চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার

অধ্যাপক রতন কুমার তুরী

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে নোবেলজয়ী অং সাং সুচির দম্ভ চুর্ণ হলো। তিনি পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়ার আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) করা মামলায় মুখোমুখি হয়েছেন হেগ শহরে। গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে মামলা করেছে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে। মামলায় দেশটি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার নানা তথ্যপ্রমাণ হাজির করেছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার নিপীড়নসহ গণহত্যার কথা তুলে ধরেছে। গাম্বিয়ার পাশে আছে দুয়েকটি ছাড়া সব দেশ। উল্লেখ্য, মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পাশবিক কায়দায় অত্যাচার নিপীড়ন এবং গণহত্যা চালিয়েছে। মিয়ানমারের অত্যাচার সইতে না পেরে বারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু নাগরিক মর্যাদায় তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দিচ্ছে না দেশটি। নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসলেও ঐ দেশে নেই তাদের কোনো নাগরিক অধিকার। দেশটিতে রোহিঙ্গারা যুগপরম্পরায় মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। সময়ে সময়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর এতই অত্যাচার চালিয়েছে যে এদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বেশ ক’বছর আগে দেশটির সেনা ছাউনিতে কিছু দুষ্কৃতকারী হামলা করলে এতে তাদের সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য নিহত হয়, আর এরই জের ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের হত্যা করে। বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়। সে সময় অবশ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অনুরোধ আসতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ে। তাদের মুখে মুখে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা বিশ্ব মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে আমেরিকা মিয়ানমারের কিছু সেনা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধানের একাউন্ট ডিলিট করে দেয়। কানাডা, নেদারল্যান্ড মিয়ানমারে বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে ওঠেপড়ে লাগে। তবুও কিছু শক্তিধর দেশ মিয়ানমারের পক্ষে থাকার কারণে এ বিষয়ে তারা কারো কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন অনুভব করেনি। এমনকি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে স্বয়ং জাতিসংঘের মহাসচিবের অনুরোধেকেও তারা উপেক্ষা করে। ব্যাপক আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার পর মিয়ানমার এক পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারা নানা বাহানায় সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। এমন পরিস্থিতিতে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিজ আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা করে। এখন বিচার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আর এককালের গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত বর্তমান বিশে^র সবচেয়ে ঘৃণিত অংসান সু চি মিয়ানমারের পক্ষে সাফাই গাইতে হেগে গেছেন। সেখানে তার মিথ্যাচারে বিশ^বাসী হতবাক হয়েছে। তিনি তার জবানবন্দিতে রোহিঙ্গা গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছেন।

এই প্রথম মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়ালো।

বর্তমানে বিচারটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে চলমান থাকলেও এই বিচারের রায় বাস্তবায়ন করতে গেলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী দেশসমূহের ভূমিকা থাকতে হবে। আমাদের বিশ^াস, একটি নিরাপদ বিশে^র স্বার্থে তারা দায়িত্বশীল আচরণ করবে। এখন চীন এবং রাশিয়াসহ যারা মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে তাদের শুভবোধের উদয় হওয়াও জরুরি। আমরা অতিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশসমূহের কিছু সদস্য দেশকে মিয়ানমারের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে দেখেছি। ফলে তাদের কারণেই মিয়ানমার বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করতে পেরেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান বিশ্ববাসী প্রত্যাশা করছে। আমরা বিশ^াস করতে চাই, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত মামলাটির সুন্দর নিষ্পত্তি করবে। একই সঙ্গে রায় মানতে মিয়ানমারকে বাধ্য করবে বিশ^সম্প্রদায়।

অধ্যাপক রতন কুমার তুরী কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকারকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট