চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

সংশোধনে জনকাক্সিক্ষত উদ্যোগ নিন রাজাকারের তালিকায় অসঙ্গতি

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি প্রকৃত রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের জনদাবী দীর্ঘদিনের। কিন্তু এ ব্যাপারে কখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় বর্তমান সরকার রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এই উদ্যোগকে দেশবাসী বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জনগণ স্বাগত জানিয়েছিল। নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে দিতে বিষয়টির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সীমাহীন। তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকার স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করলেও তাতে রয়েছে নানা অসঙ্গতি। বিশেষ করে যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, লড়াই করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে; যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, তাদের নাম রাজাকারের তালিকায় ওঠায় রাজাকারের তালিকা নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। পাশাপাশি এ তালিকায় বিপুলসংখ্যক চিহ্নিত রাজাকারের নাম না থাকায় দেশব্যাপী অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এতে সরকারকে বিব্রত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিতর্কিত তালিকাটি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। এমন ত্রুটিপূর্ণ তালিকা তৈরীর পেছনে প্রশাসনিক গাফিলতি বা ষড়যন্ত্রকারীদের হাত ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন মহলের দাবির প্রেক্ষিতে সোমবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রায় ১১ হাজার রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে। তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকারের প্রথম তালিকায় এমন সব ব্যক্তির নাম এসেছে, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যদের নামও রয়েছে তালিকায়। অথচ তালিকায় নেই চিহ্নিত অনেক রাজাকারের নাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুর নামও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল, সেই কুখ্যাত রাজাকার-আলবদর ও শামছদের অনেকের নামই এ তালিকায় নেই। এতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, এই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই করা হয়নি। কথা বলা হয়নি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করে এমন গবেষক ও সংগঠনের কারো সঙ্গে। শুধু জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) তথ্যের ওপর নির্ভর করে এ তালিকা তৈরি উচিত হয়নি। এ ধরনের একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল আরো বেশি সতর্ক হওয়া। তালিকা তৈরির কাজে আমলাদের প্রাধান্য না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা বীরদের সার্বকক্ষণিকভাবে সংযুক্ত করা হলে এ সংকট তৈরি হতো না নিশ্চয়ই।

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে এসে শতভাগ সঠিকভাবে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং এবং জটিলও বটে। কারণ এতোবছর পরে অনেক রাজাকার এবং তাদের সন্তানেরা প্রশাসনের লোকদের হাত করে একাত্তরের কাগজপত্র নাই করে ফেলেছেন। আবার কেউ কেউ বোল পাল্টে ক্ষমতাসীন দলে অনপ্রবেশ করেছেন। ফলে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম যখন রাজাকারের তালিকায় চলে আসে তখন তা মেনে নেয়া যায় না। এর পেছনে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থাকার ব্যাপারে যে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে তা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানিদের তৈরি করা তালিকাই প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র। যাচাই-বাছাই করে ঠিক করা হবে। তিনি রাজাকার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, রাজাকারের তালিকায় ভুলভ্রান্তি বেশি হয়ে থাকলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে। দ্বিমতের সুযোগ নেই। তবে প্রকাশের আগে কেনো ভালো করে যাচাই-বাছাই করা হয়নি সে প্রশ্ন থেকেই যায়। জানা গেছে, তালিকাটি এসেছে একটি প্রশাসনিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। মাঠ পর্যায় হতে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে তালিকার সত্যাসত্য, বাস্তবতা যাচাই করা হলে এমন ত্রুটি নিশ্চয়ই হতো না। যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের দ্বারা যাচাই-বাছাই করে তালিকাটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়া হতো তাহলে এমন বিতর্কের সুযোগ থাকতো না। সংগতকারণে অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন না করার জন্যে তাদেরও জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় নেয়া দরকার।

কেন্দ্রীয় সম্মেলন ও মুজিববর্ষের প্রাক্কালে রাজাকারদের এমন বিতর্কিত তালিকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। এ নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের তৃতীয় প্রজন্মের মাঝে বিরূপ প্রভাব পড়ারও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি এ সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তবে সব বিবেচনায় রেখে সরকারের সঠিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ থাকলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে প্রকৃত রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ কঠিন হবে না। প্রসঙ্গত, রাজাকারের তালিকা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করার কথা রয়েছে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ। আরো একটি বছর হাতে আছে। এ সময়ের মধ্যেই সব ধরনের যাচাই-বাছাই করে তালিকাটি সঠিকভাবে তৈরি ও প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও রাজাকারের তালিকা নতুন করে যাচাই-বাছাই করে সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা আশা করতে চাই, ত্রুটিহীন রাজাকার তালিকা তৈরি ও প্রকাশে জনকাক্সিক্ষত উদ্যোগ নেবে সরকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট