চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আকিমুন রহমানের উপন্যাস অচেনা আলোকের অন্বেষণ

ড. মহীবুল আজিজ

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

মনে হতে পারে এটা আত্মজীবনী, কিংবা ডায়েরি অথবা উপন্যাস। আমরা একে উপন্যাসই বলতে চাই- অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী। উপন্যাসের উপাদান হতে পারে আত্মজীবনী- অথবা মনে হবে যে আত্মজৈবনিক ঢংয়েই লেখা সেটি। আবার, ডায়েরির আঙ্গিকে লেখা বলে এটিকে সরাসরি দৈনন্দিনতার বাস্তব থেকে তুলে আনা বলে প্রতিভাত হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে ঔপন্যাসিক যখন ঘটা করে বা আয়োজন করে তাঁর বক্তব্যে নিহিত থাকা মানুষজনকে চরিত্রে গড়ন দিতে তত আগ্রহী হ’ন না। তাঁর কথকতার মধ্য দিয়েই চরিত্রগুলি তৈরি হয়ে যায়- মানে যতটা হওয়া দরকার ঠিক ততটাই, তার কমও না বেশিও না। কাহিনিতে যে খুব মসলাদার জমাটি ভাব আছে তাও না, কিন্তু এটি নিরবচ্ছিন্নভাবে পাঠ করে যাওয়া যাবে। অন্যভাবে বলা যায় উপন্যাসের আয়োজন না করেই আকিমুন রহমান তাঁর এই বৃত্তান্তটিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। এখন এটিকে আমরা উপন্যাস বলি কিংবা না বলি তাতে তাঁর বা তাঁর গ্রন্থটির কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। আমি বরং এমনভাবে লিখবার জন্যে তাঁকে জানাই অভিনন্দন।

তবে কোনো পাঠক যদি এটিকে আত্মজীবনী, ডায়েরি এবং বর্ণনের সমন্বয়ে গড়া এক ধরনের সাহিত্যকর্ম হিসেবে দেখতে চায়, তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। এটুকু বলবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, আকিমুনের কথকতায় সায়েন্সফিকশনের খানিকটা স্পর্শও কী নেই! হ্যাঁ, সে-ফিকশন বিজ্ঞানের সূত্র-তাত্ত্বিকতা কি প্রায়োগিকতার ভারে আক্রান্ত নয়, তবু তাতে বিজ্ঞান-অতিরেক এক জ্ঞানের বিদ্যমানতা আছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছে এক অনিঃশেষ রক্তক্ষরণ। কথকতার শেষ হয়ে গেলেও সেই ক্ষরণের শেষ হয় না। প্রথম থেকে যাকে আমাদের পাশের বাড়ির মেয়েটি বলে মনে হয়, মাটির পৃথিবীর সমান্তরাল এক ‘প্রক্সিমা ওয়ান’ জগতের কল্পনাও আমাদের ছিন্ন করতে পারে না দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-সন্ত্রাস-নিরানন্দে ভরা বৃত্তের সংযোগ।আলোকুমার আসে এক অচিন ভুবন থেকে, নাকি সে চেনা-ই কিন্তু তার পৃথিবীটা ‘অচিন’। এই ধুলিমাটিময় সোঁদা গন্ধময় ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণপরিপ্রেক্ষিত থেকে উদ্গত প্রাণ এক অনুপম অস্তিত্বে পরিণত হয়ে শেষে ‘অচিন’ হয়ে উঠতে পারে না! বলতে ইচ্ছে করে আকিমুনের আলোকুমার যেন তা-ই। হয়তো এ-পৃথিবী বার-বার তাকে পায় না, পায় শত-হাজার বছরের ব্যবধানে একেকবার। সেজন্যেই সে রূপকথার নায়কের স্মারক- যেন পৃথিবীতে সে আগন্তুক, যেন পৃথিবীতে সে বেমানান। পৃথিবীটা আসলে কাদের- আকিমুনের বৃত্তান্ত পড়লে মনে হবে, মানুষ নামের অতি সীমাবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে আটকে থাকা এক জীববিদ্যাগত সত্তা সে। সেই আটক থেকে তার বা অজ¯্র তাদের বেরোবার প্রণোদনাও দুর্লক্ষ্য। যদিবা সেই আটককে অস্বীকার করে ঘটনার বিপরীতে কেউ দুর্ঘটনা হয়ে যায় তাদের দিকে আগন্তুকের দৃষ্টি মেলে তাকায় আটকের মধ্যে পড়ে থাকা মানুষেরা। সেরকম এক নায়ক আকিমুনের আলোকুমার। কিন্তু যাকে তিনি নগণ্য মানবী বলতে চান তাকে আমরা বলবো আলোকুমারী- অন্তত তাঁর উপন্যাসের (এখন আমরা এটিকে সুবিধের জন্যে উপন্যাসই বলি) অচেনা আলোকুমারের চেতনা থেকে ছিটকে আসা রশ্মিপাতে উপন্যাসের নায়িকা মরিয়ম হুসনা জাহানকে আর নগণ্য বলে বিবেচনা করা যাবে না। এই ক্লিষ্ট জীবনের চিরচেনা বা আটপৌরে পরিধির মধ্যে থেকেই সে হুসনা জাহান তাঁর সমস্ত রক্তক্ষরণ নিয়েই আলোকের বিন্দুতে পরিণত।

উপন্যাসে ব্যক্ত কাহিনিটি নিতান্তই সাদামাঠা, কাহিনিঘেরা আবর্তনটি সাদামাঠা নয়। জিজ্ঞাসা, দার্শনিকতা, সংশয়, সামাজিক-রাষ্ট্রিক বৈর পরিস্থিতি, ব্যক্তি অবস্থান এবং সর্বোপরি সামাজিক সংখ্যালঘুরও সংখ্যালঘু যাকে বলে, মানে নারী তার অবস্থান এইসব নানা বিষয় ও বিষয়-বিশ্লেষণ আকিমুন রহমানের জীবনচিত্রটিকে প্রচলিত উপন্যাসের চাইতে অন্যবিধ করে তুলেছে। বলেছি, এর নায়িকা আমাদের পাশের বাড়ির মেয়েটি। রোজ তাকে দেখা যায়, কিন্তু আমরা তাকে দেখি হয়তোবা পুরুষচক্ষু দিয়ে। সে ব্যক্তি হয়ে ওঠে না প্রথাগত দৃষ্টিতে। অথচ এই দেশ, দেশের পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সর্বত্র এদের নিয়ে কথাবার্তার শেষ নেই। এত কথার পরেও ধরা যাক মরিয়ম হুসনা জাহানের কথাই বলি- তিনি তাঁর অন্তরে জমে থাকা কথাগুলো প্রকাশ করতে পারছেন না। বলবেন কাকে? সেরকম পুরুষ দুর্লভ, এমনকি নিকটের নারীও তাঁর সামনে শত্রুত্বের দেয়াল খাড়া করে রাখে। তাই, তাঁর কথাই শোনা যাক- “নিজের কথাগুলা তো এই খাতার কাছে বলা ছাড়া- আমার বলার আর কোনো জায়গা নাই! তাই খাতাটাকেই জানায়ে রাখছি আমার মনের অবস্থাটা।” ১৯৯৫ সালের ১৬ এপ্রিল একথা ডায়েরির পাতায় লেখা হয়। এর ঠিক দুই যুগ পরে আজ সকালেও যদি একই কথা কেউ লেখে, লেখে এমনই অপ্রকাশ্য বেদনা নিয়ে, সেই ব্যক্ততাকে অসঙ্গত মনে হবে না।
অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী উপন্যাসের মূল চরিত্র হুসনা বা হেনা এবং তার বেড়ে ওঠার ইতিহাস তার নিজেরই সচেতন চোখে আমরা পরখ করি। তার জীবনকাহিনিটি হয়তো এই বাংলার বহু পরিবারের কাহিনি, অর্থাৎ এটি পরিচিত প্রতিনিধিত্বের গল্প। আইএ পাশ করতে না করতেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় এক প্রবাসী ‘ম্যাট্রিক ফেল’-এর সঙ্গে। বিয়ে হয়ে যায় কিন্তু মেয়েটিকে থাকতে হয় পিতৃপরিবারে। একদিন স্বামীটি বিদেশ থেকে এলে তবেই তাকে তুলে নেওয়া হবে শ^শুরালয়ে। যেহেতু বিয়ে সারা এবং স্বামীটি ‘ম্যাট্রিক ফেল’ সেহেতু হুসনা এমনিতেই বাড়তি

যোগ্যতাসম্পন্ন, তার আর লেখাপড়ার প্রয়োজন নেই। পরিবার এবং সমাজের রেখাটা ঠিক এই বিন্দুটিতে প্রগাঢ়ভাবে টেনে দেওয়া হয়। আর এখান থেকেই আরম্ভ হতে থাকে একটি ব্যক্তিক রেখা, সে-রেখা আঁকেন ‘নগণ্য’ হুসনা জাহান। সেটি তাঁকে আঁকতে হয় নিজের প্রয়োজনে, নিজের অস্তিত্বের অর্থবহতার প্রয়োজনে। ফলে, তাঁকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে হয় দীর্ঘকালের বিদ্যমানতাকে। তা না করলে তাঁর জীবন স্থির-বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয় কিন্তু তাঁর চোখে স্বপ্ন, যে-স্বপ্ন সমুদ্রের। সেই স্বপ্ন আপনা থেকে এসে ধরা দেয় না, তার জন্যে প্রয়োজন পড়ে সংগ্রামের- হুসনা জাহান সংগ্রামী হয়ে ওঠেন। এটি তাঁর অন্তক্ষরণ ও সংগ্রামের কাহিনি। সব সংগ্রামেরই যেমন কোন না কোন অনুপ্রেরণা থাকে, হুসনারও থাকে সেরকম। তা না থাকলেও সম্পূর্ণ আত্মচেতন নারীটিকে আমরা আমাদের প্রচলিত প্রতিবেশিত্বের মধ্য থেকে আচমকা ঋজুত্ব নিয়ে ছিটকে আসা আলোকরেখা রূপে চিনে নিতাম নিশ্চয়ই। হুসনার পিতা আবদুল আলী ক্যান্সার-রোগি, তিনি মারাও যান কিন্তু তিনিই আত্মজার সংগ্রামের আগুনে প্রথম দেশলাইটি ঠুকে দিয়ে যান। স্বামীপক্ষ যেখানে স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার ঘোরবিরোধী সেখানে কন্যাকে তিনি স্ব-উদ্যোগে ভর্তি করান ঢাকা শহরের নামকরা নারীশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ইডেন গার্লস কলেজে বাংলা অনার্স-এ। হয়তো আবদুল আলীকেও আপোষ করতে হয় খানিকটা। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সহশিক্ষার সেরা কেন্দ্র ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে মেয়েকে ভর্তি করান না।

সব উপন্যাসের নায়ককেই সংগ্রাম করতে হয়। অন্যভাবে বলা যায়, সংগ্রাম ব্যতিরেকে উপন্যাসের নায়ক হওয়া মুশকিল। সেই সপ্তদশ শতাব্দীর দোন কিহোতে কি উনিশ শতকের আঁতোয়াঁ কিংবা বাঙালি গোবিন্দলাল কি পূর্ববাংলার মুহাম্মদ মুস্তাফা যার কথাই বলি না কেন সংগ্রাম অনিবার্য। হ্যাঁ, হুসনা নায়ক-ই- নাম তাঁর নারীবাচক হলেও। গোটা কাহিনিটি তাঁর দ্বিবিধ সংগ্রামের চিত্র ও ভাষ্য- একটি তাঁর অভ্যন্তরীণ জীবনের এবং অন্যটি তাঁর বহির্জীবনের। পারিবারিক জীবনে হুসনা রুদ্ধতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ। নিজেরই অগ্রজ ‘দাদাভাই’-এর গঞ্জনা আর অবহেলার শিকার।একই সঙ্গে দাদাভাই-স্ত্রী ভাবির গার্হস্থ্য সন্ত্রাসের শিকার হুসনা এদেশের অসংখ্য নারীর নির্যাতনক্লিন্ন সত্তার প্রতিনিধি। বাংলায় অনার্স পড়াটা ছিল তার সংগ্রামের প্রাথমিক প্রতীক। যেমন প্রতীকতাচিহ্নিত জয়গুনের চালবিক্রয় কি দরিয়ার ইয়াকুব-মোকাবেলা কিংবা কাশবন-কন্যা জোবেদার স্বামী-সন্ত্রাসের প্রতিবাদ। হুসনার বাইরের জীবনটা অনেক বড় এবং সেখানেই সংগ্রামের পাশাপাশি স্বাধীনতারও পটভূমি রচিত হতে থাকে তার। সেই স্বাধীনতা খুব মসৃণ-প্রশস্ত পথে আসে না। কর্মজীবনেরতার বন্ধুর যাত্রাপথে আমরা দেখি, হুসনা এক নারী, হুসনা মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে সম্পূর্ণরূপে পুরুষনিয়ন্ত্রিত এক ভুবনে। সেই ভুবনে নারী পুরুষেরই কর্মতৎপরতার নিয়ামক, নারী সর্বদাই সেখানে কর্মকারক- কর্তৃকারক কেবল পুরুষ। অর্থাৎ পরিপূর্ণ এক অন্ধকার বলয়ে নিজের সত্তাকে অর্থপূর্ণ করে তুলবার এক কঠিন লড়াইয়ে প্রলিপ্ত হুসনা জাহান। সেই লড়াইয়ে তার অভ্যন্তরীণ শক্তি সক্রিয়তা লাভের জন্যে আলোকের শক্তির অন্বেষী- লড়াইয়ের ক্ষেত্রে অচিন আলোকুমার তার সেই আলোকশক্তির উৎস। হ্যাঁ, পিতা আবদুল আলীও তার পথের শক্তিই। তাঁর সংযোজক ভূমিকাই হুসনাকে লড়াইয়ের পথে দাঁড়াবার প্রাণনা যোগায়। পিতার রেখে যাওয়া স্বল্প সম্পদের চাইতেও তাই অদৃশ্য এক সম্পদে ভেতরে ভেতরে বলীয়ান হয়ে উঠতে চেয়েছে হুসনা। সেই সম্পদের নাম ‘মোরাকাবা’ বা ধ্যান, যাকে বলে মেডিটেশন। উপন্যাসটি এই ধ্যান আর এই আলোকময় পুরুষের অন্বেষণের রেখাপথে বাস্তব-পরাবাস্তবের আলোছায়ায় দুলে ওঠে। আমরা দেখি, বাস্তবকে কখনও-কখনও মনে হতে থাকে দুর্বোধ্য আবার পরাবাস্তবকেও মনে হতে থাকে পূর্বপরিচিত বা পূর্বপ্রেক্ষিতের ইতিহাসসংবলিত। আসলে যেখানটায় গল্পের শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল হেনা বা হুসনার, সেখানটাতেই শুরু হয় তার প্রকৃত আখ্যানের। তাই বিবাহ মানেই হুসনার শেষ কথা নয়, একটি বিবাহের মধ্য দিয়ে সত্তাকে সারা জীবনের জন্যে বন্ধক রাখবার শর্তে রাজি নয় সে। প্রবাসী স্বামীর ভবিষ্য-প্রত্যাবর্তনের স্তোকে কেবলই জায়মান তার দার্ঢ্যপূর্ণ বর্তমানতাকে নিরর্থকতার শূন্যে মিলিয়ে দিতে অনিচ্ছুক হুসনা। তাই বাংলায় অনার্স পড়া হুসনার শিক্ষকতার কর্মজীবনটাও তার জীবনসংগ্রামের বিস্তৃততর অবভাস। ভেতরের এবং বাইরের দুই সংগ্রামকে সামলে নিয়ে তার এগিয়ে যাওয়াটাই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। খুব অপরিচিত নয় এমন উপজিব্যতা কিন্তু হুসনার সংগ্রামটাকে দেখবার এবং দেখে প্রকাশ করবার প্রক্রিয়াটিতে আছে প্রচলনের বাইরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিফলনের অভিনবত্ব। আকিমুন রহমান কেবলই বর্ণনধর্মী গল্প শুনিয়ে যাবার জন্যে তাঁর এ-গ্রন্থ রচনা করেন না, বরং এটিকে সামাজিক-চারিত্রিক অবস্থানকে যাচাই করবার একটি শব্দনির্ভর পদ্ধতিতে পরিণত করেন।

অস্তিত্বের জটিলতা সত্তার অবরুদ্ধতা ও আত্মমুক্তি আকিমুন রহমানের উপন্যাসটির অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয়। নায়িকার পরিপাশর্^ হতাশাপ্রদ এবং বর্তমানতার চাপে তার সত্তা সংকুচিত। যেসব উপায় ব্যক্তিকে সমুখগামী করে, ব্যক্তিকে এমন অনুভব দেয় যে সে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে যত ক্ষুদ্রই হোক এক প্রয়োজনীয় উপাদান, সেসব উপায় উপন্যাসের নায়িকার অর্জিত কিন্তু অদ্ভুত এক বর্তমান তার- সমস্ত অর্জনের বিনিমিয়ে এক নিরর্থক গন্তব্য যাকে শূন্যই বলা যাবে, তার জন্যে প্রতীক্ষা করে। অথবা হয়তো শূন্যও নয়, কী যে সেটা তা-ও অজানা। তাই পিতা-চরিত্র হুসনার আশ্রয়। পিতা ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করলেও পিতার সংযোগটি হারাতে রাজি নয় হুসনা। কেননা, একমাত্র পিতাই (পূর্বপ্রজন্মের প্রতিনিধি হ্রয়া সত্ত্বেও) তার প্রকারান্তরে মানবসত্তার অর্থবহতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিল। আর তার প্রবাসী স্বামী এবং তার পক্ষের লোকেরা বর্তমানের প্রতিনিধি হয়েও রক্ষণশীলতার নিগড়বন্দি। এরকম দ্বন্দ্ব, বলে না দিলেও টের পাওয়া যাবে। হুসনা স্বয়ং আলোকের অনুসারী এবং আলোকের খানিকটা সন্ধান সে পেয়েছেও, যদিও ভবিতব্যের অবলম্বন মানে বিবাহসূত্রে তার যে নতুন জগতের বাসিন্দা হওয়ার কথা সেটা আসলে তার অন্ধকারে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি। সেটা হুসনা বোঝে এবং বুঝতে পারে বলেই সে সংগ্রামী হওয়ার প্রথম শর্ত পূরণ করে এবং বাস্তবে যা হয় পরিপাশের্^ সব সহায়ক অবলম্বন নাগালের মধ্যে থাকে না। ফলে, হুসনার অন্তর্জগতে চলে সমস্ত উথাল-পাতাল। সেটা টের পাই আমরা পাঠক হিসেবে। আমরা দেখি, হুসনার সত্তায় অস্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান বিতৃষ্ণা ক্ষোভ এবং বিদ্রোহ এসব কিছুর জন্ম নিচ্ছে। এগুলোর অধিকাংশই জীবনবিরোধী নয় কিন্তু তার জন্যে সবচাইতে নেতিবাচক হলো তারই অন্তর্গত হতাশা। নিজের নির্ণয়-অসম্ভব অসুস্থতাকে তার কাছে মনে হয় ক্যান্সার যে-রোগে তার পূর্বসূরী পিতার মৃত্যু ঘটেছে। এমনকি একপর্যায়ে এই কর্কট রোগটাকেই হুসনার নিকটে মনে হয় আশীর্বাদ। এই মনে হওয়ার কারণ তার পিতার প্রতি ভালবাসা। আবার এই রোগটা হতে পারে (নিশ্চিত মৃত্যুর কারণহেতু) হুসনার হতাশা থেকে বর্তমানের দুর্বিসহতা থেকে মুক্তির একটি পথ। অস্তিত্ববাদী উপন্যাসগুলিতে যে-বিবমিষার প্রভাব দেখি সেটা আকিমুনের এ-উপন্যাসে আছে। সার্ত্র, বেকেট কিংবা সিমঁ প্রমুখের উপন্যাসে আমরা দেখবো, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা স্থায়ী দুরারোগ্য অস্বস্তি সৃষ্টি হয় যা কিনা বর্তমানকে প্রত্যাখ্যান বাবর্তমানকে সইতে না পারার বহিপ্রতিক্রিয়া। হুসনার মধ্যে সেটি আসে প্রবল প্রদাহ হয়ে। তার দেহের চামড়ার অবিরাম প্রদাহ, রক্তিমাভা ধারণ এগুলো তার প্রত্যাখ্যান-ঘৃণা-বিতৃষ্ণার প্রতিক্রিয়া। আবার, সমস্ত হতাশার মধ্যে থাকে সুসংবাদও।

সেই সুসংবাদের নাম মাহবুব শরীফ। তার ক্ষুদ্র পৃথিবীর মধ্যে সংকোচনের চাপে কুঁকড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে হুসনার প্রয়োজন হয় ছাদের। ছাদ তার ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’। কিন্তু তার ভাবি, ভাই তারই প্রতিপক্ষ। কারো স্বার্থ বিষয়বুদ্ধি, কারোবা ব্যক্তিত্বের হীনন্মন্য কিংবা কারো পুরুষাচার। শুধু ঘর নয় কর্মস্থলেও এমন চাপের উপস্থিতি প্রকট। কিন্তু যে-সত্তা তার চারদিককার বৈরিতাকে প্রথমত অনুভব করতে সক্ষম এবং দ্বিতীয়ত সেটিকে অতিক্রম করবার অধ্যবসায়ে লিপ্ত তার তো মুক্তি-অভিমুখী একটা স্বপ্নের ভিত্তি প্রয়োজন। হুসনার জন্যে সেই ভিত্তি হলো মাহবুব শরীফ। এমনও হয় মাহবুব শরীফের সংস্পর্শ বা ভাবনা হুসনাকে তার সারাক্ষণের প্রদাহে উপশম এনে দেয়। চরিত্রটি আসলে ধরা-অধরার ইন্দ্রজালে গড়া। এরকম কেউ কি আসলেই ছিল হুসনার বিবাহপূর্ব জীবনে, হুসনা কী এমনই কারোর স্বপ্ন দেখেছিল নিজের সত্তার সহযোগী হিসেবে! বিবাহ নামক বন্ধন-গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়ে বাস্তবের রূঢ়-স্বার্থপর চেহারা দেখে জীবনের শূন্য-ফাঁকা গোলক থেকে বেরোবার অবলম্বনই হয়তো তার স্বাধীন চেতনার প্রতিফলন মাহবুব শরীফ। কখনও-কখনও মনে হতে পারে, এটি হুসনার এক ধরনের হ্যালুসিনেশন। তার প্রত্যাশা বা স্বপ্ন ও তার প্রাপ্তি ও তার বর্তমানের মধ্যকার মেরুদূরত্ব পূরণ করবার হাতিয়ার মাহবুব শরীফ। আবার, এমন প্রশ্নও তো করা যায়, বাস্তবে তেমন মাহবুব শরীফের থাকা সম্ভব কিনা নাকি এরকম চরিত্ররা আদর্শায়িতই থেকে যাবে। এরকম চরিত্ররা হয়তোবা উপন্যাসের নায়িকার স্বপ্ন-কল্পনাতেই থাকা সম্ভব। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ময়না দ্বীপ এবং হোসেন মিয়াকে যদি ইউটোপিয়া বলি তাহলে আকিমুনের মাহবুব শরীফকে বলতে হবে ডিসটোপিয়া। কেননা, মাহবুব শরীফদের শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। প্রশ্ন জাগতে পারে, যাকে পাওয়াই যায় না, যাকে কেউ কখনও পায় নি তেমন সত্তার স্বপ্ন কেন? এর উত্তরে বলা যাবে, স্বাধীন মুক্তিকামী সত্তার চাহিদা অসীম কিন্তু সে একপর্যায়ে সসীমতা দিয়ে নিজেই তার আকাক্সক্ষার অসীমতাকে বাস্তবে স্থাপন করে। তার স্বপ্ন আসলে তার বাস্তবের মাটিতে শেকড়বদ্ধ কিন্তু তার বাস্তব শেকড়বান্ধব নয়। আকিমুনের মাহবুব তাই কপিবুক- মানে তত্ত্বে সঠিক, একে নিয়ে স¦প্ন দেখা যায় কিন্তু সে স্বপ্ন বস্তুত বেদনার জাতক। মাহবুব শরীফের বাস্তব অবভাস আসলেই কতটা সম্ভব সে-প্রশ্ন অধিকতর যৌক্তিক হয়ে ওঠে যখন তার উৎস-অবস্থানের ধারণাটা ব্যক্ত হয়। সেই আলোকের বাস্তব- আলোকুমার কিন্তু আলোকে পেতে হয় বহুদূর থেকে। আলো সহজে আসে না, অন্ধকার সরাবার জন্যে বহু পথ কেটে বহু স্তর পেরিয়ে আসতে হয় তাকে- সে নিজেই তার পরিচয় দিচ্ছে মানে ঔপন্যাসিকই দেন-
“আপনার পৃথিবী থেকে তিনশো কোটি আলোক বর্ষ দূরে, আমার গ্রহ! প্রক্সিমা ওয়ান! আমার যে গ্যালাক্সি, সেটা
অবিকল আপনার গ্যালাক্সির মতো। অবিকল একই রকম! দেখলে মনে হবে যেন দই যমজ গ্যালাক্সি- তুমুল
গতিতে ছুটছে। ছুটে বেড়াচ্ছে। দুইজন দুজনের কাছে আসবে বলে।”

মাহবুব শরীফের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আলোকুমার বা মাহবুবের ভুবন পৃথিবী থেকে অনেকানেক অগ্রসর। এমনকি পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে তাদের মানে প্রক্সিমা ওয়ানের বাসিন্দাদের তেমন কোন আগ্রহ নেই। এরকম কথাবার্তার পর হয়তোবা উপন্যাসটিকে হতাশাবাদী বা গ্রিক পরিভাষা এনে নিহিলিস্ট অভিধায় অভিষিক্ত করা যাবে কিন্তু এটা তো সত্যি যে-আলোকুমার হুসনার অন্বেষণ তা বাস্তবে পাওয়া সোনার পাথরবাটি পাওয়ার মত ব্যাপার। অন্তিম কয়েক পৃষ্ঠার সুবাদে আকিমুন রহমানের উপন্যাসকে সায়েন্সফিকশনের ধার ঘেঁষে যাওয়া বলে ঠেকতে পারে। শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে- হুসনা কী তবে আত্মহত্যাকামী! কেননা, হুসনার সঙ্গে আলোকুমারের সমন্বয় ঘটবার আর কোন রাস্তা নেই সামনে। হুসনা এই কাদাময় ভুবনে একমাত্র তার মনের সফেদত্ব দিয়েই বাঁচিয়ে রেখেছে তার সত্তাকে যা হাজারও পঙ্কিলতার পরিপাশের্^ তখনও নোঙরা হয়ে যায় নি। হয়তো যাবে না। কিন্তু সেই সফেদত্ব নিয়ে সত্তাকে সযতেœ রক্ষা করে সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে কিনা সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এইসব বিবেচনা থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটিকে আশাজাগানিয়া বলবার উপায় থাকে না। আশা জাগিয়ে তোলাটা উপন্যাসের কাজ নিশ্চয়ই নয়। যখন হতাশার আবরণ সবদিক ঢেকে দেয় তখন হতাশাকে দেখানোটাই বাস্তব। সে-অর্থে আকিমুন রহমানের উপন্যাস আমাদের এখনকার জীবনের বাস্তবতার প্রতিরূপ যে-বাস্তবে স্বপ্ন দেখাটা নয়, তার আগে প্রশ্ন ওঠে- স্বপ্ন দেখবো কিনা।
আগস্ট ২০১৯
আকিমুন রহমান, উপন্যাস: অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৭৫, প্রকাশক: গ্রন্থকুটির, ঢাকা।

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট