চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

ইতিহাসের কালো অধ্যায় নভেম্বর ট্র্যাজেডি

শাহিদা আক্তার জাহান

৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:২৩ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে বাঙালি জাতির মতো গর্বিত জাতি খুবই কম পাওয়া যাবে। যে জাতির নিজের ভাষার মর্যাদা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার জন্য আত্নত্যাগের তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত গড়ে ওঠেছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মূলনীতির উপর। রাষ্ট্রের এ চার নীতিই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে মৌলিকভাবে পৃথক করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান থেকে। আবার স্বাধীন এই বীর বাঙালির আত্মবিস্মৃতি, ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞা এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের দায় অনেক সময় গোটা জাতিকেই বহন করতে হয়েছে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্মম হত্যাকা-ের পর বাংলার ইতিহাসে ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের এর মতো বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংস হত্যার এমন নজির বাংলার ইতিহাসে আর নাই। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যাতে বাংলাদেশে পুনরায় আসতে না পারে, সে হিসেবে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকাবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট আর ৩ নভেম্বরের হত্যাকা- একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করেন গবেষকগণ ও ইতিহাসবিদগণ।

৩ নভেম্বরের এই হত্যাকা- বাঙালি জাতির ইতিহাসে আরেকটি বেদনাবিধুর দিন, কলঙ্কিত অধ্যায় ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন, স্বল্প সময়ে সংবিধান প্রণয়ন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন সবকিছু সম্পন্ন হয়েছিল মাত্র তিন বছরে। তারপরও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র এই নতুন রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার জন্য দেশের অভ্যন্তরে উগ্র বামপন্থীরা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার নকশা প্রণয়ন করেছিলেন।

ভয়াল-বীভৎস ৩ নভেম্বর ১৯৭৫। রক্তক্ষরা জেলহত্যা দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের যে কয়টি দিন চিরকাল কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি ৩ নভেম্বর। বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরীণ জাতির চার মহান সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ঘনিষ্ঠ সহচর; জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যেখানে কারাগার-ই নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা সেখানে এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর রক্তাক্ত অধ্যায়ে মানবতার শত্রু ও বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ওই একই পরাজিত শক্তির দোসর বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। ২৩ আগস্ট মোশতাক বাংলার গর্বিত চার সন্তানকে গ্রেফতার করেন। পরের দিন ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে অপসারণ করে এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩০ আগস্ট এক সরকারী আদেশে সকল রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামীলীগের বলিষ্ঠ নেতা জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, গাজি গোলাম মোস্তফা, এম এ জলিল, এম মতিউর রহমান, এম এ মান্নান আমজাদ হোসেন, নুরুল হক, শামসুদ্দোহা সহ অসংখ্য নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হয় এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের নামে নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়। তখন অনেক নেতা-কর্মী আশ্রয় নেন ভারতে। ক্ষমতা দখল করে খুনি চক্র এ সময় বন্দুকের জোরে বিভিন্ন অধ্যাদেশ জারি করতে শুরু করে, আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষায় ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ অধ্যাদেশ জারি করেন। এ অধ্যাদেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া।

দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সাল আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এ হত্যাকা-ের বিচার কাজ শুরু করেন। ২১ বছর পর জেল হত্যার দলিল উদ্ধার করা হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলের স্তূপে চাপা পড়েছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সাল বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে, অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফাইলটি উদ্ধার করা হয়। এতে দেখা যায় কুখ্যাত বাংলার মীরজাফর খন্দকার মোশতাক ও মেজর রশিদ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার সরাসরি নির্দেশ দেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালিন আইজি প্রিজন নুরজ্জামানের লিখিত রিপোর্ট থেকে এ তথ্য প্রমাণ পায়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা এ দেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি, পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ’৭১-র প্রতি বিল্পব ঘটায় ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর। স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় সেই চক্রান্ত করে স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনরায় পাকিস্তান পরিণত করতে চেয়েছিল। ঘাতকরা চেয়েছিল এদেশ যেন কোনদিন স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেই ষড়যন্ত্র থেকেই নিরাপদ স্থান জেলখানার অভ্যন্তরে এই হত্যাকা- হয়। ঘাতক চক্রের লক্ষ্য ছিলো বাঙালিকে নেতৃত্ব শূন্য করে মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে আটক করে রাখার পর যে চার নেতা বঙ্গবন্ধুর হয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন সেই চার নেতাকেও বঙ্গবন্ধুর মতো নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের চরম নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হচ্ছে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস। বঙ্গবন্ধু ও এই চার নেতাকে হত্যা করে আওয়ামীলীগকেই হত্যা করতে চেয়েছিল স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। তবুও সত্যের কল আজন্ম উড়ে বীরদর্পে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন বলে তার নেতৃত্বে অসংখ্য অর্জন, জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। এসডিজি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। স্বাধীনতার মহান স্থপিত জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ একান্ত সহচর ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক জাতীয় চার নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। ওরাই এই বাংলার বীর সন্তান, দিগন্ত প্রান্তর মুখরিত তোমাদের রক্তে গাঁথা বীরেত্বের ইতিহাস। তোমারা আসবে প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারী মিছিলে সভায়। নতুন প্রজন্মের কাছে তোমরা উদ্ভাসিত স্বমহিমায়। তোমারাই শহিদ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যুহীন চির অম্লান চির ভাস্বর। কবি মহাদেব সাহার কন্ঠে বলি- ‘যখনই বাংলায় নামে অমানিশা, ছিন্ন বস্তি, মানুষোর ঘর তখনই দাঁড়ান এসে সেই খানে শেখ মুজিবর।’

শাহিদা আক্তার জাহান সদস্য, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট