চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফাতেহা-ই-দোয়াজদাহুম

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৩১ অক্টোবর, ২০১৯ | ৩:১২ পূর্বাহ্ণ

হে রাসুল ! আজি তব শুভ জন্ম উৎসবের দিনে /যে সুর উঠিল বাজি অনাহূত মোর মনোবীণে,/তাহারে ধরিয়া লব- জানিনাকো কোন বাণী দিয়া, /সারা চিত্ত ছন্দে-গানে উঠিয়াছে ব্যাকুল হইয়া। /উদয়– শিখর পানে চেয়ে আছে স্থির দৃষ্টি মেলি,/হেরেছে তোমার সেই আগমনী- মহামহোৎসব,/শুনিতেছে দিকে দিকে অবিরাম হর্ষ- কলরব। /কি আনন্দ-কলরোল উঠিয়াছে আকাশ ভূবনে,/এ দিন কখনো যেন আসে নাই ধরার জীবনে/আকাশ দিয়াছে তার রক্ত-রাঙা অঙ্কণ-কিরণ /বেহেশতের সুধা গন্ধ আনিয়াছে মৃদু সমীরণ,/ছুটাছুটি করিতেছে দিকে দিকে ফেরেশতার দল,/ সারাচিত্ত তাহাদের আজি যে গো পুলক চঞ্চল!/এসেছে হাজেরা বিবি, আসিয়াছে বিবি মরিয়ম /আমিনার গৃহে আজি বেহেশতের শোভা অনুপম! …

পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস আসলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাসুলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে ও স্মরণে নানাবিধ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। এ মাসের বারো তারিখ ও এর আগে-পরে মুসলিম জনপদ হযরত রাসুলে কারীমের (স.) স্মরণ ও যিকিরে ব্যাপকভাবে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। কেননা এ মাস হুজুর (স.) এর পবিত্র জন্ম ও তিরোধানের, শাদী ও হিজরতের। মাহে রবিউল আউয়ালে আকুল করা ব্যাকুল করা জাগরণ গড়ে তোলা হয় নবীজীকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এবং তার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য। উপরোল্লিখিত পংক্তিমালা কবি গোলাম মোস্তফা নিবেদন করেছেন মহানবীর (স.) পবিত্র জন্মোৎসবকে সামনে রেখে ‘ফাতেহা – দোয়াজদাহুম’ শিরোনামে।

নবীজী হযরত মুহাম্মদ (স.) সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। হযরতের (স.) জিকিরকে ব্যাপকতর করেছেন আল্লাহ নিজে। আল্লাহপাক সূরা আল ইনশিরাহে বলেছেন: ওয়া রাফা’না লাকা যিকরাক- ওহে নবী (স.)! আমরা আপনার স্মরণকে চির বুলন্দ করেছি…….।’ মাহবুবে খোদা হযরত রাসুলে কারীম (স.) এর স্মরণ আমরা না করলে আল্লাহ ও রাসুলের (স.) কিছু আসে যায় না; বরং এটি আমাদের কর্তব্য- দায়িত্ব ও মর্যাদার পরিচায়ক। আল্লাহকে যেমন জানার শেষ নেই, তার পবিত্র কোরআন শরীফ গবেষণা করে যেমন শেষ করা যায় না, আল হাদীস গবেষণার যেমন শেষ নেই, তেমনি নবীজীকে জানার মধ্যেও শেষ নেই, ক্রমাগত পিপাসা বাড়তে থাকে। পক্ষান্তরে নবীজীকে সর্বাত্নক না জানাই জাহেলিয়াত, অন্ধকার, অন্ধত্ব।

মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন: ওহে হাবীব (স.)। নিঃসন্দেহে আমি আপনাকে গোটা মানবজাতির কাছে প্রেরণ করেছি একজন সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শক হিসেবে। ওয়ালা কিন আকসারান্নাসি লা-ইয়ালামূন-অথচ অধিকাংশ মানুষই তা বুঝতে পারছে না।’ পবিত্র কুরআনের এ উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় আঁ-হযরত (স.) সকল মানুষের রাহবার ও মুক্তিদাতা। তাকে যে কোন উপলক্ষই হোক না কেন, বেশি বেশি স্মরণের মধ্যে মানবজাতির কল্যাণ নিহিত। এখন আমরা এ যুগের রাসুলুল্লাহর (স.) জন্য কিছু করছি না। বরং যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে জায়িজ/ না-জায়িজের ফতোয়া তুলে কঠিন অবস্থান নিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যারা জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) এর জীবন ও কর্মের বিরোধিতা করার কথা ছিল তারাই তার আসল চরিত্র মাধুর্য্য বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন শত ত্যাগ ও নির্যাতনের ঝুঁকি নিয়ে।

বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক মাইকেল এইচ তার বিশ্ববিখ্যাত ‘দি হান্ড্রেড’ গ্রন্থে একশত জন দুনিয়াজোড়া সেরা মনীষীর মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স.) কে পহেলা নম্বরে রেখেছেন। অথচ এই গবেষক তার গবেষণায় নিজ ধর্মের প্রবর্তককে রেখেছেন তৃতীয় নম্বরে। মাইকেল যুক্তি দিয়ে বলেছেন, হযরত মুহাম্মদ (স.) ই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি সর্বাধিক ও প্রাত্যহিক স্মরিত ও বরিত হয়ে থাকেন…..।’

কেউ কেউ বলেন, মিলাদুন্নবী (স.) রাসুলের (স.) জামানায় ছিলনা, এখন কেন? জবাবে বলা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগ ছিল ত্যাগের, ক্ষুধা, অনাহারের, যুদ্ধ ও শাহাদাতের। স্বয়ং নবীজী ইসলামের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তত: ২৭ টি যুদ্ধে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন, সাহাবায়ে কেরাম বিছানার চেয়ে বেশি অবস্থান করতেন যুদ্ধের মাঠে-ময়দানে, ঘোড়ার পিঠে। সুতরাং সে যুগে কেন রবিউল আউয়াল উদযাপিত হয়নি সে প্রশ্ন অবান্তর।
পক্ষান্তরে রাসুলের (স.) যুগে পালিত হয়নি অথচ আজ ইসলামের অন্যতম শিআর বা নিদর্শনে পরিণত হয়েছে এমন উদাহরণ বহু। ধরুন কুরআন সংকলন, হাদীস সংকলন, মসজিদের মিহরাব স্থাপন প্রভৃতি। আবার রাসুলের (স.) যুগে ছিল অথচ প্রয়োজন থাকা সত্বেও আজ সমাজে বাস্তবায়িত নেই, এমন বিষয়ও নেহায়েত কম নয়।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ও তার মুবারক সাহাবাগণ ছিলেন অল্পে তুষ্ট, পরিমিত পানাহারকারী ও মিতব্যয়ী। নির্লোভ, নিরহংকার দুনিয়াবিমূখ জিন্দেগী তাদেরকে দুনিয়ায় বরকত দিয়েছে এবং আখিরাতে দিয়েছে জান্নাত ও দীদারে মাওলা। তাদের শ্লোগান ছিল: আখিরাতের জীবন ছাড়া জীবন নাহি আর/আনসার- মুহাজিরের আল্লাহ মদদগার।
কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আজকের আলেম-ওলামাদের কোন উচ্চবাচ্য নেই, বক্তব্য নেই, আনুষ্ঠানিক প্রচার নেই, নেই প্রবন্ধ-নিবন্ধ। যা ভূমিকা আছে, তা একান্তই ভোগের পক্ষে, কোন্দলের পক্ষে, অন্য কাউকে না মানার পক্ষে। আধুনিক যুগ-জিজ্ঞেসার জবাব দিতে এবং পরিবেশ সামাল দিতে ইসলামকে গণমুখী করতে তারা নারাজ। এক্ষেত্রে তাদের অনীহা দৃশ্যমান। যারা কুরআন হাদীস হতে সরাসরি রস আহরণ করে সাধারণ মানুষকে বুঝাতে সক্ষম তারা মাদ্রাসার চার দেয়ালের ভেতর স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে থাকেন।

এমন নাজুক পরিস্থিতে বাইরের জগতে যে সামান্য দ্বীন-ধর্মের কথা হয়, আলোচনা হয়, আবেগ-উচ্ছাস প্রকাশ পায়, এমন ২/১ টি আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যে মিলাদুন্নবী (স.) কিম্বা এর আদলে পালিত অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা। পরবর্তীতে রবিউল আউয়ালের এসব অনুষ্ঠানমালার প্রভাবে গোটা বছর বিক্ষিপ্তভাবে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারসমূহের উদ্যোগে। এখন এসব অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা মানে একটি শক্তিশালী দেয়ালের সাথে নিজের মাথাকুটা। বরং কিভাবে এটি বৈধ হয়, গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং বাড়াবাড়ি না থাকে তা ভেবে দেখা দরকার। কে মিলাদুন্নবী (স.) প্রথম করেছেন তা গবেষণার দরকার নেই, বরং একে কিভাবে দ্বীনের তাবলীগ ও ইশাআতের কাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা যায় তা বুঝিয়ে বলুন।

চট্টগ্রামের একজন বিখ্যাত আলিম ও ইসলামী চিন্তবিদ এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে যার নাম উল্লেখ করে খাটো করতে চাই না, বলেছেন: এখন ‘বার্থ ডে’ না জায়েজ বললে মানুষ শুনছে না। এ অনুষ্ঠান আমরা অপছন্দ করি বলে এতে আমাদের দাওয়াত সাওয়াদর দেয় না। এমতাবস্থায় কোন পন্থায় ‘বার্থ ডে’ বা জন্মবার্ষিকী পালন করলে আয়োজন করলে ধর্মময় ও বরকতময় হবে তা বিবেচনায় আনা দরকার। তাহলে আলিম-ওলামাগণ এসব পরিবারের ঘনিষ্টতা অর্জন করবেন এবং তাদের পরশে পরিবারসমূহ হবে সুশীল ও ধর্মচারী।

এ প্রসঙ্গে উক্ত ইসলামী চিন্তাবিদ একটি সুন্দর উদাহরণ দেন। চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও রয়েছে মৌলভীর দোকান, মৌলভীর টেক নামক একটি জায়গা। যে মৌলভীর নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে জীবদ্দশায় তিনি আয়োজন করতেন ‘মৌলভীর বলিখেলা’। অনেকে শুনে তখন চমকে উঠতেন। মৌলভী সাহেব ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন না করে বলিখেলা’র আসর বসান……।

বাস্তবিক ক্ষেত্রে এ ‘বলিখেলার’ পেছনে ছিল এক সুখকর ঘটনা। মৌলভীর বলি খেলার অনতিদূরে অনুষ্ঠিত হতো বার্ষিক গান বাজনা, অশ্লীল নৃত্য ও জুয়ার আসর। এতে মানুষের ঢল নামতো। মৌলভী সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন পাল্টা কোন ‘ধর্মীয় মাহফিল’ দিলে পাশের অশ্লীল অনৈসলামিক বাজনা ও জুয়ার আসরটি ভাঙ্গা কিম্বা জনপ্রিয়তা রোধ কোনটাই সম্ভব হবে না। বরং তিনি পাল্টা আয়োজন করলেন ‘বলিখেলার অনুষ্ঠান’। সাথে থাকছে বিজয়ীদের জন্য ‘গোল্ড মেডেল’।
বার্ষিক গানের আসরের দিন যখন বিপক্ষের বলিখেলা ও স্বর্ণের মেডেলসহ আকর্ষণীয় পুরস্কারের ঘোষণা দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়ে তখন গানের আসরে আর শিশু-কিশোর না গিয়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে মৌলভীর বলিখেলায়।

ওদিকে গানের আসরের পেন্ডেল লোকজনের অভাবে খাঁ খাঁ করছে। পরবর্তীতে মৌলভী সাহেবের এ বুদ্ধিভিত্তিক সংস্কারের কারণে ঐ এলাকা হতে অশ্লীল গান ও জুয়ার আসর সম্পূর্ণ উচ্ছেদ হয়ে যায়। প্রথমে শুনতে খারাপ লেগেছিল মৌলভী সাহেব কেন গেলেন বলিখেলার আয়োজন করতে। শেষমেষ যে কেউ বলতে বাধ্য হন, সমাজের অনৈসলামিক কর্মকা- রোধে মৌলভী সাহেব একটি দৃষ্টান্তমূলক অবদান রেখেছেন। আল্লাহ পরকালে তাকে এর উত্তম বদলা দান করুন।

পরিশেষে মহানবীর (স.) জীবন বন্দনা সমকালীন গোটা বিশ্বকে উদ্বেলিত করে তুলুক এ কামনা কবি গোলাম মোস্তফার মত আমাদের সকলের। তিনি লিখেছেন: হে রাসূল! আজিকের এই পূণ্য প্রভাত আলোকে/ তোমারে সালাম করি দূর হতে পরম পুলকে!/উৎসবের মাঝে আমি এই কথা যেন নাহি ভুলি/ তুমি শুধু কারো নাই ধন্য এই ধরণীর ধূলি, পুণ্য প্রেম, শান্তি প্রীতি ইহারাও তব সাথে সাথে/ জন্ম লভেছে আজ এই পূণ্য আলোক প্রভাতে!

হে নিখিল ধরাবাসি! মুসলিমের লহ নিমন্ত্রণ, /এ উৎসব নহে শুধু আমাদের একান্ত কখন!/নাসারা খৃষ্টান এসো, এসা বৌদ্ধ চীন, / মহামানবের এ যে পরিপূর্ণ উৎসবের দিন। – ( প্রাগুক্ত)।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট