চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

উচ্চআদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

মোবাইল ফোন টাওয়ারের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবান্ধব পদক্ষেপ নিতে হবে

২৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৪০ পূর্বাহ্ণ

মোবাইল ফোন টাওয়ার থেকে নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তা এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে সচেতন নাগরিকসাধারণের মনে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও বিষয়টি তেমন আমলে নেয়া হয়নি কখনো। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে মোবাইল ফোন টাওয়ার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নানা গবেষণায় মোবাইল ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশন তথা তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহ, এমনকি পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর বিকিরণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে হাইকোর্টে দায়ের করা রিটের প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে সমীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের পাশাপাশি ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। বৃহস্পতিবার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাসহ সব স্পর্শকাতর জায়গা থেকে মোবাইল ফোন টাওয়ার দ্রুত সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়ে পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। এটি একটি আশা জাগানিয়া খবর, সন্দেহ নেই।

রায়ে স্পর্শকাতর জায়গা বলতে হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজকে বোঝানো হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু হয় দুই দশক আগে। সূচনাকালে তেমন বিধিনিষেধ আরোপ না করায় মোবাইল ফোন অপারেটররা যত্রতত্র টাওয়ার স্থাপন করে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং বাসাবাড়ির ছাদেও টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। সারাদেশে ৫টি মোবাইল অপারেটরের এখন প্রায় ৪০ হাজার টাওয়ার আছে। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে একুশে টেলিভিশনে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচারিত হয়।

টাওয়ারের ক্ষতিকর দিকগুলো সামনে আসলে বছরকয়েক আগে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গঠিত কমিটি উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ পায়। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করে। গাইডলাইনে রেডিয়েশন মাত্রা আন্তর্জাতিক নন আয়জনিং রেডিয়েশন প্রতিরক্ষা কমিশন বা আইসিএআইআরপি-এর নির্দেশনা মতো দশ মেগাহার্টজে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়। তবে দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব ও পরিবেশ বিবেচনায় তা দশ ভাগের এক ভাগ হওয়া উচিত মনে করেন অনেক গবেষক। কিন্তু কোনো অপারেটরই সে গাইডলাইন মানছে না। প্রসঙ্গত, মোবাইল ফোনের বেস ট্রান্সিভার স্টেশন বা বিটিএস টাওয়ার স্থাপনে বিভিন্ন দেশ নিরাপদ নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। নিরাপদ নীতিমালায় টাওয়ার স্থাপনের স্থান, টাওয়ারের সিগন্যাল আদান-প্রদানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং বিকিরণমাত্রাসহ নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটররা নিরাপদ নীতিমালা অনুসরণ না করার অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে, কোনো রকম স্বাস্থ্যসমীক্ষা ছাড়াই মোবাইল ফোন অপারেটররা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বাড়ি, স্কুল এমনকি হাসপাতালের ছাদেও স্থাপন করেছে বিটিএস টাওয়ার। টাওয়ারের সিগন্যাল আদান-প্রদানে ব্যবহার করছে নি¤œমানের যন্ত্রপাতিও। ফলে সাধারণ মানুষ রেডিয়েশনের সরাসরি শিকার হচ্ছে। পড়ছে নানামুখী ঝুঁকিতে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত রেডিয়েশনের মাত্রা উচ্চপর্যায়ের, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঝুঁকি নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর না হওয়া দুঃখজনক। তবে আশার কথা হচ্ছে, মোবাইল ফোন টাওয়ারে বিকিরণমাত্রা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ১০ ভাগের একভাগে কমিয়ে আনাসহ মোবাইল টাওয়ারের স্বাস্থ্যঝুঁঁকি নিরসন বিষয়ে উচ্চ আদালত পূর্নাঙ্গ নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করা গেলে ইতিবাচক ফল আসবে নিশ্চয়ই। উল্লেখ্য, মানুষের শরীরের সেলগুলোর যোগাযোগ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করে এক্সটারনাল রেডিয়েশন। এর পরিণতিতে ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকিও তৈরি হয়। আইসিএআইআরপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানবদেহের জন্য রেডিয়েশনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কান ও মস্তিষ্কের টিউমার সৃষ্টি হওয়া। এ ছাড়া রেডিয়েশনের কারণে মাথাব্যথা, হৃদরোগ, ঘুম ঘুম ভাব, নিদ্রাহীনতা কাজের ব্যাঘাত ঘটাসহ অনেক সমস্যা হতে পারে। শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও এ রেডিয়েশন ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া জেনেটিক পরিবর্তন, অবসন্নতা, লিউকেমিয়াসহ আরো কিছু রোগের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে রেডিয়েশনের কারণে।
আমরা আশার করবো উচ্চআদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের নিরাপদ স্থানে টাওয়ার সরিয়ে নেয়া এবং উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও রেডিয়েশনমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়াসহ এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবান্ধব ত্বরিৎ পদক্ষেপ নেবে সরকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট