চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

নির্মল বায়ু ও বাসযোগ্য নগরীর স্বপ্ন

নোমান উল্লাহ বাহার

২২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অনুষঙ্গ বায়ু বা বাতাস। স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাত্রা নির্ভর করে নির্মল বায়ুর উপর। সভ্যতার ক্রমবিকাশ, নগরভিত্তিক উন্নয়নের মহোৎসবসহ নানাভাবে আমরাই আমাদের সুস্থ জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ বায়ুকে দূষণ করছি প্রতিনিয়ত। বায়ুদূষণের পরিস্থিতির ফলে পরিবেশগত সংকটে আমরা উপনীত। একদিকে দূষণের উচ্চমাত্রা, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎসও দিন দিন বাড়ছে।
বায়ুদূষণ হওয়ার বহু কারণ বিদ্যমান। যেমন- বায়ুতে ক্ষতিকর গ্যাস মিশ্রিত হওয়া, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, খাবারের দোকানের উনুন, ময়লা আবর্জনা পোড়ানো, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, দূষণমুখী শিল্পায়ন, ইটভাটা, নির্মাণ খাতের চরম অব্যবস্থাপনা, সড়কে ফেলে রাখা নির্মাণ সামগ্রী, সমন্বয়হীন উন্নয়ন কর্মকান্ড, পাহাড় কাটা, পরিবেশ সংরক্ষণে পৃথক বরাদ্দ ব্যবহার না করা, যত্রতত্র ময়লা ফেলে রাখা, প্লাস্টিক পোড়ানো প্রভৃতির কারণে বায়ুদূষণ ভয়াবহ মাত্রায় রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বায়ুদূষণ চরম অসহনীয় ও বিপজ্জনক মাত্রায় অধিষ্টিত। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বের শহরগুলোর চেয়ে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশকিছু এলাকায় বাতাসে বস্তুকণার উপস্থিতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মাত্রার বায়ুদূষণের ফলশ্রুতিতে নাগরিক জীবন পর্যুদস্ত। ইতোমধ্যে বায়ুদূষণের জন্য অস্বাস্থ্যকর শহর হিসেবে পরিগণিত হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। অতীতের তুলনায় চলতি বছরে দূষণের পরিমাণ অত্যধিক। বিশেষত: ওয়াসার খোঁড়াখুড়ি, সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন, আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে দূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে দূষিত করছে। অনেকেই নির্মাণসামগ্রীগুলো রাখছে উন্মুক্ত স্থানে। এজন্য বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলশ্রুতিতে গণপরিবহনের যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যতায় বায়ুকে নির্মল না রেখে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যাত্রাকে অর্থবহ ও প্রাগ্রসর করা সম্ভব নয়।
বায়ুদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ক্ষতিকর পর্যায়ে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআ্্্ইডিএস)’র জরিপ অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার ১১ শতাংশ লোক বায়ুদূষণজনিত রোগে ভুগছে। তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত ৮ শতাংশ। হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছে ৮ শতাংশ আর ক্যান্সারে আক্রান্ত ১.৩ শতাংশ-বায়ুদূষণ পরোক্ষভাবে এ দুটি রোগে আক্রান্ত হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের চিন্তন প্রক্রিয়ায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগব্যাধি বাড়ায় চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে চলছে। বহু মানুষ অকাল প্রয়াত হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, সর্দি-হাঁচি-কাশি, হাঁপানি, ফুসফুসের অসুস্থতা, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, কানের প্রদাহ নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। অ্যাজমা সমস্যা প্রকট করে বায়ুদূষণ। সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে গর্ভবতী মা ও শিশুরা। শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রুদ্ধ। বাতাসে ভয়াবহ দূষণের শিকার শিশুরা। দূষিত বায়ু তাদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিও নষ্ট হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে অটিস্টিক শিশুর জন্ম নেওয়াও বেড়েছে বর্তমান সময়ে। বুকভরে শ্বাস নেওয়াও কঠিনতর হয়ে পড়েছে।
জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য নগর প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা অত্যাবশ্যক। বায়ুদূষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ ও কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হতে হবে। স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। শহরের রাস্তাগুলো প্রশস্ত করে সাইকেল বা পাঁয়ে হেটে রাস্তায় চলাফেরার উপযোগী করতে হবে। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি নাগরিক সমাজেরও ভূমিকা রয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পূর্বের তুলনায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে। তবে তাতেই সন্তুষ্টচিত্তে অবগাহন করা সমীচিন হবে না। বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করার দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞের বিকল্প নেই। সর্বোপরি টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
নির্মাণ খাতের অব্যবস্থাপনায় বায়ুদূষণ চূড়ান্ত ক্ষতিকর অবস্থায় উপনীত। পরিবেশসম্মত অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এগুতে হবে। পরিকল্পিত আবাসন গড়ে তুলতে হবে, যেখানে পুকুর ও উদ্যান থাকবে। নিয়ন্ত্রিতভাবে নির্মাণ কাজগুলো সম্পাদনপূর্বক পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার বাড়াতে হবে। নির্মাণাধীন রাস্তাঘাটে প্রতিদিন তিন দফা পানি ছিটানো দরকার। ধুলা নিয়ন্ত্রণ করা, কারখানাগুলোর ধোঁয়া পরিকল্পিতভাবে কমিয়ে আনা, ট্রাফিক জ্যামের সমাধান, উন্নত জ্বালানি ব্যবহার, এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রয়াস প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সচেতন ও সক্রিয় হলে বায়ুদূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। বায়ুদূষণের প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের দিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে প্রচুর বনায়ন, বৃক্ষরোপণ কার্যকর ভূমিকা রাখে। যানবাহন পরিবেশবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কিছু কিছু এলাকায় শুধুমাত্র পানি ছিটিয়ে বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা অবান্তর। দূষণের উৎসসমূহ নির্মূল করা অতীব জরুরী। ছিদ্রমুক্ত মাস্ক ব্যবহার, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, শরীর চর্চার মাধ্যমেও বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি। আবর্জনা না পুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলার নাগরিক অভ্যাসের প্রচলন ঘটাতে হবে। বায়ুদূষণ সংক্রান্ত সব আইন কানুন মেনে চলতে হবে। ব্যয়বহুল হলেও পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণের দিকে আমাদের যেতে হবে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, সকল পর্যায়ে সকলে নিরন্তর ছুটে চলছে। গড়ে উঠছে বহুমাত্রিক শিল্পায়ন। শিল্প বিপ্লব অপ্রতিরোধ্য গতিতে প্রসারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে বিপুল জনগোষ্ঠীর নগরমুখী যাত্রা বর্ধিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হলে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন ও টেকসই বসবাসযোগ্য নগর গড়তে হবে।
বায়ুদূষণ কমাতে পারলে রোগ সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ু বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বায়ুদূষণ কমিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে নগরগুলো বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। জনসংখ্যা যাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে না বাড়ে সেদিকে সুদৃষ্টি দিতে হবে। নির্মল বায়ু মানুষকে বাঁচায় ও পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে। স্স্থু জীবনযাপনে সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। প্রত্যাশিত সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতে আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। বায়ুদূষণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিবেশ শিক্ষায় অধিকতর গুরুত্বারোপ, ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। ক্রটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, যানবাহনে সিসামুক্ত জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। চতুর্দিকে বায়ুদূষণের যে নেতিবাচক প্রভাব, তা থেকে জরুরী ভিত্তিতে উত্তরণপূর্বক জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষে দায়িত্বশীল সরকারি ও বেসরকারী সংস্থাসমূহের সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অতিব জরুরী। আসুন, নির্মল বায়ুর বাসযোগ্য নগর গড়তে প্রাকৃতিক আবহে জীবনযাত্রাকে প্রাণিত করার প্রয়াসে আমরা সোচ্চার হই।

নোমান উল্লাহ বাহার সভাপতি-এসডিজি ইয়ুথ ফোরাম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট