চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

অভিমত কবি শুক্লা ইফতেখারের আত্মকথন সম্পর্কের স্বরলিপি

শোয়েব নাঈম

৩১ জানুয়ারি, ২০২০ | ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

একপ্রান্তে নিখাদ ভাবনা আর অন্যপ্রান্তে নিগূঢ় তথ্য, একদিকে সম্পর্কিত বিষয় আবার অন্যদিকে দূরবর্তী অনুষঙ্গ, এক শেষে দগ্ধা সম্পর্ক ও সময়ের প্রকাশ, অপর সমাপ্তিতে অবচেতন সত্তার সাথে আত্মকথন এমন দ্বৈত বৈশিষ্ট্যে আত্মমগ্ন প্রথম ও শেষভাগের ক্রিয়ারত আন্তঃসম্পর্কের পরস্পরায়, ব্যক্তিক চৈতন্যের পরিচয়ে বিস্তৃত “আমি যখন মালা গাঁথি” এমন অন্তঃসার কাব্যগ্রন্থ মনে হলেও কবি শুক্লা ইফতেখারের অন্তর প্রতিক্রিয়ায় আছে কবিতার দগ্ধারণ্য। কাব্যিক অভিঘাতে কাব্যানুভূতিরও বেশি চিন্তার অভিপ্রায়কে উৎসুক করে স্তবকের গতিশীলতার ভেতরেই পাঠককে প্রবেশ করিয়ে ঐ অভিঘাতকে অভিগমন করার অধিকার দিতে চেয়েছেন কবি। কবিতার রূপ ও চিত্রকে চিত্রময়ে অনাবৃত আবরণে, নান্দনিক প্রশস্ততায় বইয়ের প্রচ্ছদে টানা আছে কবিতার ভাষাসম এক চাপা নীলআঘাত, যেখান থেকে দাহনবর্ণে উদ্ভাসিত দীপ্তিময় ‘সম্পর্কের স্বরলিপি’ নামকরণের অক্ষরগুলো। নির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করা বহুব্যবহৃত শব্দগুলোই প্রচলিত ব্যবহারের সীমা থেকে মুক্ত হয়ে এই গ্রন্থে নতুন তাৎপর্যে স্বতন্ত্রধারায় কবিতায় অনুপ্রবেশ করে আরও মননশীল হয়ে উঠেছে।
কবিতার ভাষার সঙ্গে উৎসর্গপত্রে পরিকল্পিত ভাষার পার্থক্য রক্ষা করে প্রতীকে নয় শ্রদ্ধায় বিনীত মাধুর্যে, কবি তাঁর প্রয়াত ‘বাবা-মা’ ব্যক্তিত্বের উদ্দশ্যে অন্তর্ভেদী মূল্যায়নে নৈবেদ্য রচনা করেছেন।
কবির নিজস্ব নিয়মে কবিতার মুভমেন্ট ও ফ্লোয়ের গাঢ় রিফ্লেকশান আছে ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্নে ৫৭টি সংবেদনশীল কাব্যের প্রতিটি শিরোনামের মধ্যেই। এক দ্বন্দ্বমুখর সারির অনিবার্য ক্রম অবস্থানে শিরোনামগুলো কবিতার সমান্তরালে একদিকে চিন্তার নতুন পথ অন্যদিকে “একান্ত আকাশ” উম্মোচনের আভাস আছে। প্রথম কবিতাকে গ্রন্থের প্রবেশক বলে ধরে নেওয়া অভিষেক কবিতা “আমি যখন মালা গাঁথি” শিরোনাম থেকেই এমন বোধের সূত্রাপাত আছে।
ক্রিয়ার কার্যের সময়ে নয়, প্রতিটি কবিতার শেষ স্তবকে আছে অস্তিত্বধর্মী চক্রবত অবিরাম কালপ্রবাহের ইঙ্গিত কখনো অতীত, কখনো বর্তমান এবং কখনো ভবিষ্যৎ সময়ের বোধে মানবিক সম্পর্ক অনুভূতির বিস্তার। যেমন :
অতীতকাল: ‘আমিও জেগে থাকতে চেয়েছি’ (সেই জলটুকু : পৃষ্ঠা ১০) ; ‘আমরা আবার অস্পষ্ট হতাম না ফিরে যেতে যেতে (মুঠোফোনে চিঠি: পৃষ্ঠা ১১); … ইত্যাদি ।
বর্তমানকাল: ‘আমি যখন মালা গাঁথি’ (পৃষ্ঠা ৯); ‘অর্ধেক থাকা সাজঘরে, তার অর্ধেক মূল কাজ’ (কীর্তি: পৃষ্ঠা ১৪); … ইত্যাদি ।
ভবিষ্যতকাল: ‘আপন-পরের সীমানা প্রাচীর পাহারা দেবে কে?’ (দূর কতটা: পৃষ্ঠা ১৬);
‘জানো তো, স্পর্শ ও স্পর্শাতীত এ দ্বন্দ্ব মূলত প্রেমেরই (গোলাপ: পৃষ্ঠা ৩০ ); … ইত্যাদি।
“ […]কতো সোহাগে-আদরে ফুলদানিতে তাকে সাজিয়ে রাখি…” (সেই জলটুকু: পৃষ্ঠা ১০)… চিন্তার সরলরৈখিক ধারাবাহিকতায় সম্পর্ক অনুভবে, পুষ্পভরা অবশেসনে থাকা অভিজ্ঞতাময় ফুলের রং ও ঘ্রাণ এর বিস্ময় জাগানিয়া শব্দগুলি এই গ্রন্থে মিশে আছে। আবহমান কবিতার মতোই জীবনের প্রতীকই হয়ে ওঠা এসব স্তবকগুলিতে কবিতার আবহাওয়ায় আর অভিঘাতে মিশে আছে বাগানের উপাখ্যান, কবির অতিশয় সুগন্ধের পিপাসা। “যেখানে কুসুমের ক্রন্দন/ সেখানে মালীর বন্ধন/ যেখানে পূর্ণ সমর্পণ,/ সেখানে আধেক আত্মহনন”… (বন্ধন: পৃষ্ঠা ৫৭) ।
সম্পর্ক একটি গাছের মেজাজের মতো সুন্দর, কবিতার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে গাছ, গাছের অভিমুখে ‘সম্পর্কের স্বরলিপি’ “হে বৃক্ষের স্পর্ধিত বেড়ে ওঠা;/ কুসুমিত লতা-গুল্মের অবারিত হয়ে ওঠা,/ লাজুক দেবদারুর পাতার ভেতর নিজেকে লুকোতে চাওয়া/ তোমাদের কাছে এসে কে প্রতিদিন ভালোবেসে/ তোমাদের দ্যাখে,/ তোমরা কি তা জানো? “… (হে বৃক্ষ: পৃষ্ঠা ৪৪) … জাদুময় মায়ার বাঁধানে জড়ানো কবির নিজ অনুকম্পা স্বরূপ সংবেদনশীলতার উপস্থিতি এই চরণগুলি। এই গ্রন্থের সার্থক নামকরণ নিয়ে ভাববার মতো আরেকটি খোলা জানালা কবিতা, অস্থিরতাহীন গাছের অভিমুখী কবিতা-“গোলাপ…(পৃষ্ঠা:৩০)”।

নিজের সময় ও পরিবেশ-প্রতিবেশ বৈরিতার ভেতর বিপন্ন, বিষণœ ও একা থেকে ক্রমহ্রাসমানে মানসিকভাবে ভগ্ন থেকে ভগ্নাংশ হতে থাকা এই কবির কবিতাগুলি হচ্ছে “এতদিন পর এলেই যখন…(পৃষ্ঠা: ২২)”; “দাউ দাউ … (পৃষ্ঠা: ২৫)”; “একবারও এলে না…(পৃষ্ঠা: ৩৪)”; … ইত্যাদি।
যে কোনো ধরনের পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক কোনো হ্যাপেনিংকে কাব্যবোধের সাথে মিশিয়ে কবিতায় প্রোজেক্ট করতে পারেন কবি শুক্লা ইফতেখার
“ভাগ্যিস তুমি সেদিন বৃষ্টির পর এসেছিলে।
আমি সজল ছিলাম/ আমি বিজন ছিলাম/
আমি জল ছলছল বৃষ্টিতে বিভোর ছিলাম/
সুরের সঙ্গ পেতে ব্যাকুল একটি গীতিকবিতা হয়েই ছিলাম…” … (ভাগ্যিস তুমি সেদিন বৃষ্টির পর এসেছিলে: পৃষ্ঠা ৩৮) … এসব রূপকল্পের অভিঘাতে অসাধারণ ভাষাসৌধে অচঞ্চল আর্তিতে সম্পর্ক হারানো এক বহুমাত্রিক অম্লান কবিতা নির্মাণ করেছেন।
হৃদয় ও মস্তিষ্কের সম্মিলিত আকরবিন্দু থেকে উঠে আসা নির্যাস ‘সম্পর্কের স্বরলিপি’ কাব্যগ্রন্থে প্রফুল্লিত হওয়ার মতো আনন্দ-বিহার নেই, আছে গুচ্ছবদ্ধ নীরবতাধর্মী তির্যক কবিতা, অপ্রত্যাশিত ঘটনাদির বিস্ময়াপন্নতা, বৃক্ষের মতো ভাবনার অঙ্কুর আর অন্তর্নিহিত প্রগাঢ় সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা নিষিক্ত কবিতাভাবনা। দূরত্ব ও স্মৃতির চাপ ‘সম্পর্কের স্বরলিপি’ গ্রন্থটিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট