চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সড়কে আর কত প্রাণ ঝরবে?

১৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ

নিরাপদ সড়কের জন্যে আন্দোলন-সংগ্রাম যেন অরণ্যরোদনে পরিণত হচ্ছে। সড়কদুর্ঘটনা থামছেই না। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়কদুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এমন কোনো দিন নেই যে, সংবাদমাধ্যমে কোনো সড়কদুর্ঘটনায় হতাহতের খবর থাকে না। গত বুধবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এক স্কুলশিক্ষার্থী রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগামী টেক্সির ধাক্কায় প্রাণ হারায়। একইদিন দেশের অন্যান্য স্থানেও আরো কয়েকটি দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সড়কে এরকম প্রাণহানির চিত্র উদ্বেগকর, মর্মান্তিক, অনাকাক্সিক্ষত।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি কর্তৃক ১২ জানুয়ারি প্রদত্ত তথ্য বলছে, গত বছর সারাদেশে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়কদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭ হাজার ৮৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের তুলনায় গত বছর সড়কদুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেই এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কারণ রিমোট এরিয়াগুলোতে সংগঠিত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর সবসময় গণমাধ্যম পর্যন্ত আসে না। আবার দুর্ঘটনার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর খবরও বেশিরভাগ সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। ইদানিং মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার পরিমাণও বেড়ে গেছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, গত বছর দুর্ঘটনার শিকার যানবাহনের মধ্যে ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছিল বাস, ২৯ দশমিক ৮১ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ও ২১ দশমিক ৪ শতাংশ মোটরসাইকেল। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে গত ৮ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলছে, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে সারাদেশে সংঘটিত ৪ হাজার ৬৯৩টি সড়কদুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২১১ জন নিহত এবং আহত হন ৭ হাজার ১০৩ জন মানুষ। নিহতের মধ্যে শিশু ৬১৩ এবং নারী ৭৮৯ জন। সেখানেও বলা হয়েছে, এককভাবে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। ১ হাজার ১৮৯টি মোটরবাইক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৪৫ জন, যা মোট নিহতের ১৮.১৩ শতাংশ। মোটরবাইক দুর্ঘটনার হার ২৫.৩৩ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে দিচ্ছে বিষয়টি কতটা ভয়াবহ।

১৭ বছরের সড়কদুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি ৪৩ শতাংশ সড়কদুর্ঘটনা সংঘটিত হয় মহাসড়কে। শহরাঞ্চলে সড়কদুর্ঘটনা ঘটে ২৩ শতাংশ, আঞ্চলিক মহাসড়কে ১৩ শতাংশ এবং বাকি ২১ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্ম গ্রামীণ সড়কে। আর দুর্ঘটনার ১৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে হয়। এসব সংঘর্ষের ৭০ শতাংশই প্রাণঘাতী। আর চালকের স্বেচ্ছাচারিতা ও অতিরিক্ত গতিই যে বেশিরভাগ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ, তা বলাই বাহুল্য। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হওয়া দুর্ঘটনা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কদুর্ঘটনা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব দায়ী। কিন্তু মূল কারণ শণাক্তের পরও সমাধানে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এখন সংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালির সুযোগে পরিবহণ খাত অনিয়মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সড়কদুর্ঘটনা। আর প্রধান শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আমরা মনে করি, এ বিষয়ে আর নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। দেশস্বার্থে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। সরকারের উচিত এমন আয়োজন নিশ্চিত করা যাতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই কমে আসে এবং পর্যায়ক্রমে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্যে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণসমূহের দিকে নজর দিতে হবে। চলতি বছরের মধ্যে দেশে সড়কদুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এ লক্ষ্যে অ্যাকশন প্ল্যানও আছে। আমরা সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। মনে রাখা দরকার, ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে হলে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবার মানোন্নয়নের বিকল্প নাই। যাত্রীকল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনা; বিপজ্জনক অভারটেকিং; রাস্তাঘাটের ত্রুটি; ফিটনেসবিহীন যানবাহন; যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা; চালকের অদক্ষতা; চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার; মাদক সেবন করে ড্রাইভিং; রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা; রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা; ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং ছোট যানবাহন বৃদ্ধিসহ সড়কদুর্ঘটনার ১২টি কারণ এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়নসহ দুর্ঘটনা রোধে ১২টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। উপযুক্ত পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে এসব বিষয়ও আমলে নেয়া দরকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট