চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

বিদেশে নারীশ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা থাকা জরুরি

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের মহিলারা কেন নির্যাতিত হচ্ছে বিদেশে গিয়ে? এর কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের দেশের মা-বোনদের কেনই বা বিদেশে যেতে হচ্ছে? এরও কোন সদুত্তর পাইনি। অনেকেই হয়তো বলবেন, আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য। কিন্তু, সংসারের আয় বাড়াতে দেশের মধ্যে বিকল্প চিন্তা না করে বিদেশের মত অচেনা-অজানা জায়গায় পাঠিয়ে মা-বোনদের কি হাল হচ্ছে, তা প্রতিদিনকার পত্রিকার পাতায় খবরাখবর পাচ্ছি। আর ততই উদ্বেগ বেড়ে উঠছে। এই দেশের মহিলারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেত। এখনো যাচ্ছে। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর বিদেশেই কর্মজীবন শুরু করেছে।

আবার অনেকেই দেশে ফিরে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে যে হারে মহিলাদের শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হচ্ছে, তা রীতিমত উদ্বেগজনক এবং ভয়াবহ। বাঙালি নারীর চিরায়ত রূপ এখন আর নেই। স্বামী-সন্তান দেশে রেখে, তাদেরই সুখের কথা চিন্তা করে গৃহকর্মী হিসেবে গিয়ে অধিকাংশই নির্যাতিত হচ্ছে এবং কেউ কেউ মারা যাচ্ছে। মৃতদেহ পড়ে থাকছে হাসপাতালের মর্গে। যাদের আবার আর্থিক ক্ষমতা আছে, তারা হয়তো মৃতদেহ আনতে পারছে। যাদের নেই, তারা ঐ দেশেই বেওয়ারিশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ঐ দেশের মাটিতে জায়গা নিয়েছে। ভাবুন তো, কি ভয়াবহ অবস্থা?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে শ্রমিক হিসেবে যাওয়া শুরু হয়। বছর বছর এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর তাদের উপার্জিত অর্থও এদেশে আসতে থাকে বিপুল পরিমাণে। ২০১৫ সালে প্রবাসীরা ১ লাখ ৩০ হাজার ২৯৩ দশমিক ৬১ কোটি টাকা বাংলাদেশে পাঠিয়ে রেকর্ড করেছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রবাসীরা বৈধভাবে টাকা পাঠিয়েছে এক লাখ আটত্রিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সুতরাং অনেকেরই লক্ষ্য থাকে, যত বেশি শ্রমিক পাঠানো যায়, তত বেশি টাকা আসবে। এর সাথে যুক্ত আছে এজেন্টসমূহ। তারা নানাভাবে প্রলুব্ধ করে শ্রমিক পাঠাচ্ছে বৈধ-অবৈধ উপায়ে। এই এজেন্টদের রয়েছে দেশজুড়ে শক্তিশালী জালচক্র। কাঁচা টাকা আর অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য এই চক্রটি কাজ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। প্রতারণার খবরও পাই। কিন্তু তা খুবই কম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীশ্রমিক পাঠানো কেন? আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারী একটি শক্তিশালী অবস্থানে আছে। গৃহস্থ কাজও জাতীয় উন্নয়নের একটি অংশ। তার বাইরে এদেশের নারীরা অন্যান্য কাজে যুক্ত হয়ে উপার্জন করছেন।

নার্স, গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে পাঠানো হচ্ছে। ইদানিং ফেসবুকের কল্যাণে সেইসব দেশে নারীদের বর্তমান অবস্থার চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। অল্প কয়েকদিন আগেই দেখলাম, এক আরবীর হাতে কি নির্মমভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে এক মহিলা গৃহকর্মী। গা শিহরিয়ে উঠার মত দৃশ্য। যেসব নারী ঐ দেশে যাচ্ছে, তারা তো কখনো ইংরেজী বা অন্য ভাষায় কথা বলতে পারেন না।
আবার সাংস্কৃতিকভাবে ঐ দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মত অভ্যস্ত নয়। সুতরাং বেশি টাকা উর্পাজনের মোহের চক্রে ফেলে এবং এজেন্টদের কাছে প্রলুব্ধ হয়ে আমরাই তো ্এদেশের নারীদের বিদেশে পাঠাচ্ছি। নারীশ্রমিক হিসেবে বেশি গিয়েছে ঢাকা জেলা থেকে। এরপর গিয়েছে মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুর থেকে। দালালচক্র নারীদের অশিক্ষা ও অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে ভালো চাকরী, উচ্চবেতনের কথা বলে জায়গা-জমি বিক্রি করিয়ে তা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যারা যাচ্ছেন, তারা জানে না তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য টাকা কত, কর্মঘণ্টা, নিজের অধিকার। আর এজেন্টরা বিদেশে পাঠিয়েই শেষ। আর কোন খোঁজ খবর রাখে না। গত সাড়ে তিন বছরে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ২ লাখ ৬০ হাজার নারী। এই সাড়ে তিন বছরে নারীশ্রমিকের লাশ এসেছে প্রায় সাড়ে তিনশত। তাঁদের মধ্যে ৫৩জনই আত্মহত্যা করেছেন- এ তথ্য জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তার মানে, যদি আত্মহত্যাই করে থাকে ঐ নারী শ্রমিকেরা, কী নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে, একবার ভাবুন তো! অনলাইন জগতে ভাইরাল হয়ে সৌদি আরবে আটকেপড়া হাজার নারীশ্রমিকের আহাজারির চিত্র দেখতে পাই। পরিবারের কাছে আকুতি জানাচ্ছে, ঐ দেশ থেকে নিজ দেশে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু, কি এই বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ আছে?

অথচ দেখুন, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তের উদ্যোগ। এক ফিলিপিনো গৃহকর্মীকে হত্যা করে এক মাস লাশ ফ্রিজে রেখে দেওয়ার সচিত্র খবর প্রকাশ পেলে প্রেসিডেন্ট দুতার্তে এক বৈঠকেই কুয়েতে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেন।
অথচ, সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মী নাজমা বেগম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়ার পর একমাস মর্গে থাকল। কিন্তু কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলো না। বিদেশে নিরাপদ কর্মজীবনের গ্যারান্টি কে দেবে এ যেমন প্রশ্ন, তেমনি বড় প্রশ্ন- গ্যারান্টি ছাড়া বিদেশে নারীশ্রমিক পাঠানো কেন হবে? যদি এজেন্টদের সরাসরি জবাবদিহিতা এবং বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে এই সমস্যা বহুলাংশে কমে যেত। কিন্তু দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে, এর কোনটিই সরকারের কোন সংস্থা করতে পারেনি। তাই এর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। যার ফল ভোগ করছে এদেশের নিরিহ নারী। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র তাদের নারীশ্রমিকদের সুরক্ষায় এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফিলিপাইন, নেপাল ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নারীশ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে, এই বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার।

সম্প্রতি বাংলাদেশ নারীশ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নারীশ্রমিকেরা সৌদি আরব যেতে চান। কারণ, এরা লেখাপড়া যেমন শিখেনি। ফলে কায়িক শ্রম করে টাকা উপার্জন করতে চায়।’ কিন্তু এর ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা শুধুমাত্র ভুক্তভোগী পরিবারই বুঝতে পারছে। নির্মম অত্যাচার, ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে এদেশে এসেছে অনেক অবিবাহিত নারী। তাই, শুধুমাত্র কায়িক শ্রম করে উপার্জন করার ভাবনাকে বাদ দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে নার্স কিংবা অন্য কোন সম্মানজনক পেশার জন্য নারীদের পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ইতিমধ্যে নতুন শ্রমবাজারও তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জাপানে নার্স, বয়স্ক ও অসুস্থদের সেবা দেয়ার জন্য কর্মী এবং শিশুদের যতœ নেয়ার জন্য নারী শ্রমিক পাঠাচ্ছে। এই নারীশ্রমিকরা হংকং এবং সিঙ্গাপুরও যাচ্ছে।’ এইটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। আমাদের সকল মহলের উচিত হবে, এই বিষয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তাই একটি সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করা বিশেষ প্রয়োজন, যা আমাদের সমাজ উপযোগী এবং কল্যাণকর ।

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট