চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

কলঙ্কময় জেলহত্যা দিবস

মো. আবদুর রহিম

৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:২৩ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম.মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান হত্যাকা- বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলংকময় ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিমর্মভাবে হত্যার পর একই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য এম. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে। এ দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলংকময় ও বেদনাবিধুর দিন। ঘটনার পর দিনই ৪ নভেম্বর ১৯৭৫ তৎকালিন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) আবদুল আউয়াল ঢাকার লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

ঐ মামলায় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনা সদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। গুলি করে নেতাদের হত্যা করা হয়। পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। দীর্ঘ প্রায় ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত ঐ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পলাতক আসামি রিসালদার (ক্যাপ্টেন) মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদ-াদেশ এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেয়া হয়। একই মামলায় সাবেক মন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেয়া হয়। এরপর বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ায় ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে এর বিচারকাজ শেষ হয়। কী দোষ করেছিলেন জাতীয় চারনেতারা? এ প্রশ্নের জবাব আজো জাতি জানতে চায়। সেই দিন আমরা দেশবাসীও সোচ্চার হয়ে এ প্রশ্ন করিনি এবং তার জবাব চাইনি। এ বিষয়গুলো ছিল লজ্জার বিষয়-গণতন্ত্রের সমর্থকরূপে প্রশংসিত নাগরিকদের কর্তব্যকর্মে চরম উদাসীন্য ও অবহেলার প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা নৃশংস হত্যাকা-ের পর দীর্ঘ ২১ বছর জেল হত্যার বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে। ৮ বছরের বেশি সময় বিচার কাজ চলার পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর এ মামলার রায় ঘোষণা হয়।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে যাঁরা সমগ্র জাতিকে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব তাঁদের শহীদ হতে হলো স্বাধীন বাংলার মাটিতে। সেই দিনের খুনীদের ধারণা ছিল বন্ধুকের নল দেখিয়ে এসব দুস্কর্মে জাতীয় নেতাদের সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব হবে। সেই উদ্দেশ্যে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় শপথ নেয়ার জন্য নেতৃবৃন্দকে প্রথম পর্যায়ে বঙ্গভবনে আনা হয়। কিন্তু চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘকালের সঙ্গী ও মুজিবের বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনের সহচর। এসব নির্ভীক বীর নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধকালে জাতির পিতার অনুপস্থিতিতে জাতিকে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব, গঠন করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। সেই সময় জীবন-মৃত্যু ছিল যাঁদের পায়ের ভূত্য সঙ্গীনে তাদের ভয় দেখানো যায় না। স্বাভাবিকভাবে চার নেতাই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর কোন রকম অভিযোগ ছাড়াই নেতৃবৃন্দকে আটক রাখা হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। কাপুরুষের দল বুঝে গেল অতীতের মতো ভবিষ্যতেও এসব নেতাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ শেষ করবেন। তাদের মধ্যে এমন একটি আতংক দেখা যায় যে, চারনেতা জনতাকে ডাক দিলে আবার একাট্টা হবে মানুষ। জেলের সেলে বন্দি জাতীয় চার নেতারা বরাবরের মতো এশার নামাজ আদায় করে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ৩ নভেম্বর সেই মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সশস্ত্র হায়েনার দলটি প্রবেশ করল জেলখানায়। এরপর পাগলা ঘণ্টা বজিয়ে একটা চরম অরাজক ও সন্ত্রাসময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তারা সেল থেকে টেনে আনে শ্রদ্ধেয় নেতাদের। হত্যাকা-ের সুরতহাল রিপোর্টে জানা যায় গুলির পর গুলি চালিয়েও শান্ত হয়নি ঘাতকদল। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিশ্চিত করেছিল জাতীয় নেতাদের মৃত্যু। স্বাধীনতার শত্রু দেশদ্রোহী প্রতিবিপ্লবীরা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সক্রিয়।

আজোও তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এখন প্রায়ই ভাবি-জাতির পিতা ও জেল হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে এবং কুখ্যাত বহু যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে মহান মুক্তিযুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ প্রজন্ম পরম্পরায় উচ্চারিত হচ্ছে। তরুণ-কিশোর আবালবৃদ্ধ দৃপ্ত কণ্ঠে সগৌরবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত। ১৯৭৫ এর পর দীর্ঘ ২১ বছর ছিল ভাবনার অতীত। অগণিত বাঙালির রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটেছে। দেশবাসীর কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রের অক্লান্ত সংগ্রামে অদম্য সাহস আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যে নতুন নতুন নজির স্থাপন করে চলেছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

পরিশেষে বলবো, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান আদর্শবাদী দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু’র নেতৃত্বের প্রতি দৃঢ় আস্থা ছিল তাদের আমৃত্যু।
তাই কখনও কোন দমন পীড়ন বা ভয়ভীতির কাছে তারা নতি স্বীকার করেননি। ঘাতকের নির্মম বুলেট ও বেয়নেট হয়ত তাদের জীবনের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে কিন্তু তাদের সততা, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধু’র আদর্শের প্রেমকে তারা হত্যা করতে পারেনি। যতদিন পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ ও বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন জাতীয় বীরদের মানুষ স্মরণে রাখবে। বর্তমান প্রজন্ম ও আগামী প্রজন্ম চার জাতীয় বীরদের আত্মদানকে স্মরণে বরণ করলেই দেশ ও জাতির সুনাম ও সুখ্যাত আরো শানিত হবে।

মো. আবদুর রহিম সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট