চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

শব্দদূষণ : সচেতনতা ও প্রতিরোধ

জসিম উদ্দিন মাহমুদ

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

শব্দ যখন মানুষ বা জীবজন্তুর কাছে বিরক্তিকর ও ক্ষতিকরভাবে পৌঁছায় তখন সেই শব্দ দূষণের পর্যায়ে পৌঁছায়। শব্দদূষণের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুই ধরনের কারণই আছে। বাতাস, সাগর ও জীবজন্তুর শব্দের মতো বেশ কিছু প্রাকৃতিক উৎস আছে শব্দদূষণের। তবে যানবহন, কলখারখানা, ট্রেন, বিমান, মাইক এসবের মত মানুষের সৃষ্টি শব্দদূষণের উৎসগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এমন অনেক বিষয় আছে যা আইনত দ-নীয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নৈমিত্তিক ভিত্তিতে চর্চিত হওয়ার বদৌলতে তা সামাজিক কিংবা প্রশাসনিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয় না। দিনের পর দিন সেসব কাজ জনগণ নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। যখন-তখন লোকালয়ে মাইকে তীব্র আওয়াজ তুলে বক্তৃতা-ভাষণ দেওয়া কিংবা বাণিজ্যিক প্রচার চালানো সেই ধরনের একটি কাজ। সব ধরনের শব্দদূষণের ফলেই মানুষের ঘুম, শ্রবণশক্তি, মানসিক ও শারীরীক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। অথচ শব্দ দূষণের এই ক্ষতিকর অবস্থা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না, কিংবা জানলেও সচেতন হই না।

শব্দদূষণ এখন নগরীর জলজ্যন্ত সমস্যা এবং দিন দিন তা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। শব্দদূষণের ফলে প্রতিনিয়িত নগরবাসী আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে। তবে এসব রোগের প্রায় সবগুলোরই প্রতিক্রিয়া হঠাৎ না হয়ে দীর্ঘমেয়াদি হয় বলে মানুষ তৎক্ষণাৎ এর কুফল বুঝতে পারে না। তাই এদিকে সবার নজরও থাকে কম। শহরে এখন এমন জায়গা পাওয়া দুষ্কর যেখানে শব্দদূষণ নেই। গাড়ির হাইড্র্রোলিক হর্ন, মাইক্রোফোন বা কলকারখানার শব্দে শহরের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে সব সময়। আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- কোন কিছুই রেহাই পাচ্ছে না যানবাহনের হর্ন, কারখানার বিশৃঙ্খল উচ্চশব্দ, মাইক ও সিডি প্লেয়ারের উদ্দাম আওয়াজ থেকে। অবস্থা এমন হয়েছে নগরীকে এখন অভিহিত করা হয় দূষণের নগরী হিসেবে। কারণ দূষণমাত্রা মানুষের সহ্যসীমা অতিক্রম করেছে। যত্রতত্র যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো, মাইকের সাহায্যে বিজ্ঞাপন বা ঘোষণা, যন্ত্রপাতির আওয়াজ, লাউড স্পিকার, ইট ও পাথর ভাঙ্গার মেশিন, গ্রাইন্ডিং বা লেদ মেশিনে, প্রিন্টিং প্রেস, জেনারেটর ইত্যাদির আওয়াজ কোথায় নেই? সে হাসপাতালই হোক, আবাসিক এলাকাই হোক অথবা হোক না কোনো শিক্ষাঙ্গন বা ধর্মীয় উপাসনালয়। তবে এটা এখন পরীক্ষিত সত্য যে নগরীর শব্দদূষণের উৎসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে যানবাহনের হর্নের শব্দ। অনেক চালককে দেখা যায়, জ্যামে আটকে থেকেও অনবরত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, মাইকের আওয়াজের পাশাপাশি নগরীতে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার থেকে আসা শব্দ দূষণও কম নয়। এমনকি উঁচু ভলিউমের গান বাজনার শব্দও দূষণে রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ইদানিং নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে বিভিন্ন সমাবেশের নামে দীর্ঘদিন আগে থেকে মাইক বাজিয়ে ঘোষণা দেয়া। যা শব্দদূষণে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এসব মাইকিং এর কারণে অনেক সময় নাগরিকের কর্ম পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ উন্নত দেশগুলোতে হাজার লোকের সমাবেশে উচ্চ শব্দের মাইক ব্যবহার না করে মাউথ স্পিকারের মাধ্যমে বক্তৃতা দেওয়া হয়। মিছিলে উচ্চকণ্ঠে শোগান দিয়ে শব্দদূষণ না করে প্লাকার্ড বহন করা হয়। রেল স্টেশনগুলো এমনভাবে তৈরী, ইঞ্জিনের হর্ন ও শব্দ আবাসিক এলাকায় কোনো প্রভাব ফেলে না।

আর আমাদের দেশে হাসপাতালে যখন চিকিৎসা চলে তখন দেখা যায়, রাস্তায় মাইক দিয়ে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছে, মাইক দিয়ে গান বাজিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি করছে। রাতের বেলায় মানুষ যখন ঘুমোতে যাবে তখন ওপেন কনসার্ট, ওয়াজ মাহফিলের অনুষ্ঠানগুলো শুরু হয়। তাছাড়া এই মাহফিলগুলোতে দেখা যায় অনুষ্ঠানস্থল ছাড়াও অনেক এলাকাজুড়ে মাইক লাগানো হয়, এতে অসুস্থ ব্যক্তি থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়াসহ সর্বসাধারণের জীবনযাত্রায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। বিভিন্ন সমাবেশে, মাহফিলে কিছু বক্তা জ্ঞানগর্ভ আলোচনার চেয়ে চিৎকার চেঁচামেছি বেশি করেন। বক্তার বক্তৃতা শুনে মনে হয় যেন তিনি নিজেই ঝগড়া করছেন শ্রোতাদের সঙ্গে। বক্তার চিৎকারে মাইকের শব্দে প্রাণ যায় অবস্থা সর্বসাধারণের। যেন এসবের দেখার কেউ নেই।

বিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের শ্রবণযোগ্য শব্দ হলো ৪৫ ডেসিবল। কিন্তু এখানে শব্দের তীব্রতা কোন কোন ক্ষেত্রে ৮৫ ডেসিবল ছাড়িয়ে। শব্দদূষণ যে শুধু বিরক্ত সৃষ্টি করে তা-ই নয়, বিভিন্ন মাত্রার শব্দ ভিন্ন ভিন্ন শারীরীক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে, যেমন- ৩০-৩৫ ডেসিবল শব্দমাত্রায় নার্ভাসনেস ও ঘুমের ব্যাঘাত। ৬৫ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় হৃদরোগ। ৯০ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় আলসার, শ্রবণে ব্যাঘাত ও স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তন। ১২০ ডেসিবেলের ওপর শব্দ মাত্রায় শ্রবণযন্ত্রে ব্যথা এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে। এছাড়া শব্দদূষণের ফলে শারীরীক ও মানসিক দুই ধরনের সমস্যাই দেখা দেয়। এবং এটা হতে পারে স্থায়ী বা অস্থায়ী। হঠাৎ কোন উচ্চ শব্দে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে এবং সঙ্গে রক্তক্ষরণও হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে সরাসরি কানের অসুখ ছাড়াও বাড়তে পারে বাডপ্রেসার, দুশ্চিন্তা, উগ্রতা বা অ্যাগ্রেসিভনেস, কানে ভোঁ-ভোঁ শব্দ বা টিনিটাস, ঘুম কমে যাওয়া বা মানসিক অবসাদ, শিশুদের স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশে বাধা। উচ্চশব্দের উৎসের কাছে দীর্ঘদিন কাজ করলে একজন মানুষের শ্রবণক্ষমতা স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য শব্দদূষণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শব্দদূষণের কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জন্মগ্রহণ করতে পারে। সুন্দর, সুশৃঙ্খল পরিবেশ আমাদের সকলের কাম্য। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের ইরশাদ করেন, ‘এবং আল্লাহপাক সুন্দর সুশৃঙ্খলাকারীদেরকে পছন্দ করেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৪)। আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘জলে-স্থলে যে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি বিরাজ করছে তা মানুষেরই হাতের কামাই, তাদের কর্মের কোন কোনটির শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রূম, আয়াত ৪১)।
এখন প্রশ্ন হলো, এ সমস্যার সমাধান কী? যথার্থ কারণ ছাড়া যত্রতত্র মাইক বাজানো, গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজিয়ে অনুষ্ঠান করা, উচ্চশব্দে ক্যাসেট প্লেয়ার বাজানো- এগুলো বন্ধ করতে হবে।

রাস্তায় অতিরিক্ত পুরোনো গাড়ির চলাচল বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যানবাহনের হর্ন বাজানো কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে এবং হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবাসিক এলাকায় যাতে কলকারখানা গড়ে উঠতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, শব্দদূষণ সৃষ্টির উৎস অনেক এবং অনেক ধরনের। তাই শুধু আইন তৈরী ও আইন প্রয়োগ করে শব্দদূষণ নির্মূল করা কটিন। প্রয়োজন শব্দদূষণের বিপদ সম্পর্কে সকলের সচেতন হওয়া। আর জনগোষ্ঠীর যে ক্ষুদ্র অংশ এসব বিষয়ে সচেতন তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সচেতনতার সঙ্গে অন্যদের সম্পৃক্ত করা। বিকেল তিনটা হতে রাত আটটার মধ্যে সকল প্রকার সভা-সমাবেশ, মাইকিং সীমাবদ্ধ করা এবং সর্বোপরি শব্দদূষণ প্রতিরোধে রাষ্ট্রের তথা সরকারের ভূমিকা আরো জোরদার করা।

জসিম উদ্দীন মাহমুদ কথাসাহিত্যিক, ইসলামি চিন্তক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট