চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

আত্মহত্যা প্রতিরোধে মনোবিশ্লেষক নাট্যযজ্ঞ

মোস্তফা কামাল যাত্রা

২ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিশ্বব্যাপি একযোগে পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১৯’। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ (ডঋগঐ) এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (ডঐঙ) দিবসটি যথাযোগ্য গুরুত্বসহকারে পালনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় “আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন”। বিষয়ের আলোকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা অনেকগুলো কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। অসংখ্য শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে দিবসটি পালনের নানামুখী উদ্যোগ সুধীজনসহ সকল মহলের প্রশংসা পেয়েছে। যা মানসিক স্বাস্থ্য, ট্রমা, মাদকাশক্তি সম্পৃক্ত জটিল রোগ নিরসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

আত্মহত্যা এবছরের প্রতিপাদ্য হিসাবে মনোনিত হওয়ার কারণ সারাবিশ্বে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, আত্মহত্যা সফল না হয়ে মাত্রারিক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা জনশক্তির ভোগান্তির পরিমান বৃদ্ধি এবং আত্মহননকারী পরিবার ও ঐ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্টজন, তার কর্মস্থলে সৃষ্ট আতংকসহ সামাজিক নানান বিপর্যয় নেমে আসে। যা সামাজিক সম্প্রীতি ও সামঞ্জস্যতা বিঘিœত করে।
অতএব আত্মহত্যায় নিরুৎসাহিত করাই, এখন আমাদের একমাত্র কার্যকর পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ। আত্মহত্যা করে ফেললে সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আবার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা নিয়ে গুরুতর আহত হয়ে জীবনমৃত হয়ে বেঁচে থেকে নিজের ভোগান্তি, পরিবার ও পেশাগত ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী সংকট সৃষ্টি করা হয় মাত্র। যা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতেও সৃষ্টি করে নেতিবাচক নানান উপজিব্য। তাই আত্মহত্যায় নিরুৎসাহিত তথা প্রতিরোধ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে প্রয়োজন যুগ-উপযোগি কার্যকর এবং অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী কর্মসূচী। যা কম খরচে অধিকতর ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে এবং তার সহযোগী প্রভাব হিসাবে সামাজিক আরো বেশকিছু সৃজনশীল কর্মপন্থা নিশ্চিত করবে। এমনতর একটি উদ্দ্যোগ হতে পারে মনোবিশ্লেষক নাট্যযজ্ঞের বিস্তৃত ও ব্যাপক অনুশীলন। উন্নত বিশ্বে যা প্রতিকারমূলক কর্মসূচি হিসেবে পরিগণিত।
আত্মহত্যাকারী এবং আত্মহত্যার প্রবণতামূলক ব্যাক্তির মনস্তত্ত্ব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তারা জীবনে কোননা কোন মানসিক সমস্যা বা রোগের ভুক্তভোগী। প্রধানত তারা মাদকাসক্তি, মৃগী রোগ, বিষন্নতাসহ নানামূখী আবেগগত সমস্যায় ভোগে।

যা যথাযথ সময়ে চিকিৎসার আওতায় আসে না বলে, বিপর্যস্ত ব্যাক্তি এক সময় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তবে যদি মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া চর্চার সুযোগ অবারিত হত; তাহলে পরিস্থিতি ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো।

কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তিকে ঔষুধীচিকিৎসার পাশাপাশি মনোসামাজিক (চংুপযড়ংড়পরধষ) স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা গেলে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাক্তির মধ্যে থাকা আত্মহত্যার প্রবনতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই ক্ষেত্রে পরিবারের সভ্যদের অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ বিপর্যস্ত ব্যাক্তি নিজেকে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচীতে যুক্ত করার মতন অবস্থায় থাকে না। সাইকোথেরাপি তথা মনোসামাজিক সেবা এই পর্যায়ে কার্যকরী একটি কর্মপন্থা। বিশেষ করে আনন্দদায়ক

নাট্যক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই সেবা গ্রহণের সুযোগ ও ক্ষেত্র আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।

এই ধারার মনস্তাত্ত্বিক সেবা প্রদানে দক্ষ জনগোষ্ঠীর ঘাটতিও রয়েছে। অপরদিকে উচ্চতর পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট যেসব শিক্ষা কারিকুলাম আছে তাও আধুনিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি এবং তার বহুমাত্রিক প্রয়োগকলা পাঠ্যক্রম ভূক্তই নয়। যেমন এমবিবিএস এর সিলেবাসে সাইকোথেরাপি একটি কোর্স মাত্র। যাও ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে নির্ধারিত। যা না পড়েই ডাক্তার হওয়া যায়। অপর দিকে মনোবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট শিক্ষাক্রমেও গ্রুপ সাইকোথেরাপির সৃজনশীল পদ্ধতিসমূহ সিলেবাসভূক্ত নয়।

আরো হতাশার দিক হলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সৃজনশীল শিল্পকলা বিষয়ক বিভাগ নাট্যকলা, নৃত্য, সঙ্গীত এবং চিত্রকলা সংশ্লিষ্ট পাঠ্যক্রমেও নেই থিয়েটার থেরাপি, মিউজিক থেরাপি, ডান্স থেরাপি এবং আর্ট থেরাপি। ফলে সৃজনশীল মনোবিশ্লেষক শিল্পকলা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তৈরী হচ্ছেনা দক্ষ থিয়েটার থেরাপিস্ট, আর্ট থেরাপিস্ট, ডান্স থেরাপিস্ট এবং মিউজিক থেরাপিস্ট।
কর্মমূখী শিক্ষার বিকল্প নেই, তাই অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে “থেরাপিউটিক থিয়েটার এন্ড আর্ট’স” অনুষদ প্রতিষ্ঠা করে ড্রামা থেরাপি, ডান্স থেরাপি, মিউজিক থেরাপি, আর্ট থেরাপি বিভাগ চালু করা যুগের চাহিদা। অন্তত এই ধারার মনোবিশ্লেষক নাট্যযজ্ঞের দক্ষজনবল সৃষ্টি করা গেলে আমাদের দেশে ক্রিয়েটিভ থেরাপিষ্টদের কর্মক্ষেত্রের সুযোগও অবারিত হত। বাংলাদেশ একটি দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার দেশ। এখানে মানসিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্র যেমন বেশি তেমনি আশংকাজনক হারে মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশী। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় মনোবিপর্যয়ের আওতায় থাকা জনগোষ্ঠীকে কম ব্যায়ে কার্যকর মনোবিশ্লেষক সেবা প্রদানে দক্ষজনবল সৃষ্টির বিকল্প নেই।

সামাজিক অবক্ষয়, যৌথপরিবার প্রথায় ভাঙ্গন, আত্মকেন্দ্রিক জীবনাচার, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, গুনগতমানের শিক্ষাবান্ধব পরিস্থিতির অনুপস্থিতি, চাকরির বাজার, দ্রব্যমুল্যেও উর্ধ্বগতিসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক মনোসামাজিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট হতাশা, জীবনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ভ’ক্তভোগি জনগণের মধ্যে মনোবৈকল্যতার জন্ম দিচ্ছে। তা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগণকে মানসিকভাবে প্রশান্ত রাখতে হলে শিক্ষালয়, কর্মস্থলসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আত্মহত্যার প্রবণতা দূর করতে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সেবা প্রদানে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা প্রারম্ভিক উদ্যোগ হিসাবে বিবেচিত। বিশ্বব্যাপি মানবিক ও সামাজিক জনসমাজ গড়ে তুলতে বিকল্প মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসেবা (অলটারনেটিভ সাইকোসোসাল কাউন্সেলিং) এর জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে মনোবিশ্লেষক নাট্যযজ্ঞ এর বিদ্যায়তনকীকরণ পাঠকে খুবই গুরুত্বসহকারে নেয়া হয়েছে। যার পরম্পরা বাংলাদেশেও অনুসরণ করা সময়ের দাবি।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের এবছরের প্রতিপাদ্য-এর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক উল্লেখিত পর্যালোচনা বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রতি আহ্বান রইল। আসুন এ বছরের প্রতিপাদ্য আত্মহত্যা প্রতিরোধের পথকে প্রসস্ত করতে দেশে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়ার পাঠ প্রক্রিয়া চালুর উদ্যোগ নেই। ঝুঁকিতে থাকা জনসমাজের আত্মহত্যা প্রবণতা রোধ করি। আত্মহত্যা প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা রাখি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট