চট্টগ্রাম রবিবার, ১২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সম্পর্ক ফাঁসের আশঙ্কায় আত্মীয়াকে খুন যুবকের, ধরিয়ে দিল গুগল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৮ মে, ২০২৩ | ৩:৫৫ অপরাহ্ণ

স্ত্রীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দু’বারের বিবাহবিচ্ছিন্না ওই মহিলার আবদার ছিল, আবার বিয়ে না করলেও তার সন্তানের মা হতে চান। তবে এই সম্পর্ক ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় আত্মীয়াকে নৃশংসভাবে খুনের পর দেহাংশ লোপাট করে দেন প্রশান্ত নাম্বিয়ার। মুছে ফেলেন সমস্ত তথ্যপ্রমাণও। তবে তামিলনাড়ুর যুবককে ধরিয়ে দিয়েছিল গুগল! ২০২০ সালে এমনই দাবি করেছিলেন সুচিত্রা পিল্লাই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারীরা।

 

২০১৯ সালে তার সন্তানের অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে সুচিত্রার সঙ্গে প্রথম আলাপ-পরিচয় হয়েছিল কোঝিকোড়ের বাসিন্দা প্রশান্তের। বয়সে প্রায় ৯ বছরের বড় স্ত্রীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়া সুচিত্রাকে গোড়ায় ‘দিদি’ বলে ডাকতেন তিনি। তবে সমাজমাধ্যমে কথাবার্তা থেকে ফোনালাপ শুরুর পর থেকে তাদের সম্পর্ক অন্য মোড় নেয়।

 

২ সন্তানের পিতা ৩৩ বছরের প্রশান্ত যে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, সে কথা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তার স্ত্রী।

 

পলাক্কড়ের একটি বেসরকারি স্কুলে সঙ্গীতশিক্ষক ছিলেন প্রশান্ত। অন্যদিকে, বিত্তশালী পরিবারের সুচিত্রা থাকতেন কোল্লম জেলায়। অর্থের অভাব না থাকলেও বিউটিশিয়ানের কাজ করতেন তিনি। মূলত অর্থের লোভেই ৪২ বছরের সুচিত্রার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন প্রশান্ত। এমনকি, বছরখানেকের মধ্যে তার থেকে ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন।

 

তদন্তকারীদের দাবি ছিল, প্রশান্তের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে ২ বার সংসার ভেঙে যাওয়ায় আবার বিয়ে করতে চাননি সুচিত্রা। তবে বিয়ে না করলেও প্রশান্তের সন্তানের মা হতে চেয়েছিলেন।

 

তদন্তকারীদের আরও দাবি, সুচিত্রার কথায় রাজি হলে তাদের সম্পর্কের কথা স্ত্রী-সন্তানদের কাছে ফাঁস হয়ে যেত বলে আশঙ্কা করেন প্রশান্ত। তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই সুচিত্রাকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষেন তিনি।

 

সুচিত্রাকে খুনের জন্য পলাক্কড়ের শ্রীরামরগরে একটি বাড়ি ভাড়া করেন প্রশান্ত। ওই ভাড়াবাড়িটি ছিল লোকালয়ের ভিড় থেকে দূরে একটি পরিত্যক্ত জায়গায়। ওই বাড়িতে থাকার জন্য সুচিত্রাকে আমন্ত্রণ জানান প্রশান্ত।

 

কোল্লমের যে বিউটি পার্লারে কাজ করতেন সেখানে সুচিত্রা জানিয়েছিলেন, পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছেন। ফলে ক’দিন কাজে যেতে পারবেন না।

 

সুচিত্রার সঙ্গে রওনা দেওয়ার আগে স্ত্রীর কাছে প্রশান্তের অজুহাত ছিল, মিউজ়িক ক্লাস নিতে দু’দিনের জন্য কোচিতে যাচ্ছেন। সেখান থেকে ২২ মার্চ বাড়ি ফিরবেন। ওই ক’দিনের জন্য ২ সন্তান এবং স্ত্রীকে কোল্লমের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মা-বাবাকে কোঝিকোড়ের বাড়িতে থাকতে বলেন।

 

২০২০ সালের ১৭ মার্চ দুপুরে অসুস্থতার অজুহাতে নিজের স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়েন প্রশান্ত। স্কুলে জানিয়েছিলেন, আত্মীয়দের বাড়িতে যাচ্ছেন। সেই সন্ধ্যায় কোল্লমের কল্লুথজ়ম রেলস্টেশন থেকে সুচিত্রাকে গাড়িতে তুলে নেন প্রশান্ত। পল্লাকড় থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে ওই ভাড়াবাড়িতে প্রায় ৩ দিন একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন প্রশান্ত এবং সুচিত্রা।

 

সুচিত্রাকে কীভাবে খুন করেন প্রশান্ত? চার্জশিটে তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, ১৭ মার্চ রাতে ওই ভাড়াবাড়িতে ঢোকার সময় কেউ যাতে সুচিত্রাকে চিনে না ফেলেন, সে জন্য কালো পোশাক পরে আসতে বলে হোয়াট্‌সঅ্যাপ করেছিলেন প্রশান্ত।

 

প্রশান্তের কথামতো কালো পোশাক পরে রাতের অন্ধকারে ওই ভাড়াবাড়িতে ঢোকেন সুচিত্রা। প্রায় ৩ দিন একসঙ্গে কাটানোর পর ২০ মার্চ সুচিত্রাকে খুন করেন তিনি। ২০ মার্চ সন্ধ্যায় ভাড়াবাড়ির ঘরে সুচিত্রার উপর আচমকা চড়াও হন প্রশান্ত। প্রথমে তাকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে মাথা থেঁতলে দেন। এরপর মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে গেলে দুই পা মুড়ে সুচিত্রার বুকের উপর চেপে বসেন তিনি।

 

তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, সুচিত্রার বুকের উপর চড়ে বসে তার দুই হাঁটু ভেঙে দিয়েছিলেন প্রশান্ত। এ বার একটি ইলেকট্রিকের তার পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে খুন করেন। এরপর বিছানার চাদরে তার দেহ ঢুকিয়ে রেখে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন।

 

সুচিত্রাকে খুনের পর তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়ে তা থেকে সিম কার্ড খুলে ত্রিসূর-পলাক্কড় জাতীয় সড়কে ফেলে দিয়েছিলেন প্রশান্ত। যাতে মনে হয়, ত্রিসূরের ওই এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন তিনি। এরপর শাবল নিয়ে ফিরে যান ভাড়াবাড়িতে।

 

খুনের পর সুচিত্রার দেহের যাবতীয় সোনার গয়নাগাঁটি সরিয়ে ফেলেন প্রশান্ত। এরপর চপার ও ছুরি দিয়ে হাঁটু থেকে তাঁর দুই পা কেটে ফেলেন। দেহ লোপাট করার জন্য ওই ভাড়াবাড়ির পিছনের জমিতে বড়সড় গর্ত খুঁড়েছিলেন তিনি। তাতে মাটি চাপা দেওয়ার আগে সুচিত্রার দেহে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলেন। এরপর ওই গর্ত ভরিয়ে তার উপর বড় বড় সিমেন্টের স্ল্যাব চাপা দিয়ে দেন।

 

প্রমাণ লোপাটের জন্য মেঝেতে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলেন প্রশান্ত। এরপর সুচিত্রার জামাকাপড়, হাতব্যাগ, চশমা থেকে ওই ইলেকট্রিকের তার— সব কিছুই পুড়িয়ে ফেলেন। তার প্রসাধনী সামগ্রী ফেলে দেন পলাক্কড়ের একটি খালে। ছুরি ও চপারটি ছুড়ে দেন জলাজমিতে। যদিও যে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়েছিলেন, সেটি ওই ভাড়াবাড়ির ঝোপে পড়েছিল।

 

২৩ মার্চ থানায় সুচিত্রার নিখোঁজ ডায়েরি করেছিল তার পরিবার। তত দিনে বার বার ফোন করলেও মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার বিউটি পার্লারে ফোন করে জানা গিয়েছে, মিথ্যা বলেছিলেন তিনি।

 

তদন্তে নেমে আত্মীয়তার সূত্রে প্রশান্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ। ততদিনে নিজের মোবাইলের যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলেছেন তিনি। তবে তার মোবাইলের কল লিস্ট দেখে সন্দেহ হয় তদন্তকারীদের। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

 

(জনৈক ধর্মগুরু) কীভাবে তার স্ত্রীকে খুন করেছিলেন? ২০ মার্চ খুনের পরেই গুগ্‌লে সার্চ করেছিলেন প্রশান্ত। এমনই জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা বি গোবাকুমার। এরপর গুগ্‌লের কাছে প্রশান্তের প্রশ্ন ছিল, কীভাবে দেহ লোপাট করতে হয়? সে রাতে আবার গুগলের সাহায্য নেন তিনি। তাতে এমন সব সিনেমার সুলুকসন্ধান শুরু করেন, যেগুলোতে পুলিশের চোখে ধুলো দিচ্ছে অপরাধীরা।

 

মোবাইলের তথ্য মুছে দিলেও তা উদ্ধার করতে সফল হয়েছিল পুলিশ। সেই সঙ্গে গুগলের তার সার্চের রেকর্ড দেখে তার বিরুদ্ধে সন্দেহ জোরালো হয়।

 

সুচিত্রা পিল্লাই হত্যাকাণ্ড মামলায় প্রশান্তকে দোষী সাব্যস্ত করেছে কোল্লম অতিরিক্ত দায়রা আদালত। এই মামলা পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বিচারক। গত সোমবার তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে তাকে অতিরিক্ত ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। দুই সাজা একসঙ্গে কাটাতে হবে প্রশান্তকে। সঙ্গে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে সুচিত্রার খুনিকে। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন