চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

নিয়োগপরীক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রাসঙ্গিকতা

রেজা মুজাম্মেল

২৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

জনসংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্য চাহিদা। মানুষের চাহিদা অসীম। কিন্তু তা পূরণে প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকে কমবেশি সবার। কেউ সফল হন, কেউ ব্যর্থ মনোরথে দিনাতিপাত করেন। না পাওয়ার বেদনা মর্মাহত করে অনেককে। তবুও বেঁচে থাকার আকুতি চলে কালনিরবধি।

এই বেঁচে থাকতেই মানুষ একটি পেশার আশ্রয় নেন। চাকরি, ব্যবসা, প্রবাস জীবনসহ নানা পেশায় যুক্ত হতে হয়। কিন্তু ব্যবসার সঙ্গে অর্থের সম্পর্কটা নিবিড়। ফলে অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্যবসা করার সুযোগ থাকে না। তাই লেখাপড়া শেষ করে অন্যরকম ভরসা একটা চাকরি। যোগ্যতা অনুসারে একটি চাকরির জন্য হন্য হয়ে খুঁজে ফেরে। দিনের পর দিন চাকরির পেছনে ছুটে আর ছুটে। কারো ভাগ্যে মিলে এ সোনার হরিণ, কেউ বা খুঁজতে খুঁজতে হতাশ হন। তবুও অপেক্ষায় থাকে- সেই অধরার জন্য।

দুই. সরকারি কিংবা ভাল একটা চাকরি এখন সোনার হরিণ। ভুক্তভোগী চাকরিপ্রার্থী মানেই এ কথার সঙ্গে অধিক পরিচিত। অধিকন্তু চাকরিপ্রার্থীর তুলনায় চাকরির পদ অনেক অনেক গুণ কম। ফলে একটি চাকরি পাওয়া এখন ক্রমশই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠছে। সরকারি একটি চাকরি পাওয়া তো দুরুহই বটে। সরকারি একটা চাকরি পাওয়া মানে মঙ্গলগ্রহ জয় করার মত আনন্দানুভূতি। তবুও এই দুস্কর কাজটি করতে চাকরি প্রার্থীদের থাকে প্রাণপণ চেষ্টা। লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা দিতে নানা ঝক্কি ঝামেলার ধকল পোহাতে হয়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বাইরের জেলার প্রার্থীদের নিয়োগ পরীক্ষা দিতে গিয়ে ওষ্ঠাগত হয় প্রাণ। কারণ বর্তমানে বিসিএস ভাইভা, প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাসহ হাতেগুণা কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষা বিভাগ ও জেলাভিত্তিক হয়। কিন্তু সরকারি বাকি প্রায় সব নিয়োগ পরীক্ষা, ব্যাংক কিংবা ভাল চাকরিগুলোর সিংগভাগই অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। ফলে অপরাপর জেলার প্রার্থীদের অর্থ, সময়, শ্রম, যোগাযোগ ভোগান্তিসহ নানা সমস্যা কাঁধে নিয়েই চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দিতে হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- এ ক্ষেত্রে অনেক প্রার্থীর আর্থিক সামর্থ্য না থাকাসহ নানা সমস্যা থাকে। কারণ সময়টা তখন বেকারত্বের। তাই এই সময়ে টাকা না থাকাটাও স্বাভাবিক। তবুও অনেকে টিউশনি, ঋণ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে অর্থের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ঋণ করে কি এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব? একটি গরীব পরিবারের সংকটের আর্থিক টানাপোড়নের সংসারে কতবরাই বা ঢাকা আসা-যাওয়া করা সম্ভব। কারণ নিয়োগ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একজন চাকরি প্রার্থীকে আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া সব মিলে বড় অংকের টাকা গুণতে হয়। তাই চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে প্রার্থীদের আর্থিকসহ নানা বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়ার সময় এসেছে। চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিলে, একটু আন্তরিক হলেই পরীক্ষা গ্রহণ বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব। বর্তমানে কিছু পরীক্ষা জেলাভিত্তিক হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল।

তিন. বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং ভাইভা- এ তিনটি ধাপ অনুসরণ করা হয়। পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীতে। এসব পরীক্ষায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তিনবার ঢাকায় আসতে হয়। প্রথম ধাক্কাটা খেতে হয় যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সরকারি বাহন রেলের টিকেট সোনার হরিণ। কাউন্টারে তো পাওয়াই যায় না। কখনো কালোবাজারিতে মিললে তা দেড় বা দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। আর নিয়োগ পরীক্ষার দিন বাসে থাকে অতিরিক্ত ভাড়ার খড়গ। সঙ্গে থাকে সড়ক পথে যানজটের শঙ্কা। যানজট হলে যথাসময়ে যথা স্থান (কেন্দ্রে) পৌঁছাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। আছে পরীক্ষাকালীন সময় ঢাকায় থাকার সমস্যা। অন্যদিকে, পরীক্ষার আগের দুই দিনে অন্যান্য বিভাগীয় শহর থেকে ঢাকামুখী যাত্রীর চাপ বাড়ে। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর এবং বরিশাল থেকে ঢাকায় আসার সব যোগাযোগ মাধ্যমেই চাকরি প্রার্থীদের ভিড় ব্যাপক হারে লক্ষণীয়। একই সঙ্গে দেখা যায়, পরীক্ষার আগের দিনগুলোতে রাজধানীর সাধারণ মানের আবাসিক হোটেলগুলোতে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড়। সাধারণত শুক্রবার সকাল ও বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। কিন্তু শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও নিয়োগ পরীক্ষার কারণে সকাল থেকেই যানজটে শুরু হয়। সন্ধ্যার পর নিজ বিভাগে ফেরার জন্য রেল স্টেশন এবং বাস কাউন্টারে ভিড় করতে হয় নিয়োগ পরীক্ষা দিতে আসা চাকরি প্রার্থীদের। অনেক ক্ষেত্রে টিকেট না পেয়ে পরের দিন আবারো ঢাকায় অবস্থান করতে হয় অনেককে। কেবল চাকরি নিয়োগ পরীক্ষার কারণেই শুক্রবারও ঢাকা শহর যানজটে অস্থির থাকে। চাপ বাড়ে মানুষের। ভিড় বাড়ে যানবাহনে। বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নাগরিক জীবনে।

চার. সরকারি সিংহভাগ চাকরি পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ঘটনা এমন নয় যে, কেবল একটি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েই চাকরি পাওয়া যায়। এমন দৃষ্টান্ত অন্তত আমাদের দেশে বিরল, কারো ভাগে জুটলেও তা খুবই নগন্য। শূন্য পদের তুলনায় চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা কয়েক শত গুণ বেশি। ফলে অধিকাংশ প্রার্থীরই চাকরি হয় না।
এমন প্রার্থীও আছেন, যারা চাকরি খুঁজতে খুঁজতে তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত সময় পার করেছেন। এই সময়ে মাসে অন্তত দুইবার করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে ঢাকায় যেতে হয়েছে। পক্ষান্তরে, একাধিক নিয়োগ পরীক্ষার ভাইভাতে অংশ নিয়েও চাকরি হয়নি এমন প্রার্থীর সংখ্যাও হাতেগুণা নয়। একজন বেকার তরুণ বা তরুণী একটি চাকরির প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা পর্যন্ত তিনবার ঢাকায় গেলে তাকে আর্থিকসহ কত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তা ভুক্তভোগী মাত্রই অভিজ্ঞ। কেউ যদি বছরে গড়ে পাঁচটি পরীক্ষায়ও অংশ নেন, তাহলে তাকে কত টাকা ব্যয় করতে হয়, তাও বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষার যদি বিকেন্দ্রিকরণ হতো তাহলে এতসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না।

পাঁচ. সন্দেহ নেই, চাকরি পরীক্ষা বিকেন্দ্রকরণ বিষয়টি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এর সঙ্গে যুক্ত অর্থ, জনবল, ব্যবস্থাপনাসহ নানা কিছু। তবে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা মোটেই বড় কঠিন কাজ নয়। এর জন্য গ্রহণ করতে হবে না বড় কোনো প্রকল্প। দরকার কেবল একটু পরিকল্পনার, ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং চাকরি প্রার্থীদের প্রতি আন্তরিকতার। নিয়োগ পরীক্ষা বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে কমবে চাকরি প্রার্থীদের ভোগান্তি, রোধ হবে আর্থিক অপচয়, চাপ কমবে ঢাকার ওপর। আশার আলো সঞ্চার হবে তরুণদের মাঝে। পরীক্ষায় উৎসাহী হবেন চাকরিপ্রার্থীরা।

রেজা মুজাম্মেল গণমাধ্যমকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট