চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তরিক্বতের তরতীব

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ১:২৮ পূর্বাহ্ণ

তরিক্বত তথা সুফিজম তথা আধ্যাতিœক জগতে প্রবেশ করতে এবং প্রবেশ করলে নিয়ম নীতি অর্থাৎ তরতীব মেনে চলা অত্যাবশক। তরিক্বত/সুফিজম স্পর্শকাতর বা সুক্ষè বিষয়। নিজের পীর ক্রম অনুযায়ী যেতে যেতে নবী পাক (স.)’র হাতে বায়াত তথা মুরিদ করা হয় হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। ফলে তরিক্বতে সজরা অপরিহার্য। বিশ্বে অনেক তরিক্বত আছে; তৎমধ্যে ৭ টির প্রাধান্য বেশি। এ সাত তরিক্বকার মধ্যে চার তরিক্বার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। অর্থাৎ ১.কাদেরিয়া ২.চিশতিয়া ৩.নক্শবন্দিয়া ৪.মুজাদ্দেদীয়া। বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষে এ চার তরিক্বার প্রাধান্য রয়েছে।
উম্মতে মুহাম্মদীর দৃষ্টিতে তরিক্বতের উৎপত্তি গারে হেরা থেকে। নবী পাক (স.) গারে হেরা তথা জবলে নূরে আল্লাহ পাকের ধ্যানে ছিলেন। সে হতে সুফিজমের উৎপত্তি বলে বিশ্বখ্যাত মহান ইমামগণ যুগে যুগে বলে গেছেন।

সুফি শব্দটার উৎপত্তি নিয়ে জ্ঞানীবর্গের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কোন কোন সাধক মত প্রকাশ করেছেন, আরবি ভাষায় “সাফা” (পবিত্র) শব্দ থেকে সুফি শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে। অনেকে মনে করেন নবী পাক (স.)’র যামানায় ‘আসহাবুসসোফ্ফা’ নামে পরিচিত সাধকগণের সহিত সুফি শব্দের সম্পর্ক রয়েছে। তৃতীয় আরেক মতে আরবি ‘সুফ’ (পশম) শব্দ থেকে সুফি শব্দের উৎপত্তি। যেহেতু সে যুগে সাধকগণ পার্থিব ভোগ বিলাস ত্যাগ ও স্বেচ্ছা দারিদ্র্যের নিদর্শন স্বরূপ মোটা পশমী বস্ত্র পরিধান করতেন। পরবর্তীতে এ পোশাকই তাদের বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়। লাহোরে শায়িত হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) তাঁর রচিত বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ “কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থে অনুরূপ অভিমতেরই প্রতিধ্বনি করেছেন।

নবী পাক (স.)’র আমলে কতেক সাহাবায়ে কেরাম দরিদ্রতা ও কৃচ্ছতা সাধনের পথ অবলম্বন করে জীবন যাপন করেছিলেন। তৎমধ্যে ‘আসহাবুসসোফ্ফা’ এর সাধকগণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সমস্ত মহান সাহাবায়ে কেরাম ঘর সংসার পরিত্যাগ করে মসজিদে নববীর পার্শ্বে অবস্থিত হুজরায় এসে অবস্থান করেছিলেন। নীরবে আল্লাহর এবাদত করা, নবী পাক (স.)’র চরিত্রের আলোকে নিজেদের ব্যক্তিজীবনকে গড়ে তোলার প্রয়াস এবং কুরআন হাদীসের অনুশীলনেই তারা নিয়োজিত থাকতেন। কোন প্রকার কার্যকলাপের সঙ্গেই তাদের কোন প্রকার সম্পর্ক ছিল না। লজ্জা নিবারনের জন্য একান্ত অপিরহার্য অতি সামান্য বস্ত্র ব্যবহার করতেন। চরম দরিদ্রতাকে তাঁরা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছিলেন।
ইবনে খলদুন তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থের মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন, প্রাচীনকালীন মুসলমানেরা এবং তাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে নবী পাক (স.)’র সাহাবা, তাবেয়িন,তবে-তাবেয়িন সুফি মতবাদকে সত্য ও মুক্তির পথ বলে মনে করতেন। গভীর নিষ্ঠার সহিত আল্লাহর উপর নির্ভর করা,সর্বস্ব ত্যাগ, পার্থিব জাঁকজমক ভোগ বিলাস, আমোদ-আহলাদ, ঐশ্বর্য্য ও ক্ষমতা প্রভৃতি যা কিছু মানুষের কার্য তা সবই ত্যাগ করে নির্জনে আল্লাহর আরাধনায় নিয়োজিত থাকাই হল সুফি মতবাদের মৌলিক নীতি। সাহাবাগণ ও প্রথম যুগের মুসলমানগণ এ নীতি সমর্থন করতেন।
বিগত প্রায় ১৪০০ বছরের ধারাবাহিকতায় সুফিজম তথা তরিক্বত বলতে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসকে পরিহার করে পরকালে কল্যাণ পেতে তাড়িত হয়ে তটস্থ থাকা হত। যেমনি নিজের পীর শেখ তেমনি তাঁর মুরিদ শিষ্যগণ।কিন্তু বিগত ৩০/৪০ বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৯৮০/১৯৯০ এর দশক থেকে বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষে তরিক্বতের জগত ভিন্নতারূপ লাভ করে। যেহেতু এ বিগত ৩০/৪০ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ভারতবর্ষ পেরিয়ে বিশ্বে বিজ্ঞানীর যুগ, ডিজিটাল যুগে মানবেরজীবন প্রবাহ চলছে। বিগত ১৪০০ বছরের ব্যবধানে নতুনভাবে ভিন্নধারায় রূপ লাভ করে। এর বিরূপ প্রভাব এসে পড়ে তরিক্বতে সুফিজমে। ফলে একালে তরিক্বতে দাখিল হতে ভাবতে হবে, যেহেতু দেশে ভন্ড পীরের ছড়াছড়ি।

শরীয়ত বাদ দিয়ে তরিক্বত নয়। যে পীরের কাছে শরীয়ত দুর্বল তিনি সঠিক পীর হতে পারে না, ভন্ড পীরের পর্যায়ে পড়ে। কারও একক কথায় পরামর্শে তরিক্বতে না আসা চাই। ব্যাপক পরামর্শে নিজ থেকে গভীর বিবেচনায় রেখে, এস্তেখারা করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে পীরের নিকট তরিক্বতে দাখিল হওয়া আবশ্যক। যেহেতু পীর নির্ণয় করার পর আমৃত্যু পীরের আনুগত্যে থাকতে হবে। এখানে অন্যতার কোন সুযোগ নেই।
নবী পাক (স.)’র পর পিতা-মাতা, অতঃপর নিজের পীর। পীরের সম্মান পিতা-মাতার পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে মনে করতে হবে। আমৃত্যু থাকতে হবে আনুগত্যে। পীরের ইন্তেকালের পর তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি মনের গভীর থেকে সর্বোচ্চ সম্মান রাখতে হবে। দেশে এমন পীরের সংখ্যা কম নয়, যারা নিজের মুরিদকে অন্যখানে যেতে কঠোর নিষেধ করে। হয়ত বা মুরিদ নিজ থেকে ছুটে যায় না কি? একালে যেমন ভন্ড পীরের ছড়াছড়ি তেমনি আহলে হাদীস পন্থিরা তরিক্বতের বিরুদ্ধে নানা কিছু বলছে। যা আগে তেমন ছিল না। একালে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রে সম্মানিত অধিকাংশ আলেম তরিক্বতকে অপছন্দ করে।

দৈনন্দিন আমল ছাড়া ধ্যান/মোরাকাবা ছাড়া কিভাবে তরিক্বত হয় বুঝে আসে না। দৈনন্দিন তরিক্বতের আমলত বটেই, এশার নামাজের পর নবী পাক (স.)’র শানে দরূদ শরীফ পড়া অপরিহার্য। যা কম করে হলেও ৫০০/৭০০/৯০০/১৫০০ বার বা আরও বেশি। প্রত্যেক তরিক্বতে ভিন্ন ভিন্ন দরূদ শরীফ রয়েছে। ফজর মাগরিব তো বটেই এশারের নামাজের পর দরূদ শরীফ পড়ার আমল না থাকলে তরিক্বতে থাকা হবে কিভাবে বুঝে আসে না। এমনিতেই তরিক্বতে না থাকলেও উম্মতে মুহাম্মদী নর-নারী এশার নামাজের পর দৈনিক দরূদ শরীফ পড়ার আমল থাকা চাই।
তরিক্বতের তরতীবে ডেকোরাম মানতে হবে। যেহেতু আদব-কায়দাও তরিক্বতের অঙ্গ। নিজের পীরের ভ্রাতা, পীরের পীর ভাই, এদেরকে চাচা সমতুল্য সম্মান দেখাতে হবে। নিজের পীর ভাইগণের মধ্যে সিনিয়র জুনিয়র ব্যবধানের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। থাকতে হবে আদব-কায়দা। এমনিতে আদব-কায়দা তথা ব্যবহারে উচ্চবংশের বলে প্রতীয়মান হয়। তরিক্বত এ আদব-কায়দা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তরিক্বতে নারীর পর্দা খুবই কঠোরভাবে পালন করতে হবে। যে পীরের নিকট বা আশেপাশে শরীয়তের কঠোরতা নেই, মহিলাগণের পর্দায় শীতলতা দেখা যায়, এ সমস্ত পীরগণ থেকে বহু বহু দূরে থাকতে হবে।
কঠোর শরীয়তপন্থী হক্কানী পীরের হাতে মুরিদ হতে পারা সৌভাগ্যের বিষয়। ইতস্তত হলে মন থেকে সহজে সায় না আসলে মুরিদ না হওয়া চাই। এতে আল্লাহর রাসূল (স.) উম্মত হিসেবে এশারের নামাজের পর যত বেশি সম্ভব দরূদ শরীফ পড়ার আমল দৈনিক আমল হিসেবে পালন করতে সচেষ্ট থাকা অত্যাবশ্যক।
আগেকার আমলে মহান অলিগণ এক-এক তরিক্বায় এক-একজনের কাছে মুরিদ হতেন, খেলাফত প্রাপ্ত হতেন। যেমন চিশতিয়া তরিক্বায় একজনের নিকট। মুজাদ্দেদীয়া তরিক্বায় আরেকজনের নিকট। বর্তমানে সে অবস্থা আছে মনে করি না।

অপরদিকে, হক্কানী পীরের নিকট মুরিদ হয়ে সুফিজম তথা তরিক্বত থেকে সরে আসলে তার কিন্তু খবর আছে। না বুঝে ভ- পীরের কাছে গেলে ফিরে আসা কল্যাণকর। কিন্তু সুফিজম,তরিক্বত হক সিলসিলা। অতএব পীর নির্ণয় করার পর আমৃত্যু আনুগত্য থাকতে হবে, সরে আসার কোন সুযোগ নেই।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য একালে তরিক্বতে পীরের নিকট পীরের ঘর-বাড়িতে, তরিক্বতের জংশনে নারীর বিচরণ অনেকাংশে বেড়ে গেছে যা তরিক্বত কলুষিত পরিবেশের আর্বিভাব। দুনিয়া কমানোর জন্য তরিক্বতকে কলুষিত করা, ধ্বংস করা। এ সব ভ- পীর থেকে বহু দূরে থাকা চাই। নারীর পর্দা লংঘন করে তরিক্বত নয়-ই ধর্ম হতে পারে না।
আগেই উল্লেখ করেছি এশারের নামাজের পর পর দরুদ শরীফ, ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর কুরআন শরীফের সূরার আয়াত ও দরুদ শরীফের বাধ্যতামূলক আমল না থাকলে তরিক্বত কি করে হয় বুঝে আসে না।
গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর (রহ.) তাঁর ৭৭ বছরের এক বৃদ্ধ মুরিদ কথা প্রসঙ্গে বলেন, তথা আমারও পীর ছাহেব বলে গেছেন ,“যে তরিক্বতে দাখিল হয়ে অজীফা পড়বে না, সে গরীব হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, পাগল হয়ে যাওয়ার সমূহসম্ভবনা।” এ প্রসঙ্গে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর (রহ.)’র ৭৯ বছরের আরেক বৃদ্ধ বলেন,“হযরত বড় হুজুর কেবলার লক্ষ লক্ষ মুরিদ। প্রায় সকলে ইন্তেকাল করে গেছেন। হাতেগুনা ক’জন বেঁচে আছেন মাত্র। তার ধারণা তথা আন্দাজ মতে, গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর (রহ.)’র মুরিদগণের মধ্যে শতকরা একজনও থাকবে বলা যাবে না, যিনি তরক্বিতে দাখিল হয়ে অজীফা পড়তেন না।”

গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার পাশাপাশি আজমগড়ী হযরতের অপর দুই মহান খলিফা হযরত শাহ আবদুস সালাম আরকানী ও হযরত শাহ হাফেজ মুনীর উদ্দিন হালিশহর (রহ.) বলে গেছেন, তরিক্বতে দাখিল হয়ে অজীফা ছেড়ে দিলে ঈমান নিয়ে যেতে পারবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
মহান অলি পীর বুযুর্গগণের পরবর্তী সন্তান-সন্ততি, নাতি নাতনীগণের মধ্যে শরীয়তের শীতলতা, নারীগণের পর্দার প্রতি অবহেলা একালে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে তাদের প্রতি সম্মান রেখে আনুগত্য থেকে দূরে থাকতে হবে। অপরদিকে, তাদের কারণে তাদেরই পিতা-দাদা বা তার উপরে মহান অলি পীরগণের প্রতি ন্যূনতম অশ্রদ্ধাবোধ আসতে পারবে না।

বস্তুতঃ হক্কানী পীরের নিকট তরিক্বতে দাখিল হতে পারাটা জীবনে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু পীর নির্র্ণয় করতে অব্যশই ভাবতে হবে। তিনি শরীয়তের পাবন্দ, তাকওয়া, পরহেজগারী ব্যক্তিত্ব কি না। আরও ভাবতে হবে তাঁর কাছে যে সব ব্যক্তিগণ আসা যাওয়া করতেছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ শরীয়তের পাবন্দ জ্ঞানী গুণী কি না? দৈনন্দিন তরিক্বতে দরূদ শরীফ, কুরআন শরীফের আয়াতের আমল আছে কিনা তাও ভাবতে হবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো ভেবে চিন্তে তবেই পীরের নিকট তরিক্বতে দাখিল হয়ে সৌভাগ্যবান হওয়া যাবে,অন্যথায় নয়।

পীরের নিকট তরিক্বতে দাখিল হয়ে আমৃত্যু আনুগত্য থাকতে হবে। এ আনুগত্যের বিষয়ে রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনা।
নিজের জীবদ্দশায় পীর ছাহেব ইন্তেকাল করলে মুরিদ আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন। তবে পীরের সন্তান-সন্ততি, পরিবারবর্গ তাকওয়া পরহেজগারীতে জ্ঞানে-গুণে যে প্রকারে থাকুক না কেন তাদের প্রতি মনের গভীর থেকে সম্মান রাখাটা কর্তব্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট