চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

চারিদিকে কেনো এতো সহিংসতা-অসহিষ্ণুতা?

মাহবুবা সুলতানা শিউলি

৩১ অক্টোবর, ২০১৯ | ৩:১২ পূর্বাহ্ণ

‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না?’- সবসময় এই নীতিতেই মানুষ চলতে চায়। কিন্তু অনেক সময় এই নীতিতে চললে শুধুই দুর্বল ভাবা হয়। তাই মাঝেমাঝে ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ নীতিও অনুসরণ করতে হয়। কেবল শারীরিকভাবে আক্রমণই সহিংসতা নয়, ভাষাও সহিংসতার একটা প্রকাশ। আপনার ভাষাও চিহ্নিত করে আপনি সহিংস কিনা। আপনার আশেপাশে, ফেসবুকে, পত্রিকার পাতায়, খুব সাজানো অনুষ্ঠানে কে কী বলছেন সেটা দেখুন তাহলেই বুঝতে পারবেন কোথা থেকে সমাজে অসহিষ্ণুতা এবং সহিংসতা বাড়ছে। কখনও কখনও ভাষাগত আক্রমণ শারীরিক আক্রমণের চেয়েও মারাত্মক। মানুষ আজ বড় অসহিষ্ণু। নিজেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। কিন্তু কেন? দুঃসময়ের এই লগ্নে জাতীয় কবি নজরুলের একটি কবিতার দুটো লাইন হৃদয়ে বেজে উঠছে, ‘আমরা সবাই পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি’। আমরা নিজেদের দোষ দেখি না শুধু অপরের দোষগুণ নিয়েই ব্যস্ত থাকি।

ফেসবুককে প্রথমে আমরা একপ্রকার বিনোদনই ভাবতাম। বন্ধুবান্ধব পরিচিত মহলদের ফেসবুকে দেখলে ভালো লাগতো। কিন্তু এখন সেইটা নেই। সে ধরনের পোস্ট এখন প্রাইভেসিতে অনলি মি বা অনলি ফ্রেন্ড দিয়ে পোস্ট করতে হয়। পাবলিকলি পোস্ট করলে কে কি কমেন্ট করে, সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। ফেসবুক এখন ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক প্রভাব ফেলছে। অথচ একটা সময় আমরা ফেসবুকে গল্প, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধও পড়তাম। ভালো লাগতো। তারপর আসতে আসতে ফেসবুক এমন এক অবস্থায় চলে গেছে এখন এটা রাজনীতির জায়গা। কার কি অবস্থান এখন যেন ফেসবুকই তা নির্ধারণ করে। এখানে ভাষার দ্বারা পরস্পরকে আক্রমণ, সহিংসতা এমনকি একটু হিসাবের বাইরে লিখলেই জান খতম। এখন ফেসবুকই নির্ধারণ করছে, কে বাঁচবে? কে মরবে? একটু এদিক-সেদিক লিখেছেন তো খবর আছে। গতবছর ভুল চিকিৎসার কারণে অকালে ঝরে যাওয়া সাংবাদিক কন্যা শিশু রাইফাকে নিয়ে বার বার লিখতে গিয়ে আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সব ফ্রেন্ডদের ট্যাগ করে এত জঘন্য পোস্ট আমার ওয়াল থেকে করা হয়েছিল যা কল্পনাও করা যায় না।

সৌভাগ্যক্রমে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে আইডি উদ্ধার করে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলাম। তারপর একটু হিসেব নিকেশ করে লিখি। বেশ কিছুদিন ধরে বার বার লিখতে চেয়েও মন বাধা দেয়। লিখতে পারি না। এই আমিকে আমি নিজেই চিনতে পারছিনা। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, কেন আমি লিখছি না বা লিখতে পারছিনা?

‘অসির চেয়ে মসি বড়’- এটাই বিশ্বাস করি। তাই সমাজের নানান অসংগতি দেখলে আমার কলম কোনো বাধা মানে না। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকা-ের ঘটনাটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনা। একজন সন্তানকে তিলে তিলে কত কষ্ট করে বাবা-মা বড় করে তুলেন। আর এরকম হীরের টুকরার পিছনে সেই বাবা-মায়ের শ্রম, ত্যাগ কতটা হতে পারে তা চিন্তা করা দুঃসাধ্য। এই পিতা-মাতার পায়ে একটি দেশ বিক্রি করে সব অর্থ প্রদান করলেও তাঁদের কলিজাটার ছিটেফোঁটার সমমূল্যও হবে না। কোটিতে একজন আবরার ফাহাদ জন্মায়।

বাংলাদেশে এমন কোনো বাবা-মা নেই, যে তাঁদের সন্তানকে বুয়েটে পড়াতে চাননা। তাঁদের স্বপ্নের জগতে একটিবারের জন্য হলেও তাঁদের সন্তানদের অবশ্যই বুয়েটে পড়াতে চেয়েছেন এবং প্রতিটি মেধাবী শিক্ষার্থীরও কলেজজীবন শেষে পরবর্তী প্রথম পছন্দই বুয়েট। কিন্তু দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরাও আজ হিং¯্র জানোয়ার হয়ে গেছে। গুটি কয়েকজনের জন্যে আজ প্রতিষ্ঠানটিও কলংকিত। তিলে তিলে গড়ে তোলা সন্তানকে এখানে পাঠাতে আজ বাবা-মা দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন, যা আগে কখনও স্বপ্নেও ভাবা যেতো না। যাই হোক, নোংরা রাজনীতির অন্তরালে আবরার হত্যাকান্ডের ঘটনাটি যেন ধামাচাপা না পড়ে। আমরা আবরার হত্যাকান্ডের সঠিক বিচার চাই। অপ্রিয় হলেও সত্য, একজন আবরারকে হারিয়েছি বলেই আজ আমরা বুয়েটের ভিতরকার জঘন্য সব বিষয়গুলো সবাই জানতে পারছি। আশাকরি বুয়েট থেকে এসব নির্মূল হবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই। আর এসব জঘন্যতা নির্মূলের জন্য প্রয়োজন ক্ষমতালোভীদের অপসারণ করে প্রকৃত মেধাবী বিবেকবানদের নিয়োগ করা। আর দুঃখজনক হলেও একথাও কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে আবরারের সাথে সাথে আরও বিশটি মূল্যবান সম্পদকে হারিয়েছে এদেশ।

কিন্তু কেন? অথচ এ সম্পদগুলো যখন তাদের বাবা-মা, শিক্ষকদের অধীনে ছিলো তখন তো তারা সোনার টুকরা ছেলে হয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলো কিন্তু বুয়েটে এসে ওরা নষ্ট হয়েছে। হত্যাকারী হয়েছে। এর দায়ভার কে নিবে? এই বিশটি সম্পদ তৈরিতে এদেশ, তাদের পিতামাতা, শিক্ষকদের সারাজীবনের শ্রম মাটির সাথে মিশে গেলো। অথচ ওদের হবার কথা ছিলো, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক। হায়রে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেখানে এত বড় সম্মানের চেয়ারের চেয়ে অন্যকোনো পদের আশায় উপাচার্যের চেয়ার নির্দ্বিধায় ছাড়তে রাজি। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে সেরকম শিক্ষকদের দেখতে দেখতে তারাও তাদের মেধা কোথায় ব্যবহার করবে তা ভুলে যায়। সত্যিই দুর্ভাগা এদেশ। আমরা নিশ্চয় এরকম দেশ চাইনি। দেশের সম্পদগুলো এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটি দেশকে ধ্বংসের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাটা নষ্ট করাই যথেষ্ট।

আবরার হত্যার ইস্যুর নিচে যেন চাপা পড়ে গেছে দুর্নীতিবাজ ক্যাসিনো স¤্রাটদের কা-কীর্তি ও দুর্নীতিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। শুধু বুয়েট নয় র‌্যাগিং নামক এই জঘন্য প্রথা দেশের প্রায় সব কলেজ-ভার্সিটির হোস্টেলেই হয়ে থাকে। র‌্যাগিং এর নামে যা হয় তা কল্পনাতীত। শিক্ষার্থী কেন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, কেন মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। র‌্যাগিং যখন চরম আকার ধারণ করে তখনই এসব ঘটনাগুলো ঘটে। কিন্তু তা প্রকাশিত হয়না এবং খুব সহজেই সেগুলো ধামাচাপা দেয়া হয়। কেউ মুখ খুলতেও সাহস পায় না। তারপরও বাবা-মায়েরা আশায় বুক বাঁধে। বুয়েটের সাথে সাথে যেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে র‌্যাগিং নামক এই জঘন্য প্রথা প্রচলিত আছে তা যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে।

যে সন্তানকে বাবা-মা কত যতেœর সাথে আদর-সোহাগ-শাসনের সাথে বড় করে তুলেছে অচেনা পরিবেশে হঠাৎ র‌্যাগিং নামক বীভৎসতা তাদের কচি দেহ মনকে দুর্বিসহ করে তুলে। আর যারা সহ্য করতে পারেনি তারা হয় মানসিক রোগে ভুগেছে নতুবা আত্মহত্যা করেছে। কর্তৃপক্ষ দেখেশুনেও অজানা কারণে চুপ করে থাকেন। না দেখা, না জানার ভান করে থাকেন।
প্রতিদিনই নিত্য-নতুন চমকপ্রদ নিউজ আমরা পড়ছি। ৮-১০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কেউ যখন চাকরি পায় তখন ওদের মানসিকতাই ওরকম হয়, যে টাকা ইনভেস্ট করেছি সেইটা আগে উদ্ধার করি। আর ততদিনে সে চাকুরিজীবী ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, বিবেকহীন কীটে পরিণত হয়। আর এভাবেই সমাজটা রসাতলে চলে যাচ্ছে। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গরীব হচ্ছে। এদেশে এখনও রাস্তায় মানুষ ঘুমায়। খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানের অভাবে এখনও মানুষ মরছে। আজকালকার তরতাজা নিউজগুলো হলো, বাবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নির্মমভাবে বর্বরতার সর্বোচ্চ প্রয়োগপদ্ধতি ব্যবহার করে সন্তানকে খুন করে। মা পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে শিশুকন্যা ও স্বামীকে জবাই করে। পিতা নিজ কন্যাকে ধর্ষণ করে। শিক্ষক ছাত্রাবাসে ছাত্রকে বলাৎকার করে। নিরপরাধ কোন কিশোরীকে বাসায় একা পেয়ে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়। গ্রামেগঞ্জেও শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ না পাওয়ায় হত্যা। আপন চাচা সাত বছরের ছোট্ট ভাতিজিকে ধর্ষণ করে, বিলাসবহুল জীবন বিসর্জন দিয়ে গরীবের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিবে বলে দেশে ফিরে আসা সুচিকিৎসক খুন হয়, যারা লাখটাকা বেতন পায় তারাও দফায় দফায় অনশন করে আর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা আন্দোলন/অনশন করলে পুলিশের লাঠিচার্জে লাঠির বাড়ি খায়। বন্ধ হোক খুন, ধর্ষণ আর অরাজকতা। এসব আর কতকাল চলবে? ফেসবুকের লেখালেখিতে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হওয়া কাম্য নয়। অসাম্প্রদায়িক এই দেশে আবারও কি জানি কি হচ্ছে।

আর বেশি কিছু লিখতে চাইনা। এ সবকিছু দেখতে দেখতে স্বতঃস্ফূর্ত এই আমিও যেন দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। মূল্যবান একটা কথা বলে ইতি টানতে চাই। ‘সাবধান! তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করোনা। এ বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে’ -বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.)। মহান আল্লাহ সবাইকে ভাল রাখুন, সুস্থ বোধশক্তি দিক- এ প্রার্থনা।

মাহবুবা সুলতানা শিউলি সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট