চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

আসুন, আপন দর্পণে আপনারে দেখি

রেজা মুজাম্মেল

২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ

মানুষ আয়না দেখে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে। দেখে চেহারার পূর্ণাঙ্গ অবয়ব। মাথার চুল কমছে কিনা, পড়ে যাচ্ছে কিনা, ত্বকের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে কিনা, খুব বেশি বুড়িয়ে যাচ্ছে কিনা এবং মুখাবয়বের চাকচিক্য ঠিক আছে কিনা- এসব দেখে। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই দেখেতে পান নিজের চেহারার কোনো অসঙ্গতি। নিজেকে নিজে দেখা, যাচাই করা। তদুপরি রূপ চর্চাও হয় আয়নার সামনে। শারীরিক সৌন্দর্যও নিজ চোখে অবলোকন করা হয় আয়নার সামনে। মানসিক বোঝাপোড়া হয় নিজের সঙ্গে নিজের। এতসব কিছুর ফল ইতিবাচক হলেই মুখ ফিরাই আয়না থেকে। অন্যথায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই যত সব অসঙ্গতি থাকে তা ঠিক করে নেয়া হয়। বলা যায়, এটি চিরাচরিত নিয়ম। জীবন নির্বাহের অমোঘ ধারাও বটে।

দুই. মানুষ মাটির তৈরি। আয়না বালুর তৈরি। ফলে বালু মাটির সংস্করণ। মানুষ আর আয়নার সৃষ্টিগত রহস্য এক ও অভিন্ন। হয়তো এ কারণেই আয়না তার স্বজাতির আভ্যন্তরীণ রূপ দেখতে পারে। পক্ষান্তরে, বালু মাটির সহোদর। তারা একে অপরকে বুঝে, জানে ও চিনে। মানুষ মানুষের সহগোত্র বা স্বজাতি। কিন্তু ধর্ম ও দর্শন থেকে আলাদা নয়। একেবারেই সাধারণ তরল বালু- যা ‘সিলিকন ডাইঅক্সাইড’ (ল্যাটিন শব্দ সিলিক্স ঝরষরবী, ইংরেজির ঝরষরপড়হব উরড়ীরফব) দিয়ে আয়না বা গ্লাসের সৃষ্টি হয়। এই বালু মানুষের হাতে গড়া আয়না বিশ্বের রূপ দেখতে পারে, দেখাতে পারে। কিন্তু মানুষ হয়তো আয়নার স্বরূপ বুঝতে পারে না। মানুষ বুঝে না আয়নার ভাষা। তাই আয়না দেখাটা অনেকের কাছে কেবল ‘দেখার জন্যই দেখা’র মত। ফলশ্রুতিতে আয়না দেখার মধ্যে যে মর্মার্থ আছে তা হয়তো আমরা অনেকেই অনুধাবন করতে অক্ষম। হয়তো কেউ কেউ বুঝতে পারেন।

তিন. আসলেই কি আয়না কেবল চেহারার সৌন্দর্য দেখার। নিজের রূপ চর্চার? নাকি এর অন্তর্নিহিত অন্য আরো কিছু মূল্যায়ন আছে। বিষয়টা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি, ভাবার প্রয়োজনবোধ করেছি? আয়না মানুষের চেহারার অসঙ্গতি পরিষ্কার করে দেখায়। এ দেখানোর মধ্যে সে কখনো পক্ষপাতিত্ব বা ভুল করে না। মুখাবয়বে যা আছে তাই দেখায়। আয়না আমাদেরকে প্রকৃত সত্য এবং তথ্যই বলে দেয়। আয়নার সামনে থেকে কোনো কিছু লুকানোর সুযোগ নেই। আয়না যেমন মানুষের মুখের ভাল-মন্দ পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করে, ঠিক তেমনি মানুষ যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভাল-মন্দ নিজেই মূল্যায়ন করে, নিজের অসঙ্গতিগুলো যদি নিজেই নির্ণয় করে, নিজের দোষ-ত্রুটি নিজেই অনুধাবন করে এবং তা নিরসনের চেষ্টা করে, তাহলে সন্দেহ নেই- পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র আরো অনেক বেশি পরিশুদ্ধ এবং পরিশিলীত হতো। শাণিত হতো সমাজ ব্যবস্থা।
অবারিত দ্বার উন্মুক্ত হতো আত্মশুদ্ধির। মনের মধ্যেই তৈরি হতো আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা। চেতনাবোধ জাগরুক হতো আত্মোপলব্ধির। নিজের মধ্যে তৈরি হতো পরিবর্তনের মানসিকতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর উল্টোটা। আমরা আয়না দেখি কেবল নিজের চেহেরার সৌন্দর্য কিংবা রূপ চর্চার জন্য। ফলে অনেকেই আয়নার স্বরূপ দেখে না, অথবা বুঝে না।

চার. একজন মানুষ যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায়, তখন আয়না বলে দেয় তিনি কেমন। সৎ নাকি অসৎ। সত্যবাদী নাকি মিথ্যাবাদি। হিংসুক নাকি আন্তরিক। পরোপকারী নাকি পরশ্রীকাতর। মানুষের অবয়বেই পরিষ্পুট হয় মানুষের চরিত্র। আয়না মানুষের স্বরূপের প্রতিচ্ছবি। আয়নাই মানুষের ইতিবাচক-নেতিবাচক কাজের প্রতিবিম্ব। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মানুষ নিজের চোখ-মুখ দেখে নিজেই বুঝতে পারবেন, তিনি আগে কেমন ছিলেন, এখন কেমন আছেন এবং আগামীতে কেমন থাকবেন। এ অনুধাবন থেকে তিনি আগামী দিনের জন্য পরিকল্পনা তৈরি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন। ফলে বলা যায়, আয়না কেবল চেহারা দেখার, রূপ চর্চা এবং মুখের বাহ্যিক চাকচিক্য দেখার জন্য নয়, মনের ভেতরের রূপ-রং এবং মনের প্রকৃত স্বরূপ দেখারও একটি অন্যতম মাধ্যম। বিষয়টি কেউ কেউ অবগত, হয়তো কেউ অবগত নন। কেউ হয়তো বুঝেও না বুঝার মত আছেন। কেউ বা বিষয়টি এড়িয়ে চলেন।

পাঁচ. আমরা অন্যের সমালোচনা করি। এটি অবশ্য কিছু মানুষের পছন্দের কাজও বলা যায়। অনেকেই হয়তো অন্যের সমালোচনা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, আনন্দও পান। যদিও অন্যের অহেতুক সমালোচনা, পরনিন্দা, পরচর্চা করাটা কোনো মতেই উচিত কাজ নয়। তবুও আমরা করি। কিন্তু আমরা কখনো নিজের সমালোচনাটা নিজে করি না। আত্মসমালোচনা করি না। নিজের মধ্যে কী কী দোষ-ত্রুটি আছে, কী কী অসঙ্গতি আছে, প্রতিদিন কোন কোন অপ্রয়োজনীয় কাজটি নিজের মনের অজান্তেই করে যাচ্ছি, নিয়ম-নীতি না মানার চর্চা করছি কিনা, মিথ্য কথা বলছি কিনা, অন্যায় ও গর্হিত কাজ করছি কিনা, কথা-কাজ বা অন্যভাবে অপরের কোনো ক্ষতি করছি কিনা- এসব নিয়ে চিন্তা করি না। এসব নিয়ে ভাবিও না। কিন্তু আবার ঠিকই পরের নিন্দা করতে ভুল করি না। একবারও কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রকৃত চরিত্র, চিত্র দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। আত্মশুদ্ধির প্রত্যয় নিয়ে একবার আয়নার সামনে দাড়াঁলেই বুঝা যাবে, নিজের মধ্যেই কত অসঙ্গতি, ভুল-ত্রুটি ও অনিয়ম বসবাস করছে। ফলে আমাদের উচিত, অন্যের সমালোচনা করার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা, নিজের কাছে বসত গড়া অনিয়ম-অসঙ্গতিগুলো দূর করার চেষ্টা করা। তাহলেই আয়না দেখার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। কমবে অন্যের সমালোচনা করার প্রবণতা।
ছয়. আমরা প্রতিনিয়ত কত অপরাধ করি, কত অন্যায় কাজ করি, কত দোষ-ত্রুটি করি। এ নিয়ে হয়তো আমাদের মধ্যে কোনো চিন্তা কিংবা দুশ্চিন্তা নেই।

নিজের মধ্যে নেই কোনো প্রকারের অনুশোচনা। থাকে না কোনো অপরাধবোধও। থাকে না প্রায়শ্চিত্ত করার কোনো মানসিকতা। কিন্তু কেন? আমরা কি আমাদের দোষ-ত্রুটি আমরা খুঁজে দেখতে পারি না। আয়না দেখে কি একটু চেষ্টা করা যায়- কি করছি, কী করা উচিত, কেন অন্যায় কাজ করছি, কেন অন্যের সমালোচনা করছি। আয়না দেখে কি একটু আত্মসমালোচনা করা যায় না? নিজেই কি নিজের ত্রুটি অনুসন্ধান করতে পারি না? আমরা যদি নিজের দোষ-ত্রুটি নিজে বের করতে পারি, নিজের অপরাধটা নিজে বুঝে প্রায়শ্চিত্তবোধ করি, তাহলে নিঃসন্দেহে সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্র থেকে সিংহভাগ অপরাধ কমে যেত। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হত সত্য, সুন্দর, ন্যায়। অসত্যের ছোঁয়ায় কলুষিত হওয়া সমাজে সত্যের আলো বিচ্ছুরিত হত। সুন্দরের অমলিন ছায়ায় আবৃত হতো পরিবার ও সমাজ। কিন্তু প্রশ্নটা হলো এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনো প্রকার চেতনাবোধ তৈরি হয় না। বদলানোর কোনো চেষ্টা করি না। পরিবর্তন আসে না মনের জগতে। ঘুনে ধরে আছে চিন্তার আঙিনাটি। প্রশস্ত হচ্ছে না চেতনার বাতায়ন। আসুন, আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াই। কেবল চেহারা দেখতে নয়, নিজের অসঙ্গতি অবলোকন করতে। নিজেকে নিজে চিনতে, বুঝতে। নিজের অপরাধবোধের বিরুদ্ধে নিজকে জাগরূক করতে। নিজকে পরিশুদ্ধ করতে। নিজের মধ্যে উদ্দীপনা জাগাতে। জয় হোক সত্যের। সুন্দরের।

রেজা মুজাম্মেল গণমাধ্যমকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট