চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

সুস্থ সুন্দর সন্তান কামনায় আদর্শ দম্পতির করণীয়

মনিরুল ইসলাম রফিক ইসলামের আলোকধারা

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০৯ পূর্বাহ্ণ

বিশাল ২০/২৫ তলা বিল্ডিং নির্ভর করে ভিত্তিমূলে জমানো স্তম্ভের উপর। গ্রেটবিম যেভাবে নির্মিত হয় ঠিক সেভাবে সংশ্লিষ্ট পুরো বিল্ডিংটা নির্মাণ করতে হয়। এ বিমটি যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলে পুরো ইমারতটিই ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য। আর যদি তা ত্রুটিমুক্ত হয় তাহলে পুরো দালানটাই হয় সুদৃশ্য ও টেকসই। তদ্রুপ একটি শিশুও পরিণত বয়সের জন্য গ্রেটবিম সদৃশ। শুরুতে যদি সে সুন্দর অবয়বে বেড়ে উঠতে না পারে তাহলে তার জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন ও কলংকিত। আর যদি সে যথার্থভাবে গড়ে উঠতে পারে তাহলে পরিণত হয় সে জাতীয় সম্পদে। শিশুর এ ভবিষ্যত কেরিয়ার নির্মাণে একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার হলেন মা-বাবা। তারাই পারেন সোনালী ভবিষ্যত উপহার দিতে আপন সন্তানদের। ধর্মীয় মূল্যবোধ শিশুদেরকে অংকুর থেকেই সুনিপুণভাবে গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছে। কুরআন এবং হাদীসের বিভিন্ন উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ করলে আমরা নি¤œলিখিত তথ্যাবলী লাভ করতে পারি।
প্রথমত : ইসলাম শিশুদের প্রতি শুধু জন্মের পর থেকেই যত্ন ও সতর্ক দৃষ্টি রাখার এবং সুষ্ঠু পরিচর্যার উপর গুরুত্ব আরোপ করেনি। বরং শিশুদের পিতার ঔরসে বা মায়ের গর্ভে তাদের আকার আকৃতি ও কাঠামো সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব থেকেই গুরুত্ব আরোপ করেছে।

দ্বিতীয়ত: প্রতিটি শিশুই উত্তরাধিকার সূত্রে পিতা -মাতার আকৃতি, শারীরিক গঠন, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা-শক্তি এবং অন্যান্য গুণাবলী লাভ করে থাকে এবং ভবিষ্যৎ জীবনে এ সকল বৈশিষ্ট তাদের মাঝে প্রতিফলিত হয় । এ কারণে ইসলামে স্বামী এবং স্ত্রীর নির্বাচন সুষ্ঠুভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রতি জোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। তাই বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রী উভয়েরই উপযুক্ততা, গুণাবলী, বংশকুল, ধর্ম চর্চা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত দরকার। হাদীস শরীফে আছে, হে পাত্রগণ! তোমরা পাত্রীকে দেখে নাও। কেননা, ইহা তোমাদের মাঝে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলবার প্রকৃত উপায়।
তৃতীয়ত: ইসলাম মেয়ের অভিভাবদের নির্দেশ প্রদান করেছে, তারা যেন ধর্মপরায়ণ ও চরিত্রবান পাত্রের সন্ধান করে। যে যথার্থভাবে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির প্রতি নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করতে সক্ষম। নবী করীম (স.) বলেছেন – তোমরা দীনদার মেয়ে বিয়ে কর এবং কল্যাণ লাভে ব্রতী হও, অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে-।

চতুর্থ: গর্ভে সন্তান সঞ্চার হওয়ার পর মায়ের কর্তব্য স্বীয় স্বাস্থ্য এবং মন উভয়কেই যথাসাধ্য সুস্থ রাখতে চেষ্টা করা। কেননা গর্ভস্থ ভ্রুণের সাথে মায়ের দেহ-মনের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এসময় মা- যদি অধিক মাত্রায় শারীরিক পরিশ্রম করে, তবে গর্ভস্থ সন্তানের শরীর গঠন ও বাড়তির উপর তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। শুধু তাই নয়, গর্ভবতী নারীর চাল চলন, চিন্তা বিশ্বাস, গতিবিধি ও চরিত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে গর্ভস্থ সন্তানের মন ও চরিত্রের ওপর।
এ সময় মা যদি অত্যন্ত চরিত্রবতী নারী হিসাবে শালিনতার সব নিয়ম-কানুন মেনে চলে, তার মন-মগজ যদি এসময় পূর্ণভাবে ভরে থাকে আল্লাহর বিশ্বাস, পরকালের ভয় এবং চরিত্রের দায়িত্বপূর্ণ অনুভূতিতে, তবে সন্তান তার জীবনে অনুরূপ দায়িত্ব জ্ঞানসম্পন্ন চরিত্রবান ও আল্লাহনুগত হয়ে গড়ে উঠবে। গর্ভবর্তী স্ত্রীলোকদের কর্তব্য এ সময় শালীনতা ও লজ্জাশীলতার বাস্তব প্রতিমূর্তি হয়ে সব সময় আল্লাহর সাথে মনোযোগ রক্ষা করা, কুরআন তিলাওয়াত ও নিয়মিত নামায পড়া। ভাল মা হলে ভাল সন্তান হবে। ‘আমাকে ভাল মা দাও, আমি ভাল জাতি গড়ে দেব।” নেপোলিয়ন বোনাপার্টির সে কাথাটির কার্যকারিতা ঠিক এসময়ই হয়ে থাকে।
ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামত, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের দান। কুরআন পাকে বলা হয়েছে –
‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের নিজের প্রজাতি থেকেই জুড়ি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের সেই জুড়ি থেকেই তোমাদের জন্য সন্তান-সন্ততি ও পৌত্র-পৌত্রী বানিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত সন্তান-সন্ততি আল্লাহর নিজস্ব দান বৈ কিছু নয়। (সূরা নাহল -৭২)।
বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর আবেগ উচ্ছাসপূর্ণ প্রেমভালবাসা পরিণতি ও পরিপূর্ণতা লাভ করে এ সন্তানের মাধ্যমে। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্য জীবনের নিষ্কলংক পুষ্প বিশেষ। সন্তানাদি সম্পর্কে কুরআন মাজিদে আরো বলা হয়েছে : ‘ধন মাল ও সন্তানসন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য, সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন (সূ: কাহাফ)।

দুনিয়ার কত সহস্র মানুষ এমন রয়েছে, যাদের সম্পদের কোন অভাব নেই, কিন্তু কে তা ভোগ করবে তার কোন লোক নেই। মানে হাজার চেষ্টা-সাধনা ও কামনা করেও তারা সন্তান লাভ করতে পারেনি। আবার কত অসংখ্য লোক এমন দেখা যায়, যারা কামনা না করেও বহুসংখ্যক সন্তানের জনক। কিন্তু তাদের কাছে খাবার কিছু নেই কিংবা যথেষ্ট পরিমাণে নেই। তাই বলতে হয় সন্তান হওয়া ও না হওয়া একমাত্র আল্লাহর নিজস্ব মর্জির ব্যাপার। এ ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে সুন্দর বর্ণনা রয়েছে।

আল্লাহর দয়া ও পরীক্ষার বিষয়সমূহের মধ্যে সম্পদ আর সন্তান- দুটো প্রধান। এ পরীক্ষায় তারাই উর্ত্তীর্ণ হতে পারে, যারা এক্ষেত্রে অত্যধিক বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থেকে সুষম ও সামঞ্জস্য সম্পন্ন নীতি গ্রহণ করতে পারে। সন্তানের ব্যাপারে বাড়াবাড়ির একটি দিক হচ্ছে এই যে, তার প্রতি প্রেম-ভালভাসা ও দরদ মায়া। আল্লাহর প্রতি ভালভাসা আনুগত্যেবোধকেও ছাড়িয়ে যাবে এবং তারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পক্ষান্তরে বাড়াবাড়ির অপর দিকটি হচ্ছে তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা স্নেহ বাৎসল্য প্রদর্শন ও তাদের হক আদায় করার পরিবর্তে তাদের প্রতি অমানুষিক জুলুম করা ও তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রত্যাহার করা।

জাহেলিয়াতের যুগে এ সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি অবলম্বিত হতো না। একদিকে বাড়াবাড়ি ছিল- সন্তান হত্যা করতে সেকালের লোকেরা কুন্ঠিত হতোনা। আর অপরদিকের বাড়াবাড়ি এই ছিল যে সন্তান সংখ্যার বিপুলতা নিয়ে তারা পারস্পরিক গৌরব ও ফখর করতো। ধনমাল আল্লাহর দেয়া আমানত, সন্ততি ও অনুরূপ আল্লাহর দান। প্রথমটা যেমন একটা পরীক্ষার বিষয়, দ্বিতীয়টিও তেমনি একটি পরীক্ষার সামগ্রী। ধন-সম্পদ অন্যায় পথে ব্যয় করলে যেমন আমানতের খিয়ানত হয়, সন্তান- সন্ততিকেও ভুল উদ্দেশ্যে ও অন্যায় কাজে নিয়োজিত করলে তেমনি আল্লাহর আমানতে খিয়ানত হবে। সন্তান সুস্থ গঠন ও অনুপম বেড়ে উঠার দায় দায়িত্বকে পিতা-মাতা কখনো খাটো করে দেখতে পারে না।
ভবিষ্যত সন্তানের জন্য সুস্থ ও গঠনমূলক চিন্তা আর অভিরুচি একটি আদর্শ দম্পতির পয়লা নম্বর শর্ত। ইসলাম এ বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে মানুষকে দিক নির্দেশ করে।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট