চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশে হতাশ জাপানিরা

অনলাইন ডেস্ক

১৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ১১:৩৩ অপরাহ্ণ

বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য জাপানভিত্তিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ওয়াইকেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে বেশ কিছু নির্মাণ উপকরণ আমদানি করে বাংলাদেশে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জারি করা ২৩৭ নম্বর এসআরও অনুযায়ী ওইসব উপকরণ আমদানি শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্র্তৃপক্ষ (বেপজা) থেকেও ওয়াইকেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ওইসব উপকরণ আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। উপকরণ বন্দরে আসার পর এনবিআর তাতে শুল্ক আরোপ করে। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ওয়াইকেকে বাধ্য হয়ে ২ কোটি ৯২ লাখ টাকা শুল্ক পরিশোধ করে পণ্য ছাড় করে।

তখন থেকে গত ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ওই শুল্ক ফেরত পেতে ওয়াইকেকে বাংলাদেশ পিটিই, জাপান এক্সটার্নাল  ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) ও জাপান দূতাবাস থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ১৩ দফা চিঠি দেয়ার পরও তার সুফল পায়নি। সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর বিষয়টি উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি লিখেছেন ঢাকা ইপিজেডে বিনিয়োগ করা কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকাশি মিয়াতা।

ওয়াইকেকের মতোই বাংলাদেশে ব্যবসা করতে এসে এনবিআরের নানা ধরনের শুল্ককর ও ভ্যাট, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে পণ্য ছাড়ে বিপুল সময় ব্যয়সহ নানা কারণে হতাশ মারুবেনি, জাপাটেক, টেক্কেন, বেঙ্গল ফিশারিজসহ জাপানি কোম্পানিগুলো। দীর্ঘদিন ধরে কর সংক্রান্ত নানা জটিলতা নিয়ে এনবিআরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের পরও তা সুরাহা না হওয়ায় তাদের হতাশা আরও বাড়ছে। এসব বিষয়ে কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে পৃথক প্রতিবেদন ও চিঠি দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়রানির বিষয়ে মন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে জেট্রোও, যার কপি বেশ কিছু সাংবাদিকের হাতে রয়েছে। সূত্র: দেশ রূপান্তর।

বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী জাপানি প্রতিষ্ঠান জাপাটেক ক্লিনিং সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উসুকে নুজিমা জানান, কোম্পানিটির ২০১৬-১৭ অর্থবছরের অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে এনবিআর ১৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব দাবি করে। বিষয়টি নিয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে। কিন্তু এনবিআর থেকে এখনো ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়করের ক্লিয়ারেন্স দেয়া হচ্ছে না।

‘আমাদের ভবিষ্যতেও যদি এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় এবং আমাদের যদি অযৌক্তিকভাবে কর পরিশোধ করতে হয়, তাহলে আমাদের পক্ষে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করাই কঠিন হয়ে পড়বে যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশে জাইকার অর্থায়নে ভেড়ামারা কম্বাইন্ড সাইকেল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে জাপানের মারুবেনি করপোরেশন। মারুবেনি আয়কর ফেরত চেয়ে বলেছে, জাইকার সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সব ধরনের কর, চার্জ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। তাই এটি খুবই স্পষ্ট যে, ভেড়ামারা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাপানি কোম্পানি পুরোপুরি কর অব্যাহতি পাবে। এর ভিত্তিতেই ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ আমরা গ্রাহকের সঙ্গে ইপিসি চুক্তি করি। তারও তিন বছর পর এনবিআর ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই আমাদের কর অব্যাহতি দিয়ে পত্র দেয়। তিন বছর আগে চুক্তি করায় গ্রাহকের সঙ্গে সময়মতো কাজ চালিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য জরুরি ছিল। এনবিআর থেকে চূড়ান্তভাবে চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই তিন বছর আমরা গ্রাহককে বিল দেওয়ার সময় উৎসে কর কেটে রেখেছি, যার পরিমাণ ১২ কোটি টাকার বেশি। এনবিআর চেয়ারম্যান ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর আমাদের জানান, কেটে রাখা করের অর্থ ফেরত দেয়া হবে। আমরা ইতিমধ্যে সব ধরনের নথিপত্রসহ আনুষ্ঠানিকভাবে তা ফেরত চেয়ে আবেদন করেছি। যত দ্রুত সম্ভব তা ফেরত দিতে আমরা অনুরোধ করছি।

জাপানি ব্যবসায়ীরা জানান, ইপিজেডে বিনিয়োগে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানি করমুক্ত। কিন্তু কোনো যন্ত্র সচল রাখতে কোনো যন্ত্রাংশ বদল করার প্রয়োজন হলে তা আমদানিতে শুল্ককর দিতে হয়। এছাড়া শুল্ককরের পরিমাণ এনবিআরের কর্মকর্তাভেদে ভিন্ন হয়। তারা যন্ত্রাংশ আমদানিতেও কর অব্যাহতি সুবিধা চেয়েছেন।

তারা জানিয়েছেন, কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়া বেপজা হঠাৎ করেই তিন মাসের জন্য ‘ইলেকট্রিসিটি সিকিউরিটি ডিপোজিট’ দাবি করছে। আমরা জরিপ করে দেখেছি, চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেডে সব কোম্পানির কাছে এ ধরনের ডিপোজিট চাওয়া হচ্ছে না। এ ধরনের ডিপোজিট না নেয়ার অনুরোধ করেছেন জাপানি উদ্যোক্তারা।

টেক্কেন করপোরেশন জানান, বাংলাদেশে কর অব্যাহতি সুবিধার প্রক্রিয়া অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশে নানা ধরনের কর রয়েছে, এর মধ্যে কোনটি অব্যাহতিপ্রাপ্ত আর কোনটি নয়, তা জানাও খুব কঠিন কাজ। কোনো চুক্তি হওয়ার পর যদি ভ্যাট হার বাড়ে, তখন ওই হারের সঙ্গে চুক্তি সংশোধন করে তা কার্যকর করতে হবে। চুক্তি সংশোধন না করে নতুন হারে ভ্যাট দেয়া কীভাবে সম্ভব?

শুল্ক সম্পর্কে তিনি জানান, কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে অল্প সময়ের জন্য কিছু গাড়ি আমদানি করতে হয়। কিন্তু এনবিআর এ ধরনের অস্থায়ী আমদানিতে আপত্তি জানায়। তখন আমাদের স্থায়ীভাবে আমদানির মতো করে শুল্ককর পরিশোধ করতে হয়, যা আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ। অস্থায়ীভাবে আমদানি করা পণ্য আবার রপ্তানি করতে গেলে সে বিষয়ে এনবিআরের কোনো নীতি নেই।

জেট্রো জানান, ইপিজেডের কোম্পানিগুলোরও বন্ড লাইসেন্স নিতে হয় এবং দু’বছর পরপর তা নবায়ন করতে হয়। তারা এই বন্ড লাইসেন্স নেয়ার বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে।

বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যার কথা উল্লেখ করে জেট্রো জানান, বাংলাদেশে টিটির মাধ্যমে লেনদেন করা যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। বিদেশি সরবরাহকারীরা বাংলাদেশের জন্য এলসি খুলতে আগ্রহী হন না। কারণ, অর্থ পেতে অনেক দেরি হয়, অনেক বেশি চার্জ এবং অপ্রয়োজনীয় অনেক কাগজপত্র চাওয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও অনেক বেশি গ্যারান্টি চায়। বাংলাদেশ এখন উচ্চমূল্যের পোশাক উৎপাদনের দিকে যাওয়ার চিন্তা করছে। এক্ষেত্রে জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। তবে এজন্য ফ্রি অব কস্ট সুবিধায় সব ধরনের উপকরণ আমদানির সুযোগ থাকা দরকার।

বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে জেট্রো জানান, গত বছর ঢাকায় জেট্রোর অফিসে ১০০০ জাপানি ব্যবসায়ী এসেছেন। তাদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ঢাকা বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে পেসেঞ্জার পাস পেতে লম্বা সময় লাগে, যা বিরক্তিকর। অথচ মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে প্রতি যাত্রীর এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না। আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, ঢাকা বিমানবন্দরে এরাইভাল ভিসা পেতে ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।

বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পেতে অনেক বেশি সময়ের দরকার হয় উল্লেখ করে জেট্রোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানবন্দর বা সমুদ্রবন্দরে ফ্রেইট আসার পর আমদানি ক্লিয়ারেন্স পেতে বাংলাদেশে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে সময় লাগে ১৬ দিন, বিমানবন্দরে ৮ দিন।

পূর্বকোণ-রাশেদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট