহার বেগমের নামে এবং তার এক ভাইয়ের নামে করেছেন। সবগুলো সম্পত্তি শুধুমাত্র রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে গড়েছেন তিনি । এরমধ্যে ২০১৮ সালে ভাইয়ের নামে ক্রয় করেছেন পাঁচটি সিএনজি ট্যাক্সিও। যার সবগুলো টাকা জয়নাল নিজেই দিয়েছেন। এর তথ্য ইতোমধ্যে দুদকের কাছে রয়েছে।

ইতোমধ্যে দুদক জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগে জয়নাল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছে। যদিও দীর্ঘদিন থেকে জয়নালের স্ত্রী আনিছুন নাহার পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারছেনা না সংস্থাটি। তবে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া জয়নালকে জেল গেটে দুদকের টিম জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ বিষয়ে স্বীকারোক্তিও দেন তিনি।

দুদক বলছে, জয়নালের জ্ঞাত আয় কিংবা মানি লন্ডারিং মামলা ছাড়াও আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তার বিষয়ে নির্বচান কমিশন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়েই অনুসন্ধান কাজ করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি।
দুদকের জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পত্তি মামলার সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩০ জুলাইয়ে তার নিজ গ্রাম বাঁশখালী পৌরসভার উত্তর জলদী মৌজায় ৫ শতাংশ নাল জমি ক্রয় করেন ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় (দলিল নং-৪২২৯৫)। যাতে তিনি ইতোমধ্যে পাঁচ তলা ফাউন্ডেশন নিয়ে তৃতীয় তলা পর্যন্ত ভবন তৈরির কাজ শেষ করেছেন। এসব কাজে তার ব্যয় হয়েছে ৬৫ লাখ টাকা। এর মাত্র একদিন আগেই একই মৌজায় এক লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেন আরেকটি জমি। তাও নিজ নামে ক্রয় করেন জয়নাল।

বেতন-ভাতা যা পেতেন : জয়নালের মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, টিফিন ভাতা, যাতায়াত ভাতা, উৎসব ভাতা, শান্তিবিনোদন ভাতা, শিক্ষা ভাতা, পাহাড়ি ভাতাসহ সর্বমোট বেতন ২ হাজার ৯৩০ টাকা ধরা হলেও প্রতিবছর বছর মূল বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে মূল বেতনের চেয়ে অন্যখাত থেকে ভাতা পেয়েছেন কয়েকগুণ বেশি। সর্বশেষ মূল বেতন ১৩ হাজার ৯০০ টাকা হলেও অন্যান্য ভাতাসহ পান ৩৭ হাজার ৮৫০ টাকা।
নির্বচান কমিশনের এই অফিস পিয়নের বেতন-ভাতার বিবরণী যাচাই করে দেখা যায়, ২০০৪ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই মাসের বেতন উত্তোলন করেন ৫ হাজার ৯৬০ টাকা। ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত একইভাবে পান ৪৮ হাজার ৩০০ টাকা। ২০০৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উত্তোলন করেন ৫৮ হাজার ৪০০ টাকা। ২০০৬ সালের নভেম্বর থেকে অক্টোবর ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৬১ হাজার ৮৪০ টাকা। ২০০৭ সালের নভেম্বর থেকে অক্টোবর ২০০৮ সাল পর্যন্ত উত্তোলন করেন ৬৪ হাজার ৬২০ টাকা। ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উত্তোলন করেন ৮২ হাজার ৬০০ টাকা। নভেম্বর ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উত্তোলন করেন ১ লাখ ১২ হাজার ৭৪০ টাকা। নভেম্বর ২০১০ থেকে ২০১১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উত্তোলন করেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ টাকা। নভেম্বর ২০১১ থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উত্তোলন করেন ১ লাখ ২৫ হাজার ৩২৮ টাকা। ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে অক্টোবর ২০১৩ সাল পর্যন্ত উত্তোলন করেন ১ লাখ ২৯ হাজার ২৩৬ টাকা। নভেম্বর ২০১৩ সাল থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উত্তোলন করেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯০৬ টাকা। ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে জুন ২০১৫ সাল পর্যন্ত উত্তোলন করেন ৯১ হাজার ৫৭০ টাকা। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে আগস্ট ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত উত্তোলন করেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০০ টাকা। জুলাই ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত উত্তোলন করেন ৩ লাখ ৯০০ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে জুন ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৮৬ হাজার ২০০ টাকা। জুলাই ২০১৮ সাল থেকে জুন ২০১৯ পর্যন্ত উত্তোলন করেন ২ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা। আর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১৯ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসের বেতন-ভাতাসহ উত্তোলন করেন ৬১ হাজার ৮০০ টাকা।
চলবে অনুসন্ধান :

এসব আয়ের বাইরে জয়নালের অন্য কোন আয় না থাকলেও এখন পর্যন্ত তার নামে কোটি টাকার সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে নিজের স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে গড়েছেন। সবগুলো বিষয় পৃথকভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অচিরেই এ তার এসব অবৈধ আয়ের বিষয়ে আরও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর সাথে যদি নির্বচান অফিসের অন্যকোন কর্মকর্তা জড়িত থাকার তথ্যও পাওয়া যায় তাদের বিষয়েও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানায় দুদক সূত্র।

গত বুধবারে এসব বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দন সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জয়নালের এসব অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। এসব সম্পদ অবৈধভাবেই গড়েছেন তিনি। তার এ কাজে নির্বাচন অফিসের অন্য কর্মচারীরাও জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। তদন্তে যদি কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।

উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দেওয়ার ঘটনায় গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিন দিনের অভিযান চালায় দুদক। যাতে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য পায় দুদক। এরমধ্যেই ১৬ সেপ্টেম্বর রাতেই নগরীর ডবলমুরিং থানার একটি বাসা থেকে জয়নাল আবেদীনসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় নির্বাচন কমিশন। এ সময় নির্বাচন অফিসের হারিয়ে যাওয়া লাইসেন্সকৃত একটি ল্যাপটপ, মডেম, সিগনেচার প্যাড ও মডেম উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা বাদি হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। তবে পুলিশ ওই মামলায় জড়িত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। এই ১৩ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট