চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

ব্যাংকিং খাতে চাই সুশাসন

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ

২০ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় একটি চালিকাশক্তি হলো ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকসমূহ ঋণ প্রদানের মাধ্যমেই মূলত আয় করে থাকে। কিন্তু গ্রাহক যখন এই ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করে না, তখন তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। এই অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় তো হয়ই না, অধিকন্তু মূল টাকাটাই গ্রাহকের হাতে আটকে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আয় কমে যায় এবং ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি হয় দায়বদ্ধতা। খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর গতিকে পুরোপুরি আটকে রাখে। কারণ এই বিশাল পরিমাণ টাকা থেকে একদিকে ব্যাংক যেমন কোনো প্রকার আয় করতে পারে না, ঠিক তেমনি এই ঋণ অনাদায়ী হওয়ার কারণে তা নতুন করে অন্য কোনো সেক্টরে বিনিয়োগও করতে পারে না। ফলে ব্যাংকের আয় কমে যায়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং ব্যাংকের আর্থিক গতিশীলতাও কমে যায়।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ব্যাংকের আয়ের সমান হয় তাহলে আয়ের পুরোটাই প্রভিশন ঘাটতির পিছনে ব্যয় করতে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় অবশিষ্ট থাকে না। তাছাড়া জামানত অতি মূল্যায়ন, বন্ধকি সম্পত্তির দলিলপত্র সংগ্রহে দুর্বলতাও অনেক ক্ষেত্রে ঋণ আদায়ে সমস্যা সৃষ্টি করে। খেলাপি ঋণের কারণে অনেক বেসরকারি ব্যাংকও সমস্যার মধ্যে আটকা পড়েছে। প্রতিটি ব্যাংকই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন আকারে সংরক্ষণ করে থাকে। এটা করা হয় বিদেশি ঋণদাতা এবং স্থানীয় আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। কোনো কারণে ব্যাংক যদি প্রদত্ত ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারে, তাহলেও যেন আমানতকারীদের অর্থ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধে অসুবিধা না হয় এবং ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো ধরনের সংশয় সৃষ্টি না হয়, মূলত সে কারণেই ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করে থাকে। সব ধরনের ঋণ হিসাবের বিপরীতেই প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ঋণ হিসাবগুলোকে সাধারণত পাঁচটি বিশেষ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়ে থাকে- অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণ হিসাব, এ ধরনের ঋণ হিসাবের বিপরীতে ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। স্পোশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ), এ ধরনের ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। সাবস্ট্যান্ডার্ড লোন হিসাবের জন্য ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ডাউটফুল লোন অ্যাকাউন্টের জন্য ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় এবং ব্যাড অ্যান্ড লস ঋণ হিসাবের জন্য শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরদিকে নিলামের মাধ্যমে বন্ধকিকৃত সম্পদ বিক্রি করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না।

বন্ধকিকৃত সম্পত্তি বিক্রির জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিলাম আহ্বান করা হলেও, তা অধিকারে যেতে পারবে না মনে করে ক্রেতারা কিনতে কম আগ্রহ দেখান। কোনো ক্রেতা আগ্রহী হলেও তিনি ঐ সম্পত্তির জন্য অপেক্ষাকৃত কম মূল্য দিতে চান। ফলে খেলাপি ঋণ যথাযথভাবে আদায় করাটা সম্ভব হয় না আর এর পরিমাণ কেবল বাড়তেই থাকে। আবার মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা খেলাপি ঋণ আদায়ের পথে অন্যতম বাধা। গ্রাহকের অযৌক্তিক মামলায় ব্যাংকের স্বাভাবিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্থ হয়। এসব মামলা চালাতে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শুধু অর্থঋণ আদালতে এত মামলার সময়মতো নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতে সমস্যা নিরসনকল্পে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই জরুরি। ক্রমবর্ধমান অর্থঋণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অর্থ ঋণ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থঋণ মামলার বিপরীতে বিবাদী কর্তৃক দায়েরকৃত রিটসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আদালত বা বেঞ্চ গঠন, আদালতকে বিভ্রান্ত করতে ঋণখেলাপি কর্তৃক মিথ্যা তথ্য প্রদানকে একটি অন্যতম অপরাধ হিসেবে পরিগণিত করে, প্রচলিত আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। ব্যাংক এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেখানে জনগণ তাদের কষ্টার্জিত টাকা জমা রাখে টাকাগুলো নষ্ট হবে না, চুরি যাবে না এবং টাকা কমে যাবে না বরং বাড়বে, এ প্রত্যাশায়। ব্যাংকিং সেক্টরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং জনগণের আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। আস্থাহীনতার কারণে জনগণ যদি ব্যাংকে টাকা জমা না রাখে, তাহলে কিন্তু ব্যাংকগুলো ডিপোজিট সমস্যায় পড়বে। ফলে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারবে না এবং আয় করতে পারবে না। ব্যাংকের বিনিয়োগ বা ঋণ প্রবাহ কমে গেলে দেশের অর্থনীতিই সমস্যায় পড়বে।

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট