চট্টগ্রাম শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪

সমন্বয়হীন উন্নয়নকর্ম, বায়ুদূষণ ও জনদুর্ভোগ

জহিরুদ্দীন মো. ইমরুল কায়েস

৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:১৩ পূর্বাহ্ণ

গত কয়েকমাস যাবৎ চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাটে জনযন্ত্রণা অব্যাহত আছে। বিশেষ করে ওয়াসার পাইপ লাইন সংস্থাপনের জন্যে চট্টগ্রাম শহরের বেশীরভাগ রোডের অবস্থা মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। ‘এক শরীরকে কতবার অস্ত্রোপচার করা যায়’ এমন প্রবাদবাক্যের ন্যায় একই রাস্তাকে কয়বার খুড়ঁতে হয় সে প্রশ্নও সামনে এসছে। এই চট্টগ্রাম শহরের একই রাস্তাকে কতোবার কাটাকাটি হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। এই কাটাছেঁড়া করতে করতে চট্টগ্রামবাসীর নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। মূল রাস্তাসহ সকল অলিগলির রাস্তা বর্তমানে নাজুক অবস্থার মধ্যে বিরাজমান।

রাস্তাঘাটের এরকম বেহাল অবস্থা নিকট অতীতে দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম শহরে এমনিতেই আছে ট্রাফিক জ্যামের বাতিক। তার উপরে রাস্তার কাটাছেঁড়াতে ট্রাফিক জ্যামের অবস্থা আরো প্রবল আকার ধারণ করেছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে একই রাস্তা বারংবার কাটতে হয়। একই রোড কিছুদিন ওয়াসা কাটে, কিছুদিন পর বিটিসিএল কিছুদিন পর গণপূর্ত বিভাগ আর কিছুদিন পর কাটে অন্যকোন সংস্থা। মাস দশেক আগে সিটি কর্পোরেশনের টানা রাস্তাসংস্কারের কার্যক্রমের ফলে চট্টগ্রাম শহরের সড়কগুলো বেশ একটা মানে পৌঁছেছিল। কিন্তু বিগত কিছুমাস ধরে ওয়াসার টানা খোঁড়াখুঁড়িতে রাস্তাঘাটগুলো আবারো নাজুক অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। নাগরিকের জন্য পানি যেভাবে দরকার সেভাবে মানসম্মত রাস্তাঘাটেরও প্রয়োজন। ওয়াসার কাজ চলছে তো চলছেই। কাজ যেন আর শেষ হতে চায় না। সারা পৃথিবীর কোথাও কোনো শহরে এভাবে মাসের পর মাস রাস্তা কাটাকাটির কোন উদাহরণ আছে বলে মনে হয় না। একটা রাস্তাকে ধরে সেই রাস্তার কাজ পরিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করে অন্য রাস্তা ধরলে কাজের একটা লাইন থাকে। এখন অনেকগুলো রাস্তায় একসাথে ওয়াসার পাইপ লাইন বসাতে গিয়ে পুরো চট্টগ্রাম শহররেই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মাসের উপরে বন্ধ থাকছে। কোন বিকল্প পথ সৃষ্টি না করেই মূল রাস্তা কেটে ফেলা হয়। আমরা যাই করি না কেন- নগরজীবনের নাগরিকের স্বাভাবিক চলাফেলার রাস্তাকে এভাবে অবহেলা করতে পারি না।

এভাবে ধৈর্য্য ধরতে ধরতে নাগরিক জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা যেন আর শেষ হয় না। কাটাকাটির পরে রাস্তা যেভাবে সংস্কার সাধন হয় সেখানেও থাকে নানান সমস্যা। সংস্কার সাধনের পর রাস্তাগুলো থাকে উঁচুনিচু। রিকশাতো বটেই অন্যান্য গাড়ী চলাচলের সময়েও গাড়ীর হেলানিদুলানিতে কচিকাঁচা বাচ্চা আর বয়োজৈষ্ঠ্যদের সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়।

রাস্তাকাটার অংশে পরিপূর্ণভাবে পিচ না থাকার কারণে রাস্তার কাঁচা অংশ থেকে প্রচুর পরিমাণে ধূলাবালি উড়তে থাকে। পথচারী কিংবা গাড়ীর যাত্রী কিংবা বসতবাড়ীর লোকজন সরাসরি এই বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে। এ শীতকালে ধূলাবালির পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এ ধুলোবালিতে কোথাও কোথাও এসপিএমের মাত্রা ৬০০-৭০০ ছাড়িয়েছে। তাছাড়া এ ধূলাবালির জন্য রাস্তা সংস্কারের বিভিন্ন উপকরণও কম দায়ী নয়। মাসের পর মাস ইট, কংকর, বালী, পাথরসহ অন্যান্য উপকরণগুলো রাস্তার উপরই পড়ে থাকে। গাড়ী চলাচলের সময় এসমস্ত উপকরণ থেকে সৃষ্ট ধূলাবালিতে চট্টগ্রাম নগরীকে এক বিশ্রী অবস্থার মধ্যে নিপতিত করেছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ির কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণও বেড়েছে। বর্ষাকালে পানির সাথে পিচ উঠে গিয়ে রাস্তার অবস্থাকে পীড়িত করেছে।

সবুজে, সৌন্দর্য্য,ে রাস্তাঘাটের শৃঙ্খলায় চট্টগ্রাম নগরী রাজধানী থেকে সবসময় এগিয়ে ছিল। কিন্তু দিন যত অতিবাহিত হচ্ছে ততবেশী আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। একটি পরিপূর্ণ সড়ককে যখন কাটাকাটি করা হয় তখন যতই জোড়াতালি লাগিয়ে সংস্কার করা হোক না কেন তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুব কষ্টকর। বর্তমানে বহদ্দারহাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত মূল রোডটি বাদ দিলে এর সংস্পর্শিত সকল রোডগুলো গাড়ী চলাচলের অযোগ্য। বছরখানেক ধরে বারিক বিল্ডিং থেকে কদমতলী পর্যন্ত রোডটির অবস্থাও তথৈবচ। নিউমার্কেট এবং তৎসংলগ্ন রাস্তাগুলোর অবস্থা ফ্যাকাশে। একটি শহরের সৌন্দর্য এবং তার রাস্তাঘাট দেশ-বিদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আমাদের চট্টগ্রাম শহরের বেশিরভাগ রাস্তাই একটি আদর্শ শহরের রাস্তাঘাটের ন্যায় মোটেই পরিপাটি নয়। এমনিতেই প্লাস্টিক এবং অন্যান্য ময়লাতে সয়লাব পুরো চট্টগ্রামের পরিবেশ। তার উপরে বাছবিচারে না গিয়ে যেখানে সেখানে রাস্তাঘাট কেঁটে ফেলায় নাগরিক জীবনে দুঃসহ যন্ত্রণার যেন শেষ নেই। রাস্তাকাটার মাটিগুলো সরাসরি রাস্তায় বা মাটিতে না রেখে যদি তেরপলের উপর রাখা হতো এবং ভারী তেরপল দিয়ে যুৎসইভাবে ঢেকে দেওয়া হতো, তাহলে মনে হয় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বৃষ্টির সময়েও পানির সাথে বালি মাটি মিশে নালা-নর্দমাকে বন্ধ করে দিতো না। ধূলা-বালির উপর পানি ছিটিয়ে ক্ষণিকের পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হলেও আধাঘণ্টা পরেই সে বালিগুলো গাড়ির চাকার সাথে আবার উড়া শুরু করে। বুঝে না বুঝে যারা ঐ ধূলোবালি উড়ানোর জন্য দায়ী পরোক্ষভাবে তারা তাদের পরিবারের স্বাস্থ্যহানীর জন্যও দায়ী। উন্নয়ন সবার কাছেই প্রত্যাশিত। কিন্তু উন্নয়ন কাজ করতে গিয়ে পরিবেশের বিষয়ে এভাবে উদাসীন থাকা কোনভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাই সকল নাগরিকের লক্ষ্য। একসময় প্লাস্টিকের বোতলে মিনারেল ওয়াটার বাজারজাত করণ দেখে আমাদের কৌতুহলের অন্ত ছিল না। এখন রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় অনেকের মুখে মাস্ক দেখা যায়। ভবিষ্যতে হয়তো মাস্কও আর যথেষ্ট হবে না।

চট্টগ্রাম শহরের বাতাস তথা দেশের বাতাসকে আমরা যেভাবে বিষিয়ে তুলছি এবং এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের হয়তো মাস্কের পরিবর্তে অক্সিজেনের বোতল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। ভারতের দিল্লী শহরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণের জন্য ‘অক্সিজেন বার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে মাত্র ১৫ মিনিটের বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণের জন্য ২৯৯ রুপি প্রদান করতে হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের দেশেও হয়তো খাবারের রেস্টুরেন্টের মতো পিউর অক্সিজেন বার চালু করতে হবে। আসুন, অনেক হয়েছে। বায়ুকে আমরা তিলে তিলে এভাবে ধ্বংস করতে পারি না। বেঁচে থাকার জন্যই আমাদেরকে বায়ুদূষণ বন্ধ করতে হবে। না হয় প্রকৃতিকে আমরা যতটুকু দূষণ করছি প্রকৃতিও ততটুকু মাত্রায় আমাদের শরীরকে দূষিত করবে। এর থেকে কারো নিস্তার নাই।

জহিরুদ্দীন মো. ইমরুল কায়েস কলামিস্ট, পরিবেশকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট