চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

দ্রুত কার্যকর করাই এখন চ্যালেঞ্জ নুসরাত হত্যা মামলার জনপ্রত্যাশিত রায়

২৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় প্রদত্ত রায়টি নানা কারণে তাৎপর্যবহ ও যুগান্তকারী। রায়ে মূল হোতা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনের মৃত্যুদ- দিয়েছেন ফেনীর নারী ও শিশুনির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ে বর্বরতার সাথে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়েছে। এ রায় সমাজের সব অপরাধীর কাছে একটি সতর্কবাতা দেবে নিশ্চয়ই। একইসঙ্গে রায়টি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। সন্দেহ নেই, এই রায় সারাদেশেই নারীনির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণসহ নারীঘটিত অপরাধ হ্রাসে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দ্রুত সময়ে মামলার নিষ্পত্তি ও জনকাক্সিক্ষত রায়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের আন্তরিকতারও সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে।

রায়ে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় ১৬ আসামির অংশগ্রহণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হলো। এছাড়া প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়। মামলার ৮০৮ পৃষ্ঠার রায়ে তৎকালিন পুলিশের এসপি ও ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো সচিত্র ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করা হয় মামলার রায়ে। ঘটনার মাত্র সাড়ে ছয় মাসের মধ্যে এবং মাত্র ৬১ কার্যদিবসে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার বিষয়টি ‘নজিরবিহীন’। উল্লেখ্য, গত ২০ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ২৭ জুন থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। মামলার ৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন সাক্ষ্য দেন। বাকি চারজনের মধ্যে একজন বিদেশে থাকায় এবং তিনজনের সাক্ষ্য অন্য সাক্ষীদের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যাওয়ায় তাঁদের সাক্ষ্যগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে তার মায়ের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসাকেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে গেলে নুসরাতকে মাদরাসার প্রশাসনিক ভবন কাম সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বোরকা পরা পাঁচ দুর্বৃত্ত। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গত ২৮ মে ১৬ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ করে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে পিবিআইয়ের লাগে ৩৩ কার্যদিবস। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন সাক্ষ্য দেন আদালতে। আর ২৪ অক্টোবর জনকাক্সিক্ষত রায় ঘোষণা করেন আদালত। এ রায়ে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে।

নুসরাত এবার আলিম পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সুযোগ দেয়নি পাষ-রা। তার আগেই বেদনাদায়ক অবসান হয় তার সম্ভাবনাময় জীবনের। তবে রাফির এই মৃত্যু ক্লীবসমাজের গালে চপেটাঘাত করার পাশাপাশি মানবিক মানুষদের সাহসী করে তুলেছে। প্রতিবাদী করেছে নারীসমাজকেও। তার সুবিচার দাবিতে রাজপথে নেমেছে লাখো জনতা। গণমাধ্যমও সাহসী ভূমিকা রেখেছে। আদালতের রায়েও গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, রাফি হত্যার বিচারে অপরাধীরা ছাড় পাবে না। হাইকোর্টও বিচারে নজর রাখার কথা বলেছেন। এসব ছিল আশার কথা। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে জনপ্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আমরা নুসরাত হত্যার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক রায়ের জন্য বিচারসংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানাই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার রায় ঘোষিত হওয়া এবং অপরাধের মাত্রানুযায়ী আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হওয়া প্রমাণ করে পুলিশপ্রশাসন এবং আদালত ন্যায়বিচারের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক ছিল। নিশ্চয়ই এ রায় দেশে অপরাধপ্রবণতা কমাতে ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ রায়ে মানবিক চেতনায় পুষ্ট সব দেশবাসীর ন্যায় আমরাও স্বস্থি বোধ করছি। তবে, দ্রুত বাকি আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রায় কার্যকর করার পদক্ষেপও দেখতে চাই আমরা। যাতে অপরাধপ্রবণ লোকজন একটি কার্যকর বার্তা পায়। আমাদের বিশ্বাস, দ্রুত এ রায় কার্যকর হলে অপরাধীরা নারীঘটিত অপরাধ করতে ভয় পাবে। ভবিষ্যতে আর কোনো ধর্ষক ও হত্যাকারী সহজেই এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস পাবে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট